আফগানিস্তানের পর এবার ইরাক থেকেও প্রত্যাহার করে নেয়া হবে মার্কিন সেনাদের। চলতি বছরের শেষ নাগাদ ইরাক থেকে যুদ্ধসেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তবে ইরাক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের এই সেনা প্রত্যাহারের ফলে অঞ্চলটির শক্তিধর দেশ ইরান লাভবান হবে কি না, তা এখন বিশেষজ্ঞদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। ইরাকে মার্কিন সেনাদের উপস্থিতি নিয়ে সে দেশে জোর বিতর্ক রয়েছে। বিশেষ করে ইরান-সমর্থিত রাজনীতিক ও মিলিশিয়ারা চান, ইরাক থেকে সব মার্কিন সেনা দ্রুত চলে যাক।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্র সফররত ইরাকি প্রধানমন্ত্রী মুস্তাফা আল-খাদেমির সঙ্গে হোয়াইট হাউসে বৈঠকের পর বাইডেন এই ঘোষণা দেন। পাশাপাশি মার্কিন পত্রিকা ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে দেওয়া সাক্ষাৎকারেও এ বিষয় নিশ্চিত করেন ইরাকের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফুয়াদ হোসেন।
ইরাকে মার্কিন সেনা কেন?
ইরাকে অবস্থানরত মার্কিন সেনারা দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রশিক্ষণ, পরামর্শ ও সামরিক সহায়তা দিচ্ছেন। বছর কয়েক আগে ইসলামিক স্টেটকে (আইএস) ইরাক সরকার পরাজিত করার ঘোষণা দিলেও দেশটিতে এখনো জঙ্গিগোষ্ঠীটির উদ্বেগজনক তৎপরতা রয়েছে।
বিভিন্ন সময় আইএসের চালানো রক্তক্ষয়ী হামলা তার প্রমাণ। ফলে ইরাকে অবস্থানরত মার্কিন সেনারা একদিকে যেমন আইএসের বিরুদ্ধে লড়ছেন, অন্যদিকে ইরাকি বাহিনীকে জঙ্গিবিরোধী লড়াইয়ে সক্ষম করে তুলছেন।
একই সুরে কথা বলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইরাকে অ্যামেরিকার সেনার ভূমিকা বদলের কথা জানিয়ে বলেন, ”মার্কিন সেনা আর ইরাকে লড়াই করবে না। তবে আইএসের বিরুদ্ধাচরণ করা হবে। দুই দশকের লড়াই শেষ করে এই বছরের শেষে মার্কিন সেনা ইরাকে প্রশিক্ষকের ভূমিকা নেবে। তারা ইরাকের সেনাকে প্রশিক্ষণ দেবে।”
সূত্র মতে, ১৮ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইরাকে আগ্রাসন চালানো হয়। এই আগ্রাসনে ২০০৩ সালে সাদ্দাম হোসেনের শাসনের পতন হয়। আগ্রাসন-পরবর্তী ইরাকে ১ লাখ ৬০ হাজার মার্কিন সেনা ছিল।
এখন দেশটিতে প্রায় ২ হাজার ৫০০ জন নিয়মিত মার্কিন সেনা রয়েছেন। এ ছাড়া আছে কিছুসংখ্যক বিশেষ বাহিনীর সদস্য, যাদের সুনির্দিষ্ট সংখ্যা অজানা।
তবে, ইরাক থেকে সব সেনা প্রত্যাহার করা হবে না জানিয়ে বাইডেন বলেন, ”ইরাকে এখনো আড়াই হাজার মার্কিন সেনা আছে। ইরাকে আমরা থাকব। আমরা ইরাকের সেনাকে প্রশিক্ষণ দেব। সাহায্য করব। যখন প্রয়োজন হবে, তখন আইএসআইএসের সঙ্গে কীভাবে মোকাবিলা করতে হবে, সেই কাজে তাদের সাহায্য করব। এই বছরের শেষ থেকে আমরা আর যুদ্ধক্ষেত্রে থাকব না।”
মধ্যপ্রাচ্য ও ইরানের ইচ্ছাপূরণ
মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান শক্তি হয়ে উঠতে চায় ইরান। আর এই পথে সবথেকে বড় বাঁধা যুক্তরাষ্ট্র। সেজন্য ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের পর ইরান তার প্রতিবেশী দেশগুলো তথা মধ্যপ্রাচ্য থেকে মার্কিন বাহিনীকে উচ্ছেদের চেষ্টা করে।
ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের পতন হলে দেশটির শিয়া রাজনীতিক ও মিলিশিয়াদের ওপর তেহরানের প্রভাব বিস্তারের পথও উন্মুক্ত হয়। এই কাজে ইরান ইতিমধ্যে অনেকটা সফল। ইরানপন্থী মিলিশিয়ারা ইরাকে বেশ শক্তিশালী। অন্যদিকে, ইরাকের পার্লামেন্টেও ইরানপন্থীদের অবস্থান শক্ত।
মধ্যপ্রাচ্য থেকে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি সরাতে বাধ্য করতে ইরান বহুদিন থেকেই চেষ্টা করে আসছে। বিবিসি বলছে, ইরাকে মার্কিন উপস্থিতি নিশানা করে রকেট ও ড্রোন হামলা বৃদ্ধির বিষয়টিকে ইরানের একটা ‘খেলা’ হিসেবে দেখা হয়। আবার ইরাক থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের দাবিতে সাধারণ ইরাকিদের বিক্ষোভ-প্রতিবাদে ইরানের সমর্থন এই কৌশলেরই অংশ।
ইরাকে ইরানের কৌশল কাজে দিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। ইরাকে মার্কিন যুদ্ধসেনাদের অভিযানের সমাপ্তি ঘটলে তা আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের খেলায় ইরানকে সুবিধা দেবে।
ইরাকে ব্যাকফুটে যুক্তরাষ্ট্র
ইরাকে মার্কিন সেনা অবস্থান লক্ষ্য করে সম্প্রতি রকেট ও ড্রোন হামলার পরিমাণ বেড়ে যেতে দেখা গেছে। এই হামলার জন্য ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়াদের দায়ী করছে যুক্তরাষ্ট্র। ইরাকের যেসব রাজনীতিক কোনো পক্ষে নেই, তারাও চান, তাদের দেশ বিদেশি সেনামুক্ত হোক।
২০১৯ সালের অক্টোবর থেকে ইরাক জুড়ে দীর্ঘদিন চলেছে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ৷ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বিক্ষোভ থামাতে গুলি চালায় বলেও অভিযোগ রয়েছে৷ তাতে অন্তত ৪৭০জন মারা যায়৷শুক্রবার আবার বিক্ষোভ হলো রাজধানী বাগদাদের রাজপথে৷
তবে এবারের বিক্ষোভ যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে৷ ওপরে সরকারবিরোধী বিক্ষোভের ছবি৷
ইরাক থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মার্কিন সেনা সরিয়ে নেয়ার দাবিতে এই বিক্ষোভমিছিলের আহ্বান জানিয়েছিলেন সে দেশের শিয়াদের ধর্মীয় নেতা মুকতাদা আল-সদর৷ তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে লাখো জনতা রাজপথে নেমে এলে শহরের বড় একটা অংশে যানচলাচল বন্ধ হয়ে যায়৷
বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দেয়া অনেকের গায়ে ছিল কাফনের কাপড়৷ তাদের কয়েকজন বার্তা সংস্থাগুলোকে বলেছেন, ‘‘ইরাক থেকে মার্কিন সেনাদের ফেরত পাঠাতে প্রয়োজনে আমরা লড়তে প্রস্তুত, সেই লড়াইয়ে মরতেও প্রস্তুত৷’’
বিক্ষোভকারীদের একাংশকে রাস্তায় ইরাকের বড় একটি পতাকা বিছিয়ে ‘যুক্তরাষ্ট্র নিপাত যাক, ইসরায়েল নিপাত যাক’ স্লোগান দিতে দেখা যায়৷
উভয় সঙ্কটে ইরাক
আফগানিস্তান থেকে মার্কিন ও ন্যাটো সেনা দেশে ফেরার পর সেখানে তালিবান একের পর এক এলাকা দখল করে নিচ্ছে। ইরাকে মার্কিন সেনার ভূমিকা সীমাবদ্ধ হলে সেখানেও কি একই অবস্থা হবে?
এক কর্মকর্তার দাবি, ইরাকি বাহিনী প্রশিক্ষিত এবং তারা যুদ্ধে পারদর্শী। তারা নিজের দেশকে বাঁচাতে সক্ষম।
প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, ইরাকের বাহিনী নিজে থেকেই পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে। বিদেশি সেনার উপস্থিতির কোনো প্রয়োজন নেই।
যদিও গত শুক্রবার আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনের সঙ্গে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ইরাকি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাগদাদ এখনো আমেরিকার সাহায্য চায় এবং দ্বিপক্ষীয় নিরাপত্তা সহযোগিতা রক্ষা করতে ইচ্ছুক।
তিনি বলেন, উগ্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দায়েশকে মোকাবেলার জন্য মার্কিন নেতৃত্বাধীন যে আন্তর্জাতিক জোট রয়েছে তাদের সঙ্গে আমাদের কাজ করা প্রয়োজন। প্রশিক্ষণ নেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের সহযোগিতা প্রয়োজন। আকাশ প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের মার্কিন সেনা প্রয়োজন।
এদিকে, আইএস এখনো ইরাকের কাছে বিপদের কারণ। গত সপ্তাহেই বাগদাদের বাজারে তারা রাস্তার ধারে বোমা বিস্ফোরণ করেছে। তাতে ৩০ জন মারা গেছেন। এছাড়া গত মে মাসে কিরকুক শহরের কাছে অবস্থিত দুটি তেলকূপে বুধবার বোমা হামলা চালায় জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস। এ সময় আইএস সন্ত্রাসীরা পাশের একটি নিরাপত্তাচৌকিতেও হামলা চালায়। এতে এক পুলিশ নিহত ও তিনজন আহত হন।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৬০৭
আপনার মতামত জানানঃ