‘উইচ হান্ট’ বা ডাইনি নিধনের শুরু হয় সে মধ্যযুগ থেকে, কিংবা তারও আগে। ইউরোপে ডাইনি-নিধনের উৎপত্তি খ্রিস্টপূর্ব ৪৫১-এ। এরপর ১৪ শতক থেকে বাড়তে থাকা এ ব্যাধি প্রশমিত হয় ১৮ শতকের শেষভাগে। আর ততদিনে ঝরে গেছে হাজারো প্রাণ। কুসংস্কারাচ্ছন্ন উগ্র দুর্বৃত্তদের আক্রোশের শিকার এ মানুষগুলোর সিংহভাগই নারী। রয়েছে পুরুষ আর শিশুও। এরপর ইউরোপ এই বর্বরতা থেকে বের হয়ে আসতে পারলেও, আফ্রিকাসহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে, এমনকি পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে উইচ হান্ট বা ডাইনি নিধন নামে এখনও চলছে মধ্যযুগীয় বর্বরতা।
খ্রিস্টপূর্ব ৩৩১-এ রোমে মহামারি দেখা দিলে একসঙ্গে ১৭০ জন মহিলাকে ‘ডাইনি’ সন্দেহে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তার প্রায় দুই সহস্রাব্দ পরে, ১৪৫০ থেকে ১৭৫০ সালের মধ্যে রোম, ফ্রান্স, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলিতে এবং মধ্য, পশ্চিম ও দক্ষিণ ইউরোপ মিলিয়ে মোট পঁয়ত্রিশ হাজারেরও বেশি মানুষকে অনুরূপ কারণে হত্যা করা হয়।
পঞ্চদশ শতকের বিপ্লবী ও সুযোদ্ধা মাত্র উনিশ বছর বয়সী জোন অব আর্ককেও ডাইনি অপবাদ দিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল। ফরাসি এই বীর যোদ্ধা ১৪২৯ সালে ইংরেজ সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন৷ তার কারণে ফ্রান্স-ইংল্যান্ডের শতবর্ষের যুদ্ধের অবসান ঘটে৷ ফ্রান্সের স্বাধীনতার পর জোয়ান অফ আর্ককে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে আটক করা হয়৷ ইংরেজ যাজকের অধীনে তার বিচার শুরু হয় এবং তাকে ডাইনি অ্যাখ্যা দিয়ে ১৪৩১ খ্রিষ্টাব্দে পুড়িয়ে মারা হয়৷
তবে এই সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে। ডয়েচে ভেলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউরোপে তিনশ বছরে অন্তত ৩০ লাখ মানুষকে ডাইনি হিসেবে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছিলো। আর হত্যা করা হয়েছিল ৬০ হাজার মানুষকে; যার প্রায় অধিকাংশই নারী।
প্রাথমিক মধ্যযুগে গির্জা সরাসরি ডাইনি বিচারে যেত না। যদিও এসব বিচার গির্জার আদর্শ থেকেই এসেছে। ৭৮৫ সালে চার্চ অব প্যাডেরবর্ন ডাকিনীবিদ্যা নিষিদ্ধ করে। পোপ জন (XXII) ডাকিনীবিদ্যা দমনমূলক নীতি গ্রহণ করে ১৩২০ সালে। তদন্তকারী আদালত এ বিচারে জড়িত হয় ১৫ শতকে।
প্রাথমিক আধুনিক ইউরোপে ডাইনি বিচার শুরু হয় ভালোভাবেই। ১৫ শতকে ও ১৬ শতকে প্রাথমিক ডাইনি বিচার শুরু হয়। তারপর মানুষের ডাইনি ভীতি কমে গেলে বিচার কমে যায়। পরে আবার ১৭ শতকে এটা তুমুলভাবে শুরু হয়। খ্রিস্টান সমাজ ও সেক্যুলার প্রতিষ্ঠানগুলো মনে করত ডাকিনীবিদ্যা নগ্ননৃত্য, অরজি সেক্স ও মানুষের মাংস খাওয়া নিয়ে পালিত শয়তানী ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সাথে ভালভাবে জড়িত।
জার্মানিতে ডাইনি শিকার শুরু হয় অনেক আগে। দক্ষিণ-পশ্চিম জার্মানীতে ডাইনি শিকারের সফল বছর ছিল ১৫৬১ থেকে ১৬৭০ সাল। জার্মানিতে ১৪৫০ থেকে ১৭৫০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মানুষকে ডাইনি অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল৷ তবে ডাইনি হিসেবে অভিযুক্তদের বেশিরভাগই নারী৷
ডাইনিদের বিরুদ্ধে বিচার হত আশ্চর্য এক ‘বৈধ’ আইনি পদ্ধতিতে৷ একজন নারী ডাইনি কিনা তা বিচার করা হত নিষ্ঠুরতম এক পরীক্ষার মাধ্যমে৷ এটাকে বলা হত ‘সাঁতার পরীক্ষা’৷ অভিযুক্তকে দড়ি দিয়ে বেঁধে পানিতে ফেলে দেয়া হত৷ যারা ডুবে যেতো তারা নিরপরাধ বলে প্রমাণিত হত৷ আর যারা বাঁধন খুলে সাঁতরে উঠে আসতো তাদের ডাইনি বলা হত, কারণ ধারণা করা হত, তারা শয়তানের সাহায্যে এটা করতে পেরেছে৷
অভিযুক্ত প্রত্যেককে তথাকথিত জিজ্ঞাসাবাদের মধ্য দিয়ে যেতে হত৷ বলা বাহুল্য এই জিজ্ঞাসাবাদ প্রক্রিয়া ছিলো নির্যাতনের মাধ্যমে দোষ স্বীকারে বাধ্য করা৷ ১৪৮৬ সালে ডোমিনিকান সন্ন্যাসী হাইনরিশ ক্রেমার ‘হ্যামার অফ হুইচেস’ নামে এক বই প্রকাশ করেন৷ এই বইটিতে ডাইনিদের নির্যাতনের কত ধরনের প্রক্রিয়া হতে পারে তার বর্ণনা এবং আইনি প্রক্রিয়ার পূর্ণ ব্যাখ্যা রয়েছে৷ সপ্তদশ শতাব্দীর পর এটি ছাপানো বন্ধ হয়ে যায়৷
১৫৫০ সালে ইংলিশ চ্যানেলের দ্বীপ গুয়ের্নসে অনেক ডাইনির বিচার হয়৷ সেসময় প্রোটেস্টেন্ট এবং ক্যাথলিকদের মধ্যে ব্যাপক দ্বন্দ্ব চলছিল৷ ১৫৫৬ সালে তিনজন প্রোটেস্টেন্ট নারীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয় সেখানে৷ এর মধ্যে একজন নারী জ্বলন্ত অবস্থায় এক শিশুর জন্ম দিয়েছিলেন৷ সেসময় নারীটিকে উদ্ধার করা হয়৷ তবে পরে আবারও তাকে আগুনে নিক্ষেপ করা হয়৷ বর্তমানে সেই তিন নারী ‘গুয়ের্নসের শহীদ’ হিসেবে খ্যাত।
মূলত ডাইনি শব্দের ইংরেজি উইচ শব্দটি এসেছে উইকা থেকে। এর অর্থ হল যিনি নিগূঢ় জ্ঞান অর্জন করেছেন। পেগান ধর্মের উপাসক নারী পুরুষদের উইকা বলা হত। পেগান ধর্মের এই জ্ঞানী উপাসকদের কাজ-কারবার খ্রিস্টান জগত সহ্য করতে পারত না।
উইকানরা বিশ্বাস করতেন যে, গুহ্য জ্ঞান বংশপরম্পরায় সঞ্চারিত হয়। এরা জাদু মন্ত্র করে মানুষের রোগ-বালাই সারিয়ে তুলত। এই তন্ত্রমন্ত্রই খ্রিস্টানদের কাছে কুসংস্কার ছিল। তাই ইউরোপের মানুষ উইকান নারীদের ভয় পেতে লাগল। চার্চ ভাবতে লাগল যে, শয়তানের কাছ থেকে এরা গুপ্ত বিদ্যা রপ্ত করেছে। এমনকি এদের ভেষজ লতাপাতার জ্ঞানও চার্চের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করত কেবল প্রার্থনায়। উইকানদের ম্যাজিক এবং প্রকৃতি উপাসনাকে চার্চ সন্দেহের চোখে দেখত।
১৫৬৪ সাল্ব স্কটিশ উইচক্র্যাফট অ্যাক্ট জারি করা হয়। এই আইনে চিকিৎসার জন্য যারা উইকানদের কাছে যাবে ধর্মের কাছে তারা উইকানদের সমান অপরাধী। পঞ্চদশ শতক থেকে চার্চের সিদ্ধান্তে উইকান নরনারীদের ডাইনি আখ্যায়িত করে তাদের হত্যা করা শুরু হয়। সন্দেহজনক উইকান নারীকে অভিযুক্ত করে তার বিচার হত এবং বিচারক মৃত্যুদণ্ড হিসেবে পুড়িয়ে মারার আদেশ দিত। এছাড়া ডাইনি নিধনে ব্যবহৃত হত আরেকটি যন্ত্র। এটি একটি তীক্ষ্ম যন্ত্র যা তার বুকে বিঁধিয়ে দেওয়া হত।
উইকান নরনারীরা ছিল ইউরোপের প্রাচীন পেগান সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। পেগানদের উপাসনা পদ্ধতি ছিল খ্রিস্টান ধর্ম বিরোধী। ডাইনি হত্যার পেছনে এটি অন্যতম কারণ হলেও একমাত্র কারণ ছিল না।
গবেষকরা দেখিয়েছেন যে, ব্যক্তিগত শত্রুতা, বয়স্কা একাকিনীকে সরিয়ে তার সম্পত্তি দখলের গোপন অভিপ্রায়, ডাইনি অপবাদ দিয়ে অর্থ আদায়ের লোভ, অজানা রোগ, মড়ক বা ফসল না হওয়ার দায় কারোর উপর চাপিয়ে দিয়ে মানসিক শান্তি লাভ কিংবা মানসিক রোগ জাতীয় অদ্ভূত আচরণকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধ্যান ধারণা দিয়ে ব্যাখ্যা করা- এসবই ছিল ডাইনি হত্যার পশ্চাদে কারণ।
নারীবাদী তাত্ত্বিকরা অবশ্য মনে করেন, উইকান নারীরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছিল কারণ তারা পারিবারিক গন্ডিবদ্ধ জীবন থেকে সরে এসেছিল। তাই পুরুষতেন্ত্রর কর্তারা তাদের শেষ করে দেবার চক্রান্ত করেছিল।
ডাইনি নিধনের বর্বরতার শিকার নারীদের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা যায় যে, তাদের অধিকাংশই ছিলেন কিছুটা স্বাধীনচেতা স্বভাবের, প্রতিবাদী কিংবা ঝগড়াটে। তাই বিশেষজ্ঞরা ডাইনি নিধনকে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের একটি দিক হিসেবেও দেখছেন। নারীকে সবসময় দুর্বল ভাবা এবং অবদমিত করে রাখার মানসিকতাই তাদের গলার স্বর উঁচু হতে দেয় না। ব্যতিক্রম হলে পুরুষের অহমে আঘাত করে যা ডাইনি নিধনের তথ্য উপাত্তে প্রমাণিত হয়।
নির্যাতনের পর বেঁচে যাওয়া অনেক নারী বলেছেন যে তাদেরকে ডাইনি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় নানাবিধ কারণে। গ্রামে কোনো নবজাতকের মৃত্যু, মহামারীর আগমন, গৃহপালিত পশু মৃত্যু, এমনকি আবহাওয়া খারাপ হলেও অনেক সময় এই চিহ্নিত ‘ডাইনি’দের দোষী করা হয়। তবে ঘটনার গভীরে গেলে আরো ভয়ানক তথ্য মেলে।
অনেক নারীকেই ডাইনি আখ্যা দেয়ার ভয় দেখিয়ে নিয়মিত অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে গ্রামের প্রভাবশালী শ্রেণী। আবার অনেক নারীকে তার ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করার জন্যই দেয়া হয় এরকম অমূলক পরিচিতি। ডাইনি হিসেবে হত্যা করা নারীদের বেশির ভাগই বিধবা, বয়োঃবৃদ্ধ কিংবা পরিবার ছেড়ে একাকী বাস করা নারী।
নৃতাত্ত্বিকবিদ মার্ভিন হ্যারিস অবশ্য ডাইনি নিধনের উৎপত্তির ক্ষেত্রে এই বক্তব্য অস্বীকার করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন ক্ষমতাভোগী চার্চ ও জমিদারদের অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে যে কৃষক বিদ্রোহের আবহাওয়া ১৩ শতক থেকে ঘনিয়ে উঠেছিল সেই দিক থেকে মানুষের মূল লক্ষ্যকে ঘুরিয়ে দেবার চক্রান্ত ছিল এই ডাইনি নিধন।
ধারণা করা হতো, অষ্টাদশ শতকেই বিশ্বে ডাইনি নিধনের বর্বরতা সমাপ্ত হয়েছে। কিন্তু ৩৬টি দেশে এখনো ডাইনি শিকার অব্যাহত আছে বলে জানিয়েছে ক্যাথলিক মিশনারি সোসাইটি মিসিও৷ জার্মান ইতিহাসবিদ ভল্ফগাং বেহরিঙ্গেরের মতে, ওই তিনশ বছরে ডাইনি সন্দেহে যত মানুষ হত্যা করা হয়েছে, তা চেয়ে বেশি হত্যা করা হয়েছে আধুনিক সভ্য যুগে৷ বিশেষ করে আফ্রিকায়৷
১৯৯৯ সালে বিবিসির প্রতিবেদনে দেখা যায় যে কঙ্গোতে শিশুদের ডাইনি সন্দেহ করে হচ্ছে ও তাঞ্জানিয়াতে ডাইনি সন্দেহে বয়স্ক মহিলাদের মারা হচ্ছে যদি তাদের চোখ লাল হয়। ডাইনি শিকার করে আফ্রিকাতে মূলত করে ডাইনির আত্নীয় স্বজনরা তার সম্পত্তির লোভে।
২০০৯ সালে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে যেখানে উল্লেখ করা হয় যে কেবল গাম্বিয়াতেই প্রায় হাজারখানেক নারীকে ডাইনি অপবাদ দিয়ে হত্যা করে হয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়াতে ভারত আর নেপালে এই ঘৃণ্য অপরাধ ঘটছে নিয়মিতই। ২০০০ সালের পর থেকে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ২৫০০ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে ডাইনি নিধনের নামে! ২০১৬-১৭ সালে কেবল উড়াষ্যাতেই ৯৯টি এবং রাজস্থানে ১২৭টি ডাইনি নিধনের অভিযোগ দাখিল হয়েছে পুলিশের খাতায়। এই আধুনিক সভ্য সমাজেও মধ্যযুগীয় এই বর্বরতা সমাজের ঘাড়ে চেপে বসে আছে বহাল তবিয়তে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৭০০
আপনার মতামত জানানঃ