কট্টরপন্থি তালিবানের শাসনে কেমন হবে আফগানিস্তান, তা নিয়ে দেশটির নাগরিকদের পাশাপাশি পুরো বিশ্বে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়েছে। বিশেষ করে নারী অধিকার, জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষকতা, ভিন্নমত চর্চা ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে তালিবান এতদিন খুবই নির্মম নীতি অবলম্বন করেছে। তবে এবার ভোল পাল্টাতে শুরু করেছেন দলটির নেতারা।
আফগানিস্তানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দু’দিন পর কাবুলে গুরুত্বপূর্ণ এক সংবাদ সম্মেলনে কট্টরপন্থা পরিহারের ঘোষণা দিয়েছেন তালিবানের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ। তবে ইসলামী শরিয়াহ অনুযায়ী দেশ পরিচালনার কথা বলেছেন তিনি। নারীদের কাজ ও শিক্ষার কথা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, সন্ত্রাসীদের আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করতে না দেওয়ার কথাও বলেছেন। তবে তাদের এই বক্তব্য দেশে-বিদেশে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে বলে মনে হয় না।
বাস্তবে শরিয়া আইনে দেশটির শাসন কেমন হবে সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু এখনও জানায়নি ইসলামি এই গোষ্ঠী।
সর্বশেষ তারা যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন খুন এবং ব্যভিচারের দায়ে অভিযুক্তদের প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ডের মতো শাস্তি প্রবর্তন অথবা সমর্থন করেছিল। ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরের শাসনামলে শরিয়াহ আইন কায়েমের নামে আফগান নারীদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল তারা।
এবার মসনদে বসার আগে নিজেদের কিছুটা উদার দেখানোর চেষ্টা করছে তালিবান।
কাতারের রাজধানী দোহায় সংবাদমাধ্যম স্কাই নিউজকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তালিবানের অন্যতম মুখপাত্র সুহাইল শাহিন জানান, ক্ষমতা দখলের পর এবার নারীদের বোরকা পরা বাধ্যতামূলক করবে না তারা। তবে মাথা ঢাকতে পারে এমন হিজাব পরতে হবে।
ওই সাক্ষাৎকারে সুহাইল আরও জানান, আফগান নারীরা প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষায় পর্যন্ত অংশ নিতে পারবেন।
নারী অধিকার প্রশ্নে তালিবানের এমন অবস্থান গোষ্ঠীটির ইতিবাচক পরিবর্তন হিসেবে দেখছেন অনেকে। কেউ বলছেন মিথ্যা আশ্বাস।
কাবুলে আরেক সংবাদ সম্মেলনে গোষ্ঠীটির আরেক মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদিন দাবি করেছেন, ২০ বছরে অনেক বদলে গেছে তালিবান। আফগানিস্তানের নারীদের অধিকার নিশ্চিত করার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। তবে এটি শরিয়াহ আইন অনুযায়ী করা হবে বলেও পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন জাবিহুল্লাহ।
শরীয়া আইন বলতে কী বুঝায়?
শরিয়া আইন হলো ইসলামের আইনি ব্যবস্থা। পবিত্র কোরআন এবং হাদিসের বিধান ও ইসলামি পণ্ডিতদের দেওয়া ফতোয়ার সমন্বয়ে শরিয়া আইন প্রবর্তিত হয়।
এটা এসেছে ইসলাম ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ কোরআন এবং সুন্নাহ ও হাদীস থেকে, যেগুলো এসেছে ইসলামের নবী কাজ এবং বক্তব্য থেকে।
যেসব বিষয়ে এখান থেকে সরাসরি কোন উত্তর পাওয়া যায় না, তেমন কোন বিষয় বা প্রশ্নে ধর্মীয় পণ্ডিতরা নির্দেশনা হিসেবে বিধিবিধান দিতে পারেন।
শরীয়া হলো জীবনাচরণের সেই পদ্ধতি যা সব মুসলমানকে মেনে চলতে হয়— যার মধ্যে রয়েছে নামাজ, রোজা কিংবা যাকাতের মতো বিষয়গুলোও। মুসলমানরা কিভাবে আল্লাহর ইচ্ছা তাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পালন করবে, সেটি বুঝতে সহায়তা করে এই শরীয়া।
শরিয়া আইনে অপরাধের সাজা কী?
শরিয়া আইনে অপরাধ সাধারণত দুই শ্রেণিতে বিভক্ত। হাদ অপরাধ এবং তাজির অপরাধ। হাদ অপরাধ হচ্ছে গুরুতর অপরাধ। যার শাস্তি পবিত্র কোরআনে নির্ধারিত আছে। আর তাজির অপরাধ হচ্ছে সেসব অপরাধ যার কথা কোরআনে বলা নেই এবং সাক্ষীর অভাবে এই অপরাধের সাজা বিচারকের বিবেচনার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়।
হাদ অপরাধের মধ্যে আছে চুরি। এই অভিযোগ প্রমাণিত হলে অপরাধীর হাত কেটে ফেলার মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করা হয়। এছাড়া ব্যভিচারও এই শ্রেণির অপরাধের অন্তর্ভুক্ত; যার সাজা জনসম্মুখে পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে মৃত্যু নিশ্চিত করা।
জাতিসংঘ পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে কথা বলেছে। সংস্থাটি বলেছে, ‘এটি নির্যাতন বা অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ বা শাস্তি। এভাবে কাউকে সাজাপ্রদান স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ করা উচিত।’
তবে হাদ অপরাধের জন্য বিশ্বের সব মুসলিম দেশ এ ধরনের সাজা কার্যকর বা মেনে চলে না। বিভিন্ন সময়ে চালানো জরিপে এ ধরনের অপরাধের জন্য কঠোর শাস্তি নিয়ে মুসলমানদের মনোভাবে বদল দেখা যায়।
ধর্মান্তরের জন্য মুসলিমদের মৃত্যুদণ্ড হতে পারে?
ধর্ম অথবা বিশ্বাস ত্যাগ ইসলাম ধর্মে গুরুতর অপরাধ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসলামি বেশিরভাগ পণ্ডিত বিশ্বাস করেন, এটি মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ।
কিন্তু অল্প কিছু মুসলিম চিন্তাবিদ, বিশেষ করে যারা পশ্চিমা সমাজে বসবাস করেন, তারা যুক্তি দেন যে, ‘আধুনিক বিশ্বের বাস্তবতায় শাস্তি সৃষ্টিকর্তার ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। ধর্মত্যাগের কারণে ইসলাম ধর্ম হুমকিতে নেই। পবিত্র কোরআনেও ধর্ম নিয়ে জোর জবরদস্তি না করার কথা বলা হয়েছে।’
শরীয়া আইনে সিদ্ধান্ত কীভাবে নেয়া হয়?
অন্য যেকোন আইনী পদ্ধতির মতো শরীয়াও জটিল এবং এর চর্চা পুরোপুরি নির্ভর করে বিশেষজ্ঞের যোগ্যতা ও প্রশিক্ষণের ওপর। ইসলামী বিচারকরা নির্দেশনা ও বিধান দিয়ে থাকেন। যেসব নির্দেশনা আইনীভাবে আনুষ্ঠানিক হিসেবে গণ্য করা হয়, সেগুলোকে বলা হয় ‘ফতোয়া’।
শরীয়া আইনের পাঁচটি পৃথক ধারা রয়েছে। সুন্নীদের জন্য রয়েছে চারটি ডকট্রিন বা মাযহাব— হানবালি, মালিকি, শাফিই ও হানাফি। অন্যদিকে শিয়া ডকট্রিন হলো একটি— শিয়া জাফারি।
শরীয়া আইনের উৎপত্তি যেখান থেকে, সেগুলোর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এই পাঁচ মাযহাবের মধ্যে মতদ্বৈততা আছে।
তালিবান যেভাবে শরিয়াহ আইন প্রয়োগ করেছিল
আগের শাসনামলে শরিয়াহ আইনের কঠোর প্রয়োগের কারণে তালিবান কুখ্যাত হয়ে রয়েছে। ১৯৯৬-২০০১ সালের শাসনামলে গোষ্ঠীটি আফগানিস্তানে প্রকাশ্যে পাথর ছুঁড়ে হত্যা, অঙ্গচ্ছেদ এবং ফাঁসি দেয়ার শাস্তি কার্যকর করেছিল।
আগের শাসনামলে শরিয়াহ আইনের কঠোর প্রয়োগের কারণে তালিবান কুখ্যাত হয়ে রয়েছে। ১৯৯৬-২০০১ সালের শাসনামলে গোষ্ঠীটি আফগানিস্তানে প্রকাশ্যে পাথর ছুঁড়ে হত্যা, অঙ্গচ্ছেদ এবং ফাঁসি দেয়ার শাস্তি কার্যকর করেছিল।
সশস্ত্র এই গোষ্ঠীটি ক্ষমতা দখলের পর গান ও বাদ্যযন্ত্র নিষিদ্ধ করেছিল। শুধু ‘দাফ’ নামে একধরনের বাদ্যযন্ত্রের অনুমোদন ছিল, যেটি প্রকাশ্যে হাত কাটা ও পাথর ছুঁড়ে হত্যার মতো শাস্তি কার্যকরের সময় বাজানো হতো।
শরিয়াহ আইন বাস্তবায়নের অজুহাতে তালিবানরা জীবন্ত কোনো কিছুর প্রতিনিধিত্ব করে এমন চিত্রকর্ম, আলোকচিত্র ও চলচ্চিত্র নিষিদ্ধ করেছিল।
তালিবানের ওই শাসনামলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন আফগানিস্তানের নারীরা। ওই সময় আক্ষরিক অর্থেই তাদের গৃহবন্দি জীবন কাটাতে হতো। নারীদের কাজের বা শিক্ষার কোনো সুযোগ ছিল না। আট বছর বয়স থেকেই কন্যাশিশুদের বোরকা পরতে হতো। ঘরের বাইরে যেতে হলে সঙ্গে থাকতে হতো ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বৈধ কোনো পুরুষ সঙ্গী।
একতলা বাড়িগুলোর জানালা তক্তা মেরে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। বহুতল ভবনের ক্ষেত্রে নারীরা ব্যালকনিতেও যেতে পারতেন না।
নারী প্রশ্নে গণমাধ্যমের ওপরেও কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছিল তালিবান। সংবাদপত্রে বা ম্যাগাজিনে নারীদের ছবি ছাপানো নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এ ছাড়া রেডিও, টেলিভিশন বা জনসমাগমে নারীদের উপস্থিতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল।
নারীদের যারা তালিবানের আইন অমান্য করতেন বা পুরুষ সঙ্গী ছাড়াই বাইরে আসতেন, তাদের রাস্তায় প্রকাশ্যে বেত্রাঘাত করত গোষ্ঠীটি।
তালিবানে ‘বিশ্বাস নেই’ আফগান নারীদের
তালিবান এবার কিছুটা নমনীয় হলেও আশ্বস্ত হতে পারছেন না আফগান নারীরা। গোষ্ঠীটি কাবুল দখল নেয়ার পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্দেশে খোলা চিঠি দিয়েছেন আফগানিস্তানের চলচ্চিত্র নির্মাতা সাহরা কারিমি। দেশটির নারীদের রক্ষা করার আকুতি ঝরেছে তার ওই চিঠিতে।
কারিমি চিঠিতে লিখেছেন, ‘তারা নারী অধিকার ছিনিয়ে নেবে। আমাদের নিজ ঘরে ছায়া হয়ে থাকতে হবে। আমার কণ্ঠস্বর, আমাদের প্রকাশভঙ্গিকে তারা চেপে ধরবে। তালিবান যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন স্কুলে কোনো মেয়ে ছিল না। তাদের যাওয়ার পর ৯০ লাখ আফগান মেয়ে এখন স্কুলে পড়ছে। এই কয়েক সপ্তাহে তারা অসংখ্য স্কুল ধ্বংস করে দিয়েছে ও ২০ লাখ শিশু স্কুল ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে।
নিজ দেশে চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে আমি যে পরিশ্রম করেছি তার সবকিছুই এখন হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কায়। তালিবানরা ক্ষমতায় এলে শিল্পকে নিষিদ্ধ করে দেবে। আমি ও অন্য নির্মাতারা তাদের হিটলিস্টে চলে আসব।’
নারীদের অধিকার নিশ্চিতের বিষয়ে তালিবানের প্রতিশ্রুতির দিনই যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমসে কলাম লিখেছেন নোবেলজয়ী পাকিস্তানি মানবাধিকারকর্মী মালালা ইউসুফজাই।
‘আই ফিয়ার ফর মাই আফগান সিস্টারস’ শিরোনামের কলামে তিনি লিখেছেন, ‘কিছু তালিবান বলছে তারা নারীদের শিক্ষা ও কাজের অধিকারকে খর্ব করবে না। তবে নারীদের ওপর তালিবানের নিপীড়নের ইতিহাস বলে, আফগান নারীদের ভয় পাওয়াটা কাল্পনিক কিছু নয়। আমরা ইতোমধ্যে এমন খবর শুনছি যে, নারী শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে দেয়া হচ্ছে না। অনেক নারীকে কাজে যোগ দিতে বাধা দেয়া হয়েছে।’
এখনও দেরি হয়ে যায়নি উল্লেখ করে আফগান নারীদের অধিকার রক্ষায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন মালালা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫০০
আপনার মতামত জানানঃ