দূরদর্শী পরিকল্পনা ছাড়া শত শত কোটি টাকা ব্যয় করে তৈরী করা ফেরিঘাট বারবার এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। ফেরিঘাট এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তর করতে খরচ হয় ১০০ কোটি টাকারও বেশি। সেখানে এক বছরের কম সময়ের ব্যবধানে স্থানান্তরিত ফেরিঘাটকে আবারও স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে।
অনলাইন সংবাদ মাধ্যম বাংলা ট্রিবিউন থেকে জানা যায়, দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগের অন্যতম প্রধান নৌপথ শিমুলিয়া-বাংলাবাজার। আট মাস আগেই ২০২০ এর নভেম্বরে কাঁঠালবাড়ি ঘাটটি স্থানান্তর করে বাংলাবাজার ঘাটে স্থাপন করা হয়েছিল। গুরুত্বপূর্ণ এই নৌপথের শিমুলিয়া ঘাট অথবা বাংলাবাজার ঘাটটি পুনরায় স্থানান্তরের সুপারিশ করেছে বিআইডব্লিউটিসি কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটি। পদ্মা সেতুর নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে ঘাট স্থানান্তরের সুপারিশ করেছে কমিটি।
বিভিন্ন সূত্রের তথ্যমতে, মাদরারিপুরের কাঁঠালবাড়ি ঘাটটি বাংলাবাজারে স্থানান্তর করতে সরকারের ব্যয় হয়েছিল প্রায় ১২৫ কোটি টাকা। ঘাট স্থানান্তরের ব্যয় বহন করা হয়েছিল পদ্মা সেতু প্রকল্পের নদীশাসন কাজের বরাদ্দ থেকে। ঘাট স্থানান্তর হলে সরকারের শতকোটি টাকা অপচয় হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা।
ঘাটটি ইতিমধ্যে ৩ বার স্থানান্তরিত হয়ে ৪র্থ বারের সিদ্ধান্ত চলছে
জানা গেছে, ১৯৮৬ সালে দক্ষিণাঞ্চলে চলাচলকারী যাত্রীদের জন্য চালু হয় মাওয়া-কাওড়াকান্দি নৌপথ। প্রথমে কাওড়াকান্দির নাম ছিল চরজানাজাত ফেরিঘাট। পরে কাওড়াকান্দি নামকরণ হয়। পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার সময় মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের মাওয়া থেকে সড়ক পথের আড়াই কিলোমিটার দূরে শিমুলিয়ায় বর্তমান শিমুলিয়া ঘাট স্থাপন করা হয় ২০১৪ সালের ২৭ নভেম্বর। মাওয়া থেকে ঘাট স্থানান্তরের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল ১০৫ কোটি টাকা। এখনও পদ্মা নদীর উত্তর প্রান্তের ফেরিঘাটটি শিমুলিয়া ঘাটেই রয়েছে।
তবে ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়ক নির্মাণের পর সড়ক পথের সুবিধা পেতে দক্ষিণ প্রান্তের ফেরিঘাট কাওড়াকান্দি থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় কাঁঠালবাড়ি ইউনিয়নের কাঁঠালবাড়ি এলাকায়। কিন্তু কাঁঠালবাড়ি ফেরিঘাট সাড়ে তিন বছরের মাথায় আবার স্থানান্তর করা হয়। পদ্মা সেতুর নদীশাসন কাজের জন্য শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি নৌপথের কাঁঠালবাড়ি ঘাটটি মাদারীপুরের বাংলাবাজারে স্থানান্তর করা হয় ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর। এতে ব্যয় হয় প্রায় ১২৫ কোটি টাকা। আট মাসের মাথায় পদ্মা সেতুর নিরাপত্তার অজুহাতে আবারও ফেরিঘাট স্থানান্তরের সুপারিশ করেছে বিআইডব্লিউটিসি। এতে সরকারের শতকোটি টাকা জলে যাবে।
গত ২৩ জুলাই সকালে পদ্মা সেতুর ১৭ নম্বর পিলারে রো রো ফেরি শাহজালাল ধাক্কা দিলে বিআইডব্লিউটিসির গঠিত তদন্ত কমিটি ফেরিঘাট স্থানান্তরের সুপারিশ করে। সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে ফেরিঘাট স্থানান্তরে পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালককে চিঠি দেয় বিআইডব্লিউটিসি।
ঘাট স্থানান্তর করাকে প্রকৌশলীরাও অযৌক্তিক বলছেন
অন্যদিকে, পদ্মা সেতুর কাজ প্রায় শেষের দিকে। গত ৩০ জুনের প্রগ্রেসিভ রিপোর্ট অনুসারে মূল সেতুর বাস্তব কাজের অগ্রগতি ৯৪ শতাংশ। আগামী বছর জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে পদ্মা সেতু উদ্বোধন করে যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা। তবু অল্প কয়েক দিনের জন্য শতকোটি টাকা খরচ করে আবার ঘাট স্থানান্তরের সুপারিশ সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের কাছে অযৌক্তিক মনে হচ্ছে।
পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী (নদীশাসন) মো. শরফুল ইসলাম সরকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পদ্মা সেতু প্রকল্পে সেতুর দক্ষিণ প্রান্তে মোট ১২ কিলোমিটার নদীশাসনের কাজ হবে। গত বছর পর্যন্ত ৮ কিলোমিটার কাজ সম্পন্ন হয়েছিল। মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি এলাকায় তিন কিলোমিটার নদীশাসন কাজ বাকি ছিল। উজানে আরও এক কিলোমিটার কাজ চলমান ছিল। সেসময় নদীশাসন কাজ সময়মতো করার জন্য কাঁঠালবাড়ি থেকে ঘাট সরিয়ে বাংলাবাজার নেওয়া হয়। পদ্মা সেতু প্রকল্পের নদীশাসন কাজের বরাদ্দের অর্থ থেকে বিআইডব্লিউটিএ-কে ৪৩ কোটি, নদীশাসন কাজের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রো করপোরেশনকে ৫২ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া, সংযোগ সড়কের জন্য আরও ২০ কোটি টাকা ও আনুষঙ্গিক খরচসহ ১২৫ কোটি টাকা খরচ হয় বাংলাবাজার ঘাট স্থাপন করতে।’
তিনি আরও বলেন, ‘২০১৪ সালে মাওয়া ঘাট সরিয়ে শিমুলিয়ায় স্থাপন করতে কমপক্ষে ১০৫ কোটি টাকা খরচ হয়েছিল। বিআইডব্লিউটিএ থেকে ওই টাকার বরাদ্দ হয়েছিল। বারবার ঘাট স্থানান্তর করলে সরকারি টাকার অপচয়- এটি অস্বীকার করা যাবে না।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নতুন করে ফেরিঘাট সরাতে পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষ কোনও স্থান দেবে না প্রকল্প এলাকায়। এমনকি এর আগে বাংলাবাজার ঘাট স্থাপনে পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে অর্থ বরাদ্দ দিলেও এবার তাও নাকচ করে দিয়েছে সেতু কর্তৃপক্ষ।
পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা আগেও বলেছি- পদ্মা সেতুর কাছে ফেরি কোনও বিষয় নয়। কাজেই পদ্মা সেতুর নিরাপত্তার কথা বলে তারা যদি ঘাট স্থানান্তরের কথা বলে; তবে সেটি সেতুর প্রকল্পের বাইরের যেকোনও স্থানে করতে পারে। সেতু এলাকায় নতুন করে ঘাট করতে দেওয়া হবে না। ঘাট স্থানান্তরের জন্য কোনও অর্থও খরচ করবো না আমরা। এ বিষয়ে আমরা বিআইডব্লিউটিসির যে চিঠি পেয়েছিলাম, তার উত্তর দিয়েছি।’
এ ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান সৈয়দ মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘তদন্ত কমিটি একটি সুপারিশ করেছে। সে পরিপ্রেক্ষিতে আমি পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষকে একটি চিঠি দিয়েছি। ঘাট স্থানান্তরের বিষয়টি কমিটির সুপারিশ। আমি আগেও বলেছি, ঘাট সরানো অযৌক্তিক। এত কোটি টাকা খরচ করে ঘাট সরানো ঠিক হবে না।’
এসডব্লিউ/বিটি/ডব্লিউজেএ/১৮৩৫
আপনার মতামত জানানঃ