তালিবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশ বাঘলানের ৩ টি জেলার দখল নিয়েছে আফগানরা। আফগানদের নেতৃত্বে ছিলেন দেশটির সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালেহ এবং উত্তরাঞ্চলীয় জোট প্রধান আহমাদ মাসুদ। পুনরুদ্ধারকৃত জেলাসমূহ হলো— পুল-ই-হেসার, দেহ সালাহ ও কাসান (বানু জেলা)।
আফগানিস্তানের বৃহত্তম বার্তাসংস্থা খামা প্রেস নিউজ এজেন্সি শুক্রবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুক্রবার এই তিন জেলায় দখলদার তালিবান বাহিনীর সঙ্গে সংঘাত হয়েছে বিরোধী জোটের যোদ্ধাদের। এতে নিহত হয়েছেন ৪০ তালেবান , আহত হয়েছেন আরও ১৫ জন।
দেশটির সাবেক সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বিসমিল্লাহ মোহাম্মদিও শুক্রবার এক টুইটে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। টুইটবার্তায় তিনি বলেন, ‘তালিবান সন্ত্রাসীদের প্রতিহত করা আমাদের দায়িত্ব। পুল-ই-হেসার, দেহ সালাহ ও বানু জেলা তালিবান দখলমুক্ত হয়েছে। বাঘলান প্রদেশের এই তিন জেলার নিয়ন্ত্রণ এখন বিরোধী জোটের হাতে। আমাদের সংগ্রাম জারি আছে।’
বর্তমানে আফগানিস্তানের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় এলাকা পঞ্জশির উপত্যকায় আত্মগোপনে আছেন বিসমিল্লাহ মোহাম্মদি। দেশটির সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালেহও আছেন একই অঞ্চলে।
প্রতিবারের মতো এবারও প্রথম ধাক্কাটা আসে পঞ্জশিরের কাছে। তালিবানরা গোটা আফগানিস্তান দখল করলেও পঞ্জশিরের মধ্যে দাঁত ফোটাতে পারেনি তারা। আর এবার সেই পথে হেঁটেই পঞ্জশিরের নিকটবর্তী তিন জেলাও তালিবান শাসন মুক্ত করা হয়েছে।
২০ বছর পর আফগানিস্তান দখল করার পর বিজয় উল্লাসে মেতে উঠেছিল তালিবানরা। আর তাদের সেই উল্লাস একটু হলেও থমকাল পাঁচ দিনের মাথায়। পঞ্জশিরের পর বাঘলান প্রদেশ। তালিবানদের উপর প্রত্যাঘাত বিরোধী জোটের। আর তার ফলে ওই প্রদেশের মোট তিন জেলা তালিবানদের দখলমুক্ত করল প্রতিরোধ বাহিনী।
একাধিক সংবাদ মাধ্যম সূত্রে জানা গিয়েছে, এই সংঘর্ষের ফলে নিহত হয়েছে একাধিক তালিবান যোদ্ধা। জখমও হয়েছে বেশ কয়েকজন। ইতিমধ্যেই এই সংঘর্ষের একাধিক ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।
পঞ্জশির প্রতিরোধ কী?
গত মে মাস থেকে আফগানিস্তান দখলের অভিযান শুরু করা তালিবান বাহিনী রাজধানী কাবুলসহ ইতোমধ্যে দেশের ৩৪ টি প্রদেশের ২৮ টি নিজেদের দখলে আনতে সক্ষম হয়েছে। যে অঞ্চলগুলো এখনও তালিবান কব্জা করতে পারেনি তার মধ্যে অন্যতম পঞ্জশির এলাকা।
তালিবানগোষ্ঠীর প্রধান বিরোধী শক্তি উত্তরাঞ্চলীয় জোটের ঘাঁটি এলাকা পঞ্জশির অবশ্য বরাবরই দখলমুক্ত ছিল। ১৯৯৬ সালে যখন প্রথম তালিবান বাহিনী সরকার গঠন করেছিল, তখনও নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছিল পঞ্জশির।
গোটা দেশের পতন হয়েছে তালিবানের সামনে। তবে প্রতিরোধ দেখা গিয়েছে সাধারণ আফগানের মধ্যে। অনেকেই বলছে সেই প্রতিরোধের সাহস আদতে জাগিয়ে তুলেছে পঞ্জশির প্রতিরোধ। তাজিকিস্তানে নিযুক্ত আফগান রাষ্ট্রদূত জাহির আঘবরের দাবি, তালিবানের বিরুদ্ধে শক্ত ঘাঁটি হয়ে উঠবে পঞ্জশির।
পঞ্জশিরের অর্থ পাঁচটি সিংহ। বলা বয় দশম শতকে এই প্রদেশে পাঁচ ভাই মিলে বন্যার জল ধরে রেখেছিল একটি বাঁধ তৈরি করে। সেখান থেকেই এই প্রদেশের নাম পঞ্জশির হয়। সুলতাম মাহমুদ গজনির জন্যে সেই বাঁধ তৈরি করা হয়েছিল বলে কথিত আছে। সেই পাঁচ ভাইয়ের সম্মানে এই প্রদেশের নাম পড়ে পঞ্জশির। এই এলাকাতে মোট এক লক্ষ মানুষের বাস। এই প্রদেশের অধিকাংশ মানুষ তাজিক। এই প্রদেশ প্রাকৃতিক একটি দুর্গ। চতুর্দিকে হিন্দুকুশের পর্বত। মাঝে একটুকরো সমতল। এই কারণেই তালিবান এই এাকায় এখনও ঢুকতে পারেনি।
গোটা দেশের পতন হয়েছে তালিবানের সামনে। তবে প্রতিরোধ দেখা গিয়েছে সাধারণ আফগানের মধ্যে। অনেকেই বলছে সেই প্রতিরোধের সাহস আদতে জাগিয়ে তুলেছে পঞ্জশির প্রতিরোধ। তাজিকিস্তানে নিযুক্ত আফগান রাষ্ট্রদূত জাহির আঘবরের দাবি, তালিবানের বিরুদ্ধে শক্ত ঘাঁটি হয়ে উঠবে পঞ্জশির।
১৯৯৬-এ যখন গোটা আফগানিস্তান প্রায় তালিবানদের দখলে, তখনও পঞ্জশিরে নিজেদের আধিপত্য ধরে রেখেছিলেন স্থানীয় নেতা আহমেদ শাহ মাসুদের বাহিনী। মাসুদকে বলা হত পঞ্জশিরের সিংহ। তালিবান ও আল-কায়দার বিরুদ্ধে বারবার গলা তোলায় ২০০১ সালে ওসামা বিন লাদেনের নির্দেশে আল-কায়দা জঙ্গিদের হাতে খুন হতে হয় তাকে। কিন্তু তার পরেও পঞ্জশির দখল করতে পারেনি তালিবান। বরং, মার্কিন সেনার সঙ্গে হাত মিলিয়ে আফগানিস্তানকে তালিবান মুক্ত করার কাজে হাত লাগিয়েছিল আহমেদ শাহ মাসুদের ছেলে আহমেদ মাসুদের বাহিনী।
সেই পঞ্জশিরই ফের আফগানিস্তানকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখাচ্ছে। এই পঞ্জশির প্রদেশেই রয়েছেন আফগানিস্তানের স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালেহর সঙ্গে হাত মিলিয়ে তালিবানদের রুখে দিয়েছে নর্দার্ন অ্যালায়েন্স। আফগানিস্তানের প্রায় ৯৮ শতাংশ দখল করে ফেললেও পঞ্জশিরে ফের আটকে গেল জঙ্গিরা। এমনকী, বুধবার পঞ্জশিরে নর্দার্ন অ্যালায়েন্সের পতাকাও উড়িয়েছে সালেহ-মাসুদ বাহিনী। বেরিয়েছে ব়্যালি। আর এই প্রতিরোধের আগুন ধিক ধিক করে জ্বলতে শুরু করেছে দেশের অন্যত্র।
পাল্টা কেয়ারটেকার সরকার ও আমরুল্লাহ সালেহ
গনি সরকারের ভাইস–প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালেহ পঞ্চশিরে বসেই আফগানিস্তানের কেয়ারটেকার সরকার গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। তার দাবি, তিনিই দেশের বৈধ ও সাংবিধানিক প্রেসিডেন্ট। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক ভিডিওতে দেখা গেছে, আমরুল্লাহর পাশে বসে আছেন গনি সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল বিসমিল্লাহ মোহাম্মদী ও মাসুদের ছেলে আহমেদ মাসুদ। নর্দান অ্যালায়েন্সকে আবার সংগঠিত করছেন আহমেদ মাসুদ। বাবার মৃত্যুর সময় যিনি ছিলেন এক বালক। যুদ্ধশাস্ত্র ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে লন্ডনে পড়াশোনা করেছেন। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতেও প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এক বছর। বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত মাসুদ ফাউন্ডশনের মাধ্যমে বড় ধরনের সামাজিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিয়েও প্রশংসিত তিনি।
কাবুল ছাড়ার আগে আমরুল্লাহ এক টুইট বার্তায় বলেছেন, ‘লাখ লাখ মানুষ যারা আমাকে বিশ্বাস করেন, তাদের আমি হতাশ করতে পারব না। আমি কখনোই তালিবানের সঙ্গে এক ছাদের নিচে থাকব না। আমার মাটি ও আমার আদর্শ মহান কমান্ডার আহমেদ শাহ মাসুদের স্মৃতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না।’
তার দুই দিন পর নিজেকে কেয়ারটেকার সরকারের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে আরেক টুইটে লেখেন, ‘আফগানিস্তানের সংবিধান অনুযায়ী দেশের প্রেসিডেন্ট মারা গেলে বা পদত্যাগ করলে অথবা তার অনুপস্থিতিতে ভাইস প্রেসিডেন্টই কেয়ারটেকার প্রেসিডেন্ট হন। আমি এখন দেশের ভেতরেই আছি, ফলে আমি আইনত কেয়ারটেকার প্রেসিডেন্ট।’
আবারও প্রতিরোধের কেন্দ্র হবে কি পঞ্চশির?
আগের তালিবানি শাসনের দুঃসহ স্মৃতি আফগানিস্তানের অনেকেই এখনো ভুলতে পারেননি। যার প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে কাবুলের বিমানবন্দরে ও পাকিস্তান সীমান্ত দিয়ে দেশ ছাড়ার জন্য হাজার হাজার আফগানের ঢল। এর মধ্যে ভয় কাটিয়ে উঠে তিন শহরে তালিবানবিরোধী বিক্ষোভ করেছে মানুষ। পূর্বাঞ্চলীয় শহর জালালাবাদে আফগান পতাকা সমুন্নত রাখতে গিয়ে তালিবান যোদ্ধার গুলিতে তিন বিক্ষোভকারী নিহতও হয়েছেন। তালিবানবিরোধী প্ল্যাকার্ড হাতে নারীদেরও দেখা গেছে রাস্তায়। ফলে তালিবান শাসন মানতে ইচ্ছুক নন জনগণের বিশাল একটি অংশ থেকেই যাবে আফগানিস্তানে। তাদের সঙ্গে পাওয়া যাবে কিছু জাতিগত যোদ্ধা বাহিনীকেও। বলা হচ্ছে, তালিবানবিরোধী যেকোনো পদক্ষেপের জন্য নৈতিক শক্তি হয়ে উঠতে পারে একমাত্র পঞ্চশির।
এর মধ্যে আমরুল্লাহকে সমর্থন জানিয়েছেন তাজিকিস্তানে আফগান রাষ্ট্রদূত ও সাবেক সামরিক কর্মকর্তা জহির আঘবর। সরকারপ্রধান হিসেবে আমরুল্লাহর ছবিও দূতাবাসে টাঙানো হয়েছে।
রয়টার্সকে এক সাক্ষাৎকারে আঘবর বলছেন, ‘পঞ্চশিরকে কেউ দখলে নিতে এলে সেখানকার মানুষ রুখে দাঁড়াবে। তালিবান বাহিনী যুদ্ধে জিতেছে এটি আমি বলতে চাই না। এটি শুধু সরকারপ্রধান হিসেবে আশরাফ গনির দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া। তালিবানের সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে তিনি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন।’
তবে যে মুহূর্তে তালিবান সরকারকে চীন, রাশিয়া, পাকিস্তান স্বীকৃতি দিতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছে, সেখানে আমরুল্লাহর কেয়ারটেকার সরকারের প্রতি এমন সমর্থন নস্যিই বলা চলে। যুক্তরাষ্ট্রও নতুন করে আফগানিস্তানে কোনো যুদ্ধে জড়াবে না, সেটি পরিষ্কার হয়ে গেছে। কিন্তু নর্দান অ্যালায়েন্সকে নিয়ে আমরুল্লাহর লড়াইয়ের যে মনোভাব দেখা যাচ্ছে, সহজে তিনি হাল ছেড়ে দেবেন না।
পঞ্চশিরের এক বাসিন্দার বক্তব্যেও সেই রেশ পাওয়া গেল, যিনি এএফপিকে বলছেন, ‘আমরা তালিবানকে পঞ্চশিরে প্রবেশ করতে দেব না। আমরা সর্বশক্তি এবং ক্ষমতা দিয়ে তাদের প্রতিরোধ করব এবং তাদের বিরুদ্ধে লড়ব।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৫৭
আপনার মতামত জানানঃ