বাংলাদেশের কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা শিবিরে পাহাড়ধসে ও পানিতে ভেসে ছয় রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, নিহতদের অনেকেই শিশু। এর মধ্যে বালুখালী ক্যাম্প-১০-এ পাহাড়ধসে মারা গেছে পাঁচজন। এ ঘটনায় আরও অনেকে আহত হয়েছে। আর পালংখালী ক্যাম্প-১৮-তে পানিতে ভেসে গেছে এক রোহিঙ্গা শিশু।
অথচ প্রতিবছর এই মৌসুমে পাহাড় ধসে মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও প্রশাসনের দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি। ফাইল বন্দি সব পরিকল্পনা, ঝুঁকিতে থাকাদের সংখ্যা না জানলেও, মৃতদের হিসাব রাখতে ভুল করে না।
নিহতরা হলেন বালুখালী ১০ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের জি-৩৭ ব্লকের নুর মোহাম্মদের মেয়ে নুর নাহার (৩০), শাহা আলমের ছেলে শফিউল আলম (১২), জি-৩৮ ব্লকের ইউসুফের স্ত্রী দিল বাহার (২৪) ও তাদের দুই সন্তান আব্দুর রহমান (৪) ও আয়েশা সিদ্দিকা (২) এবং পালংখালী ক্যাম্প-১৮-এ পানিতে ভেসে দিল বাহার নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
আজ মঙ্গলবার দুপুরে জেলার উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের ১০ নম্বর ও ১৮ নম্বর শরণার্থী শিবিরে তারা হতাহত হন বলে অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ শামসুদ্দোজা জানান।
শামসুদ্দোজা বলেন, দুপুরে ভারী বৃষ্টি হলে পাহাড়ের ঢালের নিচে ১০ নম্বর শিবিরের দুই-তিনটি বসতির ওপর মাটি পড়ে। মাটিচাপায় শিশুসহ পাঁচ রোহিঙ্গা শরণার্থী ঘটনাস্থলে নিহত হন। আহত হন বেশ কয়েকজন।
একই সময় বৃষ্টিতে পাহাড়ি ঢলের স্রোতে ভেসে যায় ১৮ নম্বর শিবিরে এক শিশু এবং পরে তার লাশ মেলে বলে জানান শামসুদ্দোজা।
তিনি বলেন, পাহাড় ধসে আরও কিছু মানুষ আহত হয়েছে। তবে তাদের বর্তমান অবস্থা ও সঠিক সংখ্যা নিশ্চিত করে বলতে পারেননি এই কর্মকর্তা। জানা যায়, বিকেল নাগাদ সেখানে উদ্ধার অভিযান চলছিল। ওই এলাকায় ভারী বর্ষণ অব্যাহত আছে।
আজ মঙ্গলবার ভোর থেকে টানা বর্ষণের কারণে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি রোহিঙ্গা শিবিরের ৮টি ক্যাম্পের অন্তত কয়েকশ বসতঘর পানির নিচে তলিয়ে গেছে। টানা বৃষ্টির কারণে পাহাড়ি ঢলে এসব বসতির রোহিঙ্গারা পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
প্লাবিত হওয়া ক্যাম্পগুলো হলো- কুতুপালং ক্যাম্প-৫, বালুখালী ১ নং ক্যাম্প, টেকনাফের ২৬ নং ক্যাম্প, জামতলী ক্যাম্প, হাকিমপাড়া ২৪ নং ক্যাম্প, ২৭ নং ক্যাম্প ও মধুছড়া ক্যাম্প।
কুতুপালং ক্যাম্প-৫ এর জি-৪ ব্লকের হেড মাঝি শওকত উল্লাহ বলেন, ভোর থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। এ কারণে ক্যাম্পের বিভিন্ন ব্লকের রোহিঙ্গারা পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পাহাড়ি ঢলের কারণে পানি বাড়ছে।
কক্সবাজার আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ মো. আব্দুর রহমান বলেন, লঘুচাপের কারণে সাগরে জোয়ারের পানি ৩-৪ সেন্টিমিটার উচ্চতায় প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ১১৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, উখিয়া-টেকনাফ সড়কের পাশে বালুখালি এলাকায় রাস্তার পাশে সারি সারি পাহাড় রয়েছে। ওইসব পাহাড়েই গড়ে উঠেছে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির। পাহাড়ের গায়ে বাঁশ ও পলিথিন দিয়ে তৈরি অস্থায়ী ঘরে কয়েক বছর ধরে এখানে বসবাস করছে লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজারে পাহাড় ধস রোধে নেই টেকসই কোনো ব্যবস্থাপনা বা পরিকল্পনা। ফলে প্রতিবছরই পাহাড় ধস বা পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। বর্ষা এলে এই আতঙ্ক বেড়ে যায়।
কক্সবাজার বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জেলায় মোট বনভূমির পরিমাণ ৭৩ হাজার ৩৫৮ হেক্টর। এরমধ্যে অবৈধ দখলে রয়েছে ৯ হাজার ৬৫৭ হেক্টর বনভূমি। পাহাড়ি জমিতেই বসবাস করছে ১৩ হাজার ৮২৬টি পরিবারের তিন লাখ মানুষ। তারা পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে রয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের অগাস্ট মাসে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতনের মুখে লাখ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় গ্রহণ করে। সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে এখন ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে, যাদের বেশিরভাগই কক্সবাজারের নানা ক্যাম্পে বসবাস করে।
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের সঙ্গে কয়েক দফা আলোচনা করা হলেও এখনও প্রত্যাবাসন শুরু করা যায়নি। তবে কক্সবাজার থেকে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে নোয়াখালীর ভাসানচরে নির্মিত আশ্রয়কেন্দ্রে সম্প্রতি স্থানান্তর করা হয়েছে।
এদিকে পাহাড় ধসের ঝুঁকি সত্ত্বেও প্রশাসনের তেমন কোনো হেলদোল নেই। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. আবু সুফিয়ান বলেন, কক্সবাজার পৌরসভার অভ্যন্তরে ৬টি ওয়ার্ডে সবচেয়ে বেশি মানুষ ঝুঁকিতে বাস করছে। তাদের সরিয়ে আনাটা একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। তারপরও ঝুঁকি এড়াতে কর্মপরিকল্পনা নিয়েছে জেলা প্রশাসন।
তিনি আরও বলেন, চলমান সময়ে কি পরিমাণ মানুষ ঝুঁকিতে বাস করছে তার সঠিক কোন তালিকা তৈরি করা যায়নি। এদিকে, ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারের তালিকা তৈরিতে দায়িত্বপ্রাপ্তদের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বৃষ্টি শুরু হলে প্রতিবছর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কিন্তু বর্ষা শেষ হওয়ার আগেই তা কাগজে কলমে ফাইল বন্দি থাকে। যার ফলে ঝুঁকিতে থাকাদের সরিয়ে নেওয়া তো দূরের কথা, উল্টো পাহাড় কেটে বসতি নির্মাণ বৃদ্ধি পায়। তবে, যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তা চলমান রেখে কাজ শেষ করা গেলে পাহাড় ধসের মৃত্যু এড়ানো সম্ভব।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ বলেন, অতীতে কি হয়েছে সেটি বলতে পারবো না। আমি কাজ করতে চাই। তালিকা সম্পন্ন হলে ঝুঁকিতে থাকা মানুষকে সরানো হবেই। কেউ না যেতে চাইলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাও নেয়া হবে। তবে, যেকোন প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবিলায় ফায়ার সার্ভিস, রেড ক্রিসেন্টসহ নানা সংস্থাকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। প্রয়োজনে সহযোগিতা নেয়া হবে সেনাবাহিনীরও।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৭৩৫
আপনার মতামত জানানঃ