ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় আসামে গরু জবাই, মাংস খাওয়া ও পরিবহন নিয়ন্ত্রণে একটি বিল পাস করেছে রাজ্য সরকার। বিধানসভায় স্পিকার বিশ্বজিৎ দাইমারি শুক্রবার আসাম গরু সংরক্ষণ বিল, ২০২১ পাস হয়েছে বলে ঘোষণা দেন। বিদ্যমান আসাম গরু সংরক্ষণ আইন, ১৯৫০-এর পরিবর্তে কার্যকর হবে নতুন বিলটি। তবে একসময় গরুর মাংস রপ্তানিতে শীর্ষ ছিল ভারত। ২০১৭ থেকে নিচে নামতে থাকে ভারতের রপ্তানির সূচক। তবু ২০১৯ সালে গরুর মাংস রপ্তানিতে দ্বিতীয় শীর্ষ দেশ ছিল এই ভারত। তাই গরু জবাই ও মাংস খাওয়ার ওপর ভারতের এই নিষেধাজ্ঞা যে পুরোটাই দেশটিতে বসবাসরত মুসলিমদের ওপর নিপীড়নের এক হাতিয়ার, তা নিয়ে বিতর্কের সুযোগ নেই। উল্লেখ্য, ভারতের সবচেয়ে বড় এবং আধুনিক কসাইখানার মালিকও হিন্দুরা।
গরু জবাই, এমনকি মাংস খাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা
বিলটি পাসের ফলে আসামের কোনো মন্দির বা মঠের পাঁচ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে গরু জবাই, মাংস বিক্রি বা খাওয়া যাবে না। এক জেলা থেকে অন্য জেলায় গরু পরিবহনও সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
বিলটিতে গরু জবাইয়ের আগে সরকারের অনুমতি নেয়া এবং শুধু নিবন্ধিত কসাইখানায় জবাইয়ের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। তবে কোনো নির্দিষ্ট কমিটির কাছে না পাঠিয়েই বিলটি পাসের প্রতিবাদে অধিবেশন বর্জন করেন বিরোধীদলীয় আইনপ্রণেতারা।
রাজ্য মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত শর্মা বিশ্বাসের মতে, নতুন বিলটির মাধ্যমে গোমাংসকেন্দ্রিক সাম্প্রদায়িক সংঘাত নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘১৯৫০ সালে তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের গৃহীত আইনটির আধুনিকায়ন করা হয়েছে নতুন বিলে। ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর চিন্তা আর সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদের প্রতিফলন রয়েছে এতে।’
প্রসঙ্গত, ভারতীয় সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদে রাজ্য আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কৃষি ও পশুপালনের উন্নতির চেষ্টা করবে বলা হয়েছে। তাদের উন্নতির জন্য গরু, বাছুর এবং অন্যান্য দুধের পশুর হত্যা রোধ করার জন্য রাজ্য বিশেষভাবে আইন প্রণয়ন করবে। যদিও ওই অনুচ্ছেদে কোনো রাজ্যকে এ সংক্রান্ত আইন তৈরি করার জন্য কোনো বাধ্যবাধকতা রাখা হয়নি। সংবিধানের ওই অনুচ্ছেদ অনুসরণ করে কিছু রাজ্যে গবাদিপশু হত্যা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু কয়েকটি রাজ্যে গরু জবাইয়ের ক্ষেত্রে কোনো বিধিনিষেধ নেই।
মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত শর্মা বলেন, ‘গত পাঁচ বছর বা তার আগেও রাজ্যে যত সাম্প্রদায়িক সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে, সবগুলোরই কারণ ছিল গোমাংস। নতুন বিলের ফলে গোমাংস না খাওয়া ব্যক্তিদের পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো ব্যক্তি গোমাংস না খেলে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বেরও কোনো সুযোগ নেই।’
হিমন্ত শর্মা জানান, উত্তর প্রদেশে গরুর মাংস খাওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু আসামের মোট জনগোষ্ঠীর ৩৬ শতাংশ গোমাংস পছন্দ করে বলে বিক্রি পুরোপুরি নিষিদ্ধ না করে শুধু নিয়ন্ত্রণে এনেছে সরকার।
রাজ্য সরকারের কাছ থেকে অনুমতি সাপেক্ষে আসাম থেকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য রাজ্যে গরু পরিবহন করা যাবে বলেও জানান মুখ্যমন্ত্রী।
বিলটি পাসের ফলে রাজ্যের কোনো মন্দির বা মঠের পাঁচ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে গরু জবাই, মাংস বিক্রি বা খাওয়া যাবে না। হিন্দু, জৈন, শিখসহ ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে গরুর মাংস না খাওয়া যেকোনো সম্প্রদায়ের বসবাসের এলাকা ও ধর্মীয় উপাসনালয়ের ক্ষেত্রে এ নীতি প্রযোজ্য হবে।
এক জেলা থেকে অন্য জেলায় গরু পরিবহনও সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে নতুন আইনে। কৃষিকাজের কারণে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় গরু স্থানান্তরের দরকার হলে আগে প্রশাসনের অনুমতি নিতে হবে, পরিবহনের সময় সঙ্গে থাকতে হবে অনুমতিপত্র।
পাস করা এই বিলে নিষিদ্ধ করা হয়েছে বাছুর থেকে শুরু করে ১৪ বছরের কম বয়সী গরু জবাই। বিলটিতে পুরুষ ও স্ত্রী ষাঁড় ও মহিষ, গরু, গাভী, বাছুর, বকনা বাছুর ইত্যাদিকে গরু হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।
ভারতের রাজস্থান আর মধ্য প্রদেশের গরুর মাংস জবাই আইন করে নিষিদ্ধ হয়েছে আগেই। এছাড়া দেশটির উত্তর প্রদেশের যোগী আদিত্যনাথ সরকার গত বছর গরু জবাই করলে ১০ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রেখে নতুন আইন জারি করে। এ জন্য রাজ্য মন্ত্রিসভায় গো-হত্যা প্রতিরোধ (সংশোধিত) অধ্যাদেশ-২০২০ নামের নতুন এক আইন পাস করা হয়।
মন্ত্রিসভায় গৃহীত গো-হত্যা প্রতিরোধ (সংশোধিত) অধ্যাদেশ-২০২০ অনুযায়ী, রাজ্যে কেউ গরু জবাই করলে ১০ বছর কারাদণ্ড এবং ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। অন্যদিকে, কেউ যদি গবাদিপশুর অঙ্গহানি করে তার জন্য সাত বছরের কারাদণ্ড এবং তিন লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রয়েছে। যোগী সরকার রাজ্যে গরু জবাই সম্পূর্ণ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে এই আইন করেছে। প্রদেশটিতে ৪ কোটিরও বেশি মুসলিম বাস করে। এই আইনের ফলে তাদের খাদ্যাভাস ও জীবনযাত্রায় বদল আসবে।
ভারতে মোট ১২ টি রাজ্য রয়েছে, যেখানে গরু জবাইয়ের উপরে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ১০ টি এমন রাজ্য রয়েছে যেখানে অবশ্য নিষেধাজ্ঞা নেই। একইসাথে, এমন ৭ টি রাজ্য রয়েছে যেখানে গরু জবাইয়ের উপরে আংশিক নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
উত্তর-পূর্ব ভারতের অরুণাচল প্রদেশ, মিজোরাম, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, সিকিম এবং ত্রিপুরায় গরু জবাইয়ের বিরুদ্ধে কোনো আইন নেই। মণিপুরে গরু জবাইয়ে আংশিক নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। মণিপুরে আইন বলছে যে, কাউকে যদি গরু হত্যা করতে দেখা যায় তবে তার শাস্তি হতে পারে। কিন্তু মণিপুরে প্রকাশ্যে গরুর মাংস বিক্রি হয়।
তবে পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা, লাক্ষাদ্বীপ, অরুণাচল প্রদেশ, মিজোরাম, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, সিকিম এবং ত্রিপুরায় গরু জবাইয়ের উপর কোনো বিধিনিষেধ নেই।
গরুর মাংস রপ্তানিতে শীর্ষে ছিল ভারত
২০১৭ সালে ভারত ১.৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন গো মাংস রপ্তানি করেছিল৷ তার তুলনায় ২০১৯ সালে সেই রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১.৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন৷ এই তালিকার এক নম্বর দেশ ব্রাজিল৷ তারা ২.২ মিলিয়ন মেট্রিক টন মাংস রপ্তানি করেছে৷ ২০১৭ সালেও ভারতই গরুর মাংস রপ্তানিতে দ্বিতীয় ছিল।
২০১৭ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংস্থা কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রফতানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত দেশের ৭৪ কসাইখানার মধ্যে ১০টির মালিক হিন্দু। এমনকি ভারতের সবচেয়ে বড় এবং আধুনিক কসাইখানার মালিকও হিন্দুরা।
দেশের সবচেয়ে বড় কসাইখানা তেলেঙ্গানার মেডক জেলার রুদ্রম গ্রামে অবস্থিত। কমপক্ষে ৪০০ একরজুড়ে থাকা ওই কসাইখানার মালিক সতীশ সভারওয়াল। এটি ‘আল কবীর এক্সপোর্টস প্রাইভেট লিমিটেড’ চালিয়ে থাকে। ভারতের মুম্বাইয়ের নরিম্যান পয়েন্টে অবস্থিত সদর দফতর থেকে তারা মধ্য-পূর্বের কয়েকটি দেশে গবাদি পশুর গোশত রফতানী করে।
‘আল কবীর’-এর দফতর দুবাই, আবুধাবি, কুয়েত, জেদ্দা, দাম্মাম, মদিনা, মাসকট, দোহা এবং অন্যত্র রয়েছে। সংস্থাটি ২০১৬ সালে কমপক্ষে ৬৫০ কোটি টাকার ব্যবসা করেছে।
‘অ্যারাবিয়ান এক্সপোর্টস প্রাইভেট লিমিটেড’-এর মালিক সুনীল কাপুর। এদের সদর দফতর ভারতের মুম্বাইতে। সংস্থাটি বিফের (গরুর গোশত) পাশাপাশি ভেড়ার গোশতও রফতানী করে। এর পরিচালক বোর্ডে বিরনত নাগনাথ কুডমুলে, বিকাশ মারুতি শিন্দে এবং অশোক নারং রয়েছে।
‘এমকেআর ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টারস প্রাইভেট লিমিটডে’-এর মালিক মদন অ্যাবট। অ্যাবট কোল্ড স্টোরেজ প্রাইভেট লিমিটেডের কসাইখানা রয়েছে পাঞ্জাবের মোহালি জেলায়। এর পরিচালক সানি অ্যাবট। ‘আল নূর এক্সপোর্টস’-র মালিক সুনীল সুদ। কোম্পানিটির দফতর ভারতের দিল্লিতে। কিন্তু এর কসাইখানা এবং গোশত প্রক্রিয়াকরণ প্ল্যান্ট রয়েছে উত্তরপ্রদেশের মুজাফফরনগরের শেরনগর গ্রামে। এছাড়া মীরাট এবং মুম্বাইতেও তাদের প্ল্যান্ট রয়েছে। সংস্থাটির অন্য অংশীদার হলো অজয় সুদ। সংস্থাটি ১৯৯২ সালে তৈরি হয় এবং তারা ৩৫টি দেশে ‘গরুর গোশত’ রফতানী করে থাকে।
‘এওভি এক্সপোর্টস প্রাইভেট লিমিটেড’র কসাইখানার অবস্থান উত্তরপ্রদেশের উন্নাউতে। এদের গোশত প্রক্রিয়াকরণ প্ল্যান্ট রয়েছে। এর পরিচালক ওপি অরোরা। সংস্থাটি ২০০১ সাল থেকে কাজ করছে। তারা মূলত গরুর গোশত রফতানি করে থাকে। কোম্পানির সদর দফতর নয়ডাতে। এওভি এগ্রো ফুডসের পরিচালক হলো অভিষেক অরোরা।
‘স্ট্যান্ডার্ড ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টস প্রাইভেট লিমিটেড’-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর কমল ভার্মা। কোম্পানিটির কসাইখানা এবং প্ল্যান্ট উত্তর প্রদেশের উন্নাউতে অবস্থিত। ‘পোন্নে প্রোডাক্টস এক্সপোর্টস’-এর পরিচালক এস স্বস্তি কুমার। এদের গরুর গোশতসহ মুরগির গোশত এবং ডিমের ব্যবসাও আছে। এদের প্ল্যান্ট রয়েছে তামিলনাড়ুতে।
‘অশ্বিনী এগ্রো এক্সপোর্টস’-এর কসাইখানা রয়েছে তামিলনাড়ুর গান্ধীনগরে। কোম্পানিটির পরিচালক কে রাজেন্দ্রন। তার মতে, ‘ধর্ম নিতান্তই ব্যক্তিগত বিষয়। ব্যবসার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক থাকা উচিত নয়।’ মহারাষ্ট্র ফুড প্রসেসিং অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজের হলেন সানি খাট্টার। সেও মনে করে, ‘ধর্ম এবং ব্যবসা ভিন্ন জিনিস। দুটোকে মিশিয়ে ফেলা ঠিক নয়।’
সানি খাট্টার বলেছে, ‘আমি হিন্দু এবং গরুর গোশত ব্যবসা করি তাতে কী হয়েছে? এই ব্যবসা করে কেউ খারাপ হিন্দু হয়নি।’ কোম্পানিটির কসাইখানা মহারাষ্ট্রে অবস্থিত।
এসব ছাড়াও হিন্দুদের এমন কোম্পানি রয়েছে যারা গরুর গোশত রফতানী ক্ষেত্রে রয়েছে। এদের কসাইখানা না থাকলেও এরা গোশত প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে প্যাকেজিং করে তা রফতানী করে। কনক ট্রেডার্স এরকমই একটি প্রতিষ্ঠান। এর মালিক রাজেশ স্বামী বলেছে, ‘এই ব্যবসায়ে হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে কোনো বৈষম্য নেই। দুই ধর্মের মানুষজন একসঙ্গে কাজ করে থাকে। এতে কেউ হিন্দু হলেও তা কোনো ব্যাপার নয়।’
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৪৩৪
আপনার মতামত জানানঃ