দাসপ্রথা, বর্ণবাদ, যুদ্ধের থেকেও ভয়াবহ এক চেহারার আমেরিকার নাম ‘ইউজেনিক্স‘। এই বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব প্রয়োগ করে মানবজাতির উন্নয়ন আর সুস্থ-সবল ভবিষ্যত প্রজন্ম তৈরির নামে হাজার হাজার মানুষকে বন্ধ্যা করা হয়েছিল, এমনকি কেড়ে নেয়া হয় বহু লোকের প্রাণও। অথচ বিংশ শতাব্দীর শুরুতে এটি আমেরিকায় তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অব্দি এর প্রয়োগ এবং প্রচার চলছিল বহাল তবিয়তে।
স্যর ফ্রান্সিস গ্যালটন প্রবর্তিত ‘ইউজেনিক্স‘ শব্দটা এসেছে ল্যাটিন ‘ইউজেনেস’ থেকে, যার আক্ষরিক অর্থ— সুপ্রজাত। ইউজেনিক্সের মূল বিষয় হল, কোনও জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মগুলো থেকে যাবতীয় অনভিপ্রেত জিন দূর করা।
ইউজেনিক্স বা জাতিগত শুদ্ধিকরণে আলোচনা উঠলেই আমাদের মানসপটে ভেসে উঠে হিটলারের ইহুদি নিধনের কথা। অথচ আমেরিকার জোরপূর্বক বন্ধ্যাকরণ ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের ইউজেনিক্স নিয়ে কর্মকাণ্ডের ধারেকাছেও ছিল না। হিটলার বিশুদ্ধ আর্য জাতি নির্মাণে বিশ্বাসী ছিলেন। তার কাছে ইহুদি এবং ভবঘুরেরা ছিল নিকৃষ্ট। ১৯৩৪ সালে তার লেখা বই ‘মাইন ক্যাম্ফ’-এ ইউজেনিক্সের প্রয়োগ নিয়ে তার ধারণা প্রকাশ পায়। এর পরবর্তী ফলাফল ছিল ৬০ লক্ষ ইহুদি হত্যা।
হিটলারের জন্মের ছয় বছর আগেই জাতীগত শুদ্ধিকরণের এই ধারণার গোড়াপত্তন হয় ১৮৮৩ সালে ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবী, পলিম্যাথ স্যার ফ্রান্সিস গ্যাল্টনের হাত ধরে। যদিও ইউজেনিক্স সম্পর্কে প্রথম ধারণা দেন গ্রিক দার্শনিক প্লেটো। প্লেটোর তার বই ‘দ্য রিপাবলিক’-এ (খ্রিষ্টপূর্ব ৩৭৮) সমাজে উচ্চ বা সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারী-পুরুষের বিয়ের এবং তাদের সন্তান উৎপাদনের মাধ্যমে একটি যোগ্যতম সমাজ তৈরি করার কথা বলেন। এ প্রক্রিয়ায় কোনো পুরুষ কোন নারীকে বিয়ে করবে, তা সেই দেশের শাসকের ঠিক করে দিতে হবে।
‘ইউজেনিক্স’ এমন একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, যাতে একজন মানুষ তার জন্য নির্বাচিত নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সঙ্গীর সাথে প্রজনন ঘটিয়ে একটি সুস্থ সবল ভবিষ্যত প্রজন্ম তৈরি করবে। এর মাধ্যমে মানবসমাজ থেকে তথাকথিত নানা রোগ, প্রতিবন্ধকতা, মানসিক সমস্যা, খারাপ বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি দূর করা যাবে।
ইউজেনিক্সের প্রবক্তা এবং সমর্থকরা মনে করতেন, অপরাধ প্রবণতা, মানসিক রোগ, আভিজাত্য, ভদ্রতা, এমনকি দরিদ্রতা মানুষ তার বংশগতির ধারায় পেয়ে থাকে। তারা এটাও মনে করতেন, এসব বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মানুষের বংশবিস্তার রোধ করা গেলেই ভবিষ্যতের পৃথিবী সুন্দর করে গড়ে তোলা যাবে। তাই তারা কর্মপন্থা ঠিক করেন, যাতে করে ‘অযোগ্য’ মানুষরা বংশবিস্তার না করতে পারে। এর পরিপ্রেক্ষিতে নিষ্ক্রিয়করণ বা বন্ধ্যাকরণের মতো প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়।
গ্যাল্টন তার বই ‘ইনকোয়ারিস ইন্টু হিউম্যান ফ্যাকাল্টি অ্যান্ড ইটস ডেভেলপমেন্ট’-এর মাধ্যমে ইউজেনিক্সকে সবার সামনে নিয়ে আসার পরই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই ধারণা। আদতে, স্যার ফ্রান্সিস গ্যাল্টন ছিলেন চার্লস ডারউইনের কাজিন। তিনি ডারউইনের ‘সারভাইভাল অভ দ্য ফিটেস্ট’ বা ‘যোগ্যতমের জয়’ তত্ত্ব দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন।
ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবী সমাজে বেশ জনপ্রিয়তা পেলেও, গ্যাল্টন নিজের দেশ ব্রিটেনে সফল হননি। তবে বিশ শতকের শুরুতে এটি আমেরিকা জুড়ে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। হিটলারের জন্মের (১৮৮৯) সাত বছর পরই আমেরিকায় ইউজেনিক্সের উত্থান ঘটে ১৮৯৬ সালে, বিবাহ আইনের মাধ্যমে। সে বছর যারা মৃগীরোগী বা মানসিকভাবে অসুস্থ ছিল, তাদের বিয়ে এবং সন্তান গ্রহণ নিষিদ্ধ করা হয়।
পাশাপাশি আমেরিকায় বসবাস করা পরিবারগুলোর জিনগত বৈশিষ্ট্যের তালিকা তৈরি করে। তারা দুই ধরনের তালিকা করে। এর মধ্যে এক দল ‘ফিট’, আর অন্য দল ‘আনফিট’। এর মানে, একদল বংশ বিস্তারের যোগ্য এবং অন্য দল অযোগ্য। ইউজেনিক্সের সংজ্ঞামতে, কে ফিট আর কে ফিট নয়- তা জানার জন্য তারা নাগরিকদের জ্ঞান যাচাই, দেহের বিভিন্ন অঙ্গের আকার-আকৃতি আর মাপ সংগ্রহ করেছিল।
অযোগ্যের তালিকায় রাখা হয় কৃষ্ণাঙ্গ, সংখ্যালঘু, আদিবাসী এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে। একইসাথে তারা এটাও প্রমাণ করার চেষ্টা করছিল যে, তাদের এ দৃষ্টিভঙ্গি সামাজিক বা অর্থনৈতিকভাবে বর্ণবাদী না বা আগ্রাসী নয়। জিনগত কারণে মানুষের মধ্যে যে খারাপ বৈশিষ্ট্যগুলো তৈরি হয়েছে, তারা সেগুলোই কমানোর চেষ্টা করছে।
বিশ শতকের শুরুতে আমেরিকায় এশিয়া ও ইউরোপ থেকে অধিবাসীদের ঢল আসতে থাকলে, ইউজেনিক্স আন্দোলনের পরিধি বাড়তে থাকে। একে আরো জনপ্রিয় করতে সারা দেশে প্রোপাগান্ডা পোস্টার লাগানো হয়। কিছু পোস্টারের ভাষা ছিল এমন, “কিছু মানুষ অন্যের বোঝা হওয়ার জন্য জন্মায়”। আবার কিছু পোস্টারে একজন কৃষকের ছবি দিয়ে লেখা থাকত, “শুধুমাত্র স্বাস্থ্যবান বীজই বপন করতে হবে”।
১৯০৮ সালে ল্যুইসিয়ানা রাজ্যে আয়োজন করা হয় বেটার বেবি কনটেস্ট। যে দম্পতিদের সন্তান সবচেয়ে বেশি সুস্থ-সবল হতো, তাদের মধ্য থেকে প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় হিসেবে পুরস্কৃত করা হতো। এছাড়াও ১৯২০ সালে আয়োজন করা হয় ‘ফিটার ফ্যামিলিস’ নামক এক প্রতিযোগিতা। এটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগপর্যন্ত নিয়মিত আয়োজন করা হতো।
এরপর ১৯০৭ সালে ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্য ইউজেনিক্সের ভিত্তিতে বাধ্যতামূলক নিষ্ক্রিয়করণ বা বন্ধ্যাকরণ আইন পাশ করে। পরবর্তী সময়ে ইন্ডিয়ানার দেখানো পথে হাঁটে আরো ৩৩টি রাজ্য। ১৯২৭ সালে সুপ্রিম কোর্ট ঘোষণা করে, শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের বন্ধ্যাকরণ দেশের সংবিধান লঙ্ঘন করে না। শুধুমাত্র ক্যার্লিফোর্নিয়া মানসিক রোগ নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে ১৯০৯ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত বিশ হাজার মানুষকে বন্ধ্যা করা হয়।
১৯৩০ সালে পুয়ের্তোরিকোর গভর্নর দেশ থেকে দারিদ্র্য দূরীকরণের মাধ্যমে অর্থনীতি চাঙ্গা করার যুক্তি দেখিয়ে সেখানকার হাজার হাজার নারীকে জোরপূর্বক বন্ধ্যা করেন। ১৯৭৬ সালের গভর্নমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যাবিলিটি অফিসের তদন্তমতে, ১৯৭০-৭৬ সাল পর্যন্ত ২৫-৫০ শতাংশ নেটিভ আমেরিকান বন্ধ্যাকরণের শিকার হয়েছেন। তাদের কোনোরূপ সম্মতি ছাড়াই এ কাজ করা হয়।
অবশেষে হিটলারের হাত ধরে ২য় বিশ্বযুদ্ধে ইউজেনিক্সের ভয়াবহ প্রয়োগের ফলে যুদ্ধপরবর্তী সময়ে এই আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়ে। তবে অনুমতি ছাড়া বন্ধ্যাকরণের সাথে জড়িত তেমন কেউই শাস্তি পায়নি। কিছু কিছু অঙ্গরাজ্য ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে ব্যবস্থা করেছিল।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৯৩২
আপনার মতামত জানানঃ