ইসলামের পাঁচটি মূল স্তম্ভের একটি হজ এবং আর্থিক ও শারীরিকভাবে সক্ষম সকল মুসলিমের জন্য জীবনে অন্তত একবার হজ করা ফরজ। করোনা মহামারির আগে প্রতি বছর সারা বিশ্ব থেকে প্রায় আড়াই কোটি মুসলিম মক্কায় হাজির হতেন হজ করার জন্য।
তবে এ বছরও ২০২০ সালের মতোই কোনো বিদেশি হাজি হজে অংশ নিতে পারবেন না। সৌদি আরব নিয়ম করে দিয়েছে, ১৮ থেকে ৬৫ বছর বয়সী টিকা নেওয়া ৬০ হাজার ব্যক্তি এবার হজ করতে পারবেন।
মক্কার গ্র্যান্ড মসজিদটিই মুসলিম হাজিদের কেন্দ্রবিন্দু এবং এখানেই আছে সুদৃশ্য কালো রেশমে মোড়ানো ঘনকাকৃতির কাঠামোর পবিত্র কাবা শরিফ। এই রেশমে সোনা ও রুপার সুতায় পবিত্র কোরআনের আয়াত খচিত।
ইসলামিক সূত্র অনুযায়ী ইহুদী, খ্রিস্টান আর ইসলাম ধর্মের পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ)-কে তাঁর স্ত্রী সারাহ ঈর্ষান্বিত হয়ে হাজেরার শিশুপুত্র ইসমাইল (আ)-কে মা-সহ চোখের আড়াল করতে অনুরোধ করেন। আল্লাহ্র আদেশে ইব্রাহিম (আ) ইসমাইল (আ)-কে তাঁর মা হাজেরাসহ এই মক্কার বিরান ভূমিতে রেখে আসেন, যদিও পুত্রবিচ্ছেদে তাঁর প্রচণ্ড কষ্ট হয়েছিল।
সেখানে বুখারি শরিফ মতে ফেরেশতা জিবরাঈলের (আঃ) ডানার আঘাতে ‘জমজম’ কূপ সৃষ্টি হয়। বিরান মরুর বুকে পানির সন্ধান পেয়ে ঐ এলাকায় লোক জড়ো হতে থাকে এবং এক পর্যায়ে এই জায়গায় লোকালয় গড়ে ওঠে। ইসমাইলের নামানুসারে এই জনগোষ্ঠীকে বলা হত ইসমাইলাইট বা ইসমাইলি। হযরত ইসমাইল (আ) তাদের কাছেই আরবি শেখেন, যেহেতু তাঁর মাতৃভাষা আরবি ছিল না।
ইসমাইল বড় হবার পর হযরত ইব্রাহীম (আ) মক্কায় আসেন এবং আল্লাহর আদেশে এখানে কাবার নির্মাণ শুরু করেন পুত্রের সাথে। মক্কার প্রাচীন নাম ছিল বাক্কা, আর মদিনার আগের নাম ছিল ইয়াসরিব।
কাবার প্রাথমিক গঠন নির্মাণ শেষে একজন ফেরেশতা তাঁর কাছে অপার্থিব ‘সাদা’ পাথর নিয়ে আসেন, যেটা কাছের আবু-কুবাইস পর্বতের উপর আকাশ থেকে পতিত হয়েছিল (উল্কাপিণ্ড)। সেটা কাবার পূর্ব কোণে স্থাপন করে দেয়া হয়। আবার কোনো মতে, হযরত আদম (আ) নিজেই এ পাথর নিয়ে আসেন বেহেশত থেকে। কালের বিবর্তনে সেই সাদা পাথর কালো হতে থাকে এবং এটি এখন ইসলাম ধর্মের খুব গুরুত্বপূর্ণ পবিত্র বস্তু।
সত্যি বলতে, বর্তমান কাবাঘরে সেই আদি কাবার কিছুই অবশিষ্ট নেই, কেবল দুটো পাথর ছাড়া। একটি হলো সেই পাথর, যাকে ‘হাজরে আসওয়াদ’ বলে, যার অর্থ ‘কালো পাথর’। আরেকটি হলো সেই পাথর, যেটিতে হযরত ইব্রাহীম (আ) এর পায়ের ছাপ আছে, যেটির উপর দাঁড়িয়ে তিনি নির্মাণকাজ পরিচালনা করতেন বলে বর্ণিত আছে। এর নাম ‘মাকামে ইব্রাহীম’।
পবিত্র কাবা বেশ কয়েকবার নির্মিত ও পুনর্নির্মিত হয়েছে। কাবার ভিত মজবুত করার জন্য সর্বশেষ ১৯৯৬ সালে এতে বড় সংস্কারকাজ চালানো হয়। বিশ্বের সকল মুসলিম ,যে যেখানেই থাকুক, সবসময় কাবার দিকে ফিরে নামাজ পড়েন।
কাবাকে অনেক নামেই কুরআন-হাদিসে ডাকা হয়েছে; বাইতুল হারাম, বাইতুল্লাহ, বাইতাল আতিক এবং আওয়াল উল বাইত। এর দিকে ফিরেই মুসলিমরা নামাজ আদায় করেন (‘কিবলা’), তবে এর আগে জেরুজালেমের পবিত্র ঘরের দিকে ফিরে নামাজ আদায় করা হত।
গত কয়েক দশক ধরে প্রতি বছর সারা বিশ্ব থেকে হজ করতে আসা লাখ লাখ হাজির স্থান সংকুলানের জন্য গ্র্যান্ড মসজিদের প্রাঙ্গণের আয়তন অনেক বাড়ানো হয়েছে। ২০১৯ সালে সৌদি আরব জানায়, গত ৫০ বছরে সাড়ে তারা ৯ কোটির বেশি হাজিকে আতিথেয়তা দিয়েছে। সৌদি আরব জানিয়েছিল, প্রতি বছর হজ ও উমরাহ করতে আসা ৩ কোটি আতিথেয়তা দেওয়ার পরিকল্পনা করছে তারা।
আজও হাজিরাও হজে সেই কাজগুলোই করেন; ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে হযরত মুহাম্মদ (স.) তার ‘বিদায় হজে’ যা যা করেছিলেন। হজের মাধ্যমে মুসলিমরা অন্তরের কালিমা পরিষ্কার করেন, এবং স্রষ্টার নৈকট্য লাভ করেন।
ইসলামী চন্দ্র ক্যালেন্ডারের দ্বাদশ ও সর্বশেষ মাস জিলহজের আট তারিখে হজ্ব অনুষ্ঠিত হয়। হজ্ব পাঁচ দিন ধরে হয়ে থাকে। এ সময় মিনা, আরাফাত পর্বত, মুজদালিফা, জামারাত এবং গ্র্যান্ড মসজিদসহ মক্কার আশপাশের স্থানগুলোতে যেতে হয় হাজিদের।
শত শত বছর ধরে সারা বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে উটের পিঠে বা জাহাজে চেপে কয়েক সপ্তাহ সফর করে হজ করতে মক্কায় এসেছেন হাজিরা। সময় গেছে, বদলেছে জীবন; প্রযুক্তির কল্যানে সহজ হয়েছে হজ পালন। এখন আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে হাজিরা এখন বিমানে চেপে মাত্র কয়েক ঘণ্টায় চলে আসতে পারেন হজ করতে।
২০১২ সালে ১৯০টিরও বেশি দেশ থেকে প্রায় ৩২ লাখ হাজি মক্কায় হাজির হয়েছিলেন হজ করতে। এক বছর পর মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম বা মার্স করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের ফলে প্রায় দশ লক্ষ হাজি মক্কা সফর বাতিল করতে বাধ্য হন।
এরপর ২০২০ সালে, কোভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাবের পর সৌদি কর্মকর্তারা ঘোষণা দেন, সৌদি আরবের মাত্র ১০ হাজার মানুষকে হজ করার অনুমতি দেওয়া হবে। পাশাপাশি বিদেশি হাজিরা হজ্ব পালনের অনুমতি পাবেন না।
২০২০ সালের ১৯ মার্চ সৌদি কর্তৃপক্ষ মক্কা ও মদিনার দুটি প্রধান মসজিদে সমস্ত নামাজ স্থগিত করে। সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পর সাত মাস বাদে মসজিদ দুটিতে আবার নামাজ পড়া শুরু হয়। ২০২০-এর ১ নভেম্বরে সৌদি আরবের বাইরে থেকে আসা সীমিত সংখ্যক মুসলিমকে উমরাহ ভিসা দেওয়া শুরু হয়।
এবার এ বছর ১৮ থেকে ৬৫ বছর বয়সী ৬৫ হাজার সৌদি নাগরিক হজ করতে পারবেন। অবশ্য সবার টিকা নেওয়া থাকতে হবে। তবে এই বছর হজ করার সুযোগ না পাওয়া লাখ লাখ মানুষ ইসলামের সবচেয়ে পবিত্র ভূমিতে যা যা হবে, তার ডিজিটাল স্বাদ পেতে পারেন।
এবার ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ হজ্বের তৃতীয় দিনে উদযাপিত হয় এবং তিন দিন স্থায়ী হয়। এ বছর সারা বিশ্বে মুসলমানরা ২০ থেকে ২২ জুলাইয়ের মধ্যে ঈদ উদযাপন করবেন।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৭০৭
আপনার মতামত জানানঃ