ভারতে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা প্রকাশিত সরকারি সংখ্যার তুলনায় ১০ গুণ বেশি হতে পারে। নতুন এক গবেষণা প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, করোনাভাইরাসে মৃত্যু সরকারি হিসাবে সোয়া চার লাখের কাছাকাছি বললেও প্রাণহানির প্রকৃত সংখ্যা ৩৪ লাখের বেশি। নতুন গবেষণা প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে টার্কিশ রেডিও অ্যান্ড টেলিভিশনের (টিআরটি) প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়।
এতে উল্লেখ করা হয়, শঙ্কা বাস্তব হলে করোনায় বিশ্বের সবচেয়ে বিপর্যস্ত দেশ নিঃসন্দেহে ভারত। মহামারির প্রকৃত চিত্র নিয়ে সরকারের রাখঢাক ও গোপনীয়তা রক্ষার প্রবণতা আর ভঙ্গুর স্বাস্থ্যব্যবস্থার ফলে দেশটির পরিস্থিতি ভয়াবহ।
মহামারিকালে আগের বছরের তুলনায় অতিরিক্ত মৃত্যুর তথ্য প্রকাশ করেনি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। বিশ্বের বৃহৎ অর্থনীতিগুলোর বেশিরভাগই এ তথ্য প্রকাশ করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্টের গবেষকরা করোনায় মৃত্যুর প্রকৃত চিত্র উদঘাটনে তথ্যের তিনটি উৎসের দ্বারস্থ হন। তথ্যের বিশদ বিশ্লেষণ করে তারা জানিয়েছেন, ভারতে সরকারি হিসাবের সঙ্গে প্রকৃত প্রাণহানির পার্থক্য ভয়াবহ।
প্রথম হিসাবেই গত মাস পর্যন্ত দেড় বছরে ভারতে করোনায় মৃত্যু সরকারি হিসাবের চেয়ে ৩০ লাখ বেশি।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় হিসাবে এ পার্থক্য আরও বেশি। এই দুই হিসাবে দেশটিতে করোনায় প্রাণহানি যথাক্রমে ৪০ লাখ ও ৪৯ লাখ; যা সরকারি তথ্যের প্রায় ১০ ও ১২ গুণ।
তবে এসব হিসাবেও কিছু ত্রুটি আছে বলে স্বীকার করেছেন গবেষকরা। শেষ পর্যন্ত করোনায় প্রাণহানির প্রকৃত সংখ্যা অজানাই থেকে যেতে পারে বলেও উদ্বেগ জানিয়েছেন তারা।
১৩৩ কোটি জনসংখ্যার দেশটিতে করোনায় মৃত্যুর সঠিক সংখ্যা যে সরকারি হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি, এ ধারণা দিন দিন জোরালো হচ্ছে নানা কারণে। গত কয়েক মাসে বিহার, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশসহ ভারতের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ ও দরিদ্র বেশ কয়েকটি রাজ্য করোনায় মৃত্যুর সংশোধিত তালিকা প্রকাশ করেছে।
এর আগে উত্তর প্রদেশে গঙ্গার তীরে হাজারো মানুষের কবর শনাক্তের ঘটনায় করোনায় তাদের মৃত্যু কি না, তা নিয়ে তোলপাড় হয় দেশজুড়ে। অক্সিজেনের হাহাকার, হাসপাতালে শয্যা সংকটে চিকিৎসা ছাড়াই মানুষের মৃত্যুর কারণে মহামারির দ্বিতীয় ধাক্কাজুড়ে বিশ্ব গণমাধ্যমে আলোচনার শীর্ষে ছিল ভারত।
কিন্তু গবেষকরা বলছেন, দেশটিতে মহামারির প্রথম ধাক্কা ছিল আরও বেশি প্রাণঘাতী।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘দ্বিতীয় ধাক্কার মতো মহামারির প্রথম ধাক্কা আকস্মিক ও একমুখী ছিল না; বরং প্রথম দফায় অনেক সময় নিয়ে ও বিস্তৃত পরিসরে করোনার সংক্রমণ বেড়েছে। সেটির স্থায়িত্বও দীর্ঘ ছিল।’
নতুন গবেষণার ফল সঠিক হলে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর মহামারিতে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি দেখছে ভারত।
ভারতে মহামারির প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতি উদঘাটনে কয়েক মাস ধরে কাজ করছেন সংবাদকর্মী, শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানীরা। করোনার ভয়াবহতার চিত্র দেশটির শ্মশান ও সমাধিক্ষেত্রগুলোতে জায়গা সংকটে স্পষ্ট।
উপসর্গ থাকা সত্ত্বেও করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা ও চিকিৎসায় অনেকের মধ্যে অনীহা; চিকিৎসা ব্যয়ের কারণে ঋণে জর্জরিত হওয়ার ভয়ে গুরুতর অসুস্থ অনেকের হাসপাতালে ভর্তি না হয়ে বাড়িতেই থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে ভারতীয় চিকিৎসকদের বেশ কয়েকটি সংগঠন।
দ্রুত বিস্তারের ফলে করোনার রূপ পরিবর্তিত ও অতি সংক্রামক অসংখ্য ভ্যারিয়েন্ট দেশজুড়ে ছড়িয়েছে বলে চলতি বছরের মার্চে সরকারকে সতর্ক করে বিজ্ঞানবিষয়ক উপদেষ্টাদের একটি ফোরাম। সে সতর্কবার্তা আমলে নেয়নি বলে সে সময় ভীষণ তোপের মুখেও পড়ে ভারত সরকার।
এদিকে ভারতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ বিপর্যস্ত শেষে কিছুটা নমনীয় হলেও আবারও তেলেবেগুনে জ্বলে উঠছে। ভারতে দৈনিক সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় গত তিন দিন ধরে সক্রিয় রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। গত কয়েকদিনে বেড়ে তা ৪ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। দেশটিতে এখন সক্রিয় রোগী রয়েছেন ৪ লাখ ৮ হাজার ৯২০ জন।
টানা চতুর্থ দিনের মতো ভারতে সংক্রমণ ৪০ হাজারের বেশি শনাক্ত হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশটিতে নতুন করে আক্রান্ত হয়েছে ৪১ হাজার ৬৪৯ জন। এ নিয়ে ভারতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৩ কোটি ১৬ লাখ ১৩ হাজার ৯৯৩। দেশটিতে নতুন সংক্রমণের অধিকাংশই কেরালা রাজ্যে। গত ২৪ ঘণ্টায় ওই রাজ্যে আক্রান্ত হয়েছে ২০ হাজার ৭৭২ জন।
তবে অন্যান্য রাজ্যে নতুন সংক্রমন ১০ হাজারের নিচে নেমে এসেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় মহারাষ্ট্রে আক্রান্তের সংখ্যা ৬ হাজার ৬০০, অন্ধ্রপ্রদেশে দু’হাজারের বেশি। কর্নাটক এবং তামিলনাড়ুতে দৈনিক সংক্রমণ দু’হাজারের কম। ওড়িশায় দেড় হাজার এবং আসামে হাজারের আশপাশে। এছাড়া দেশটির বাকি সব রাজ্যেই সংক্রমণ হাজারের নিচে নেমেছে।
তবে উত্তর-পূর্ব ভারতের কয়েকটি রাজ্যে অবশ্য গত কয়েকদিনে পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ভারতে করোনা সংক্রমণে মৃত্যু হয়েছে ৫৯৩ জনের। এখন পর্যন্ত দেশটিতে প্রাণ হারিয়েছেন সরকারি হিসাবে ৪ লাখ ২৩ হাজার ৮১০ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় মহারাষ্ট্রে মারা গেছে দুইশ’র বেশি, কেরালায় শতাধিক এবং ওড়িশায় অর্ধশতাধিক। বাকি সব রাজ্যে তা ৫০-এর কম।
তবে ইতোমধ্যেই ৪৬ কোটির বেশি মানুষকে ভ্যাকসিন দিয়ে নতুন মাইলফলক তৈরি করেছে ভারত। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশটিতে ৫২ লাখের বেশি মানুষকে ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছে।
এদিকে, ভারতে করোনার সংক্রমণ রোধে সব আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বাতিলের সময়সীমা আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। শুক্রবার দেশটির বিমান পরিবহন নিয়ন্ত্রক সংস্থা ডিরেক্টর জেনারেল অব সিভিল এভিয়েশন (ডিজিসিএ) এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানিয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪২৯
আপনার মতামত জানানঃ