আজকের ভারতে সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হল দেশটিতে সব নির্বাচনই অনুষ্ঠিত হচ্ছে হিন্দু-মুসলিম ধর্মীয় মেরুকরণের আবহে। যদিও এই মেরুকরণের রাজনীতি ভারতে নতুন নয়। আর উত্তরপ্রদেশ যে এই সাম্প্রদায়িকতার লীলাভূমি, তা প্রায় সবারই জানা। ভারতের এই রাজ্যটি জনসংখ্যার বিচারে সবচেয়ে বড়; একইসাথে বিতর্কিতও। কট্টর হিন্দুত্ববাদী বিজেপি নেতা যোগী আদিত্যনাথের শাসনে উত্তরপ্রদেশে মুসলিম নির্যাতনের ঘটনা এখন এতটাই ডালভাত হয়ে গেছে যে মিডিয়াতেও এসব খবর ঠাঁই পায় না।
ভারতের সবচেয়ে জনবহুল ও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই রাজ্যটিতে বিধানসভা ভোট মাত্র ছ’সাত মাস পরেই। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজ্যটিতে বসবাসরত মুসলিম সমাজে আতঙ্ক সৃষ্টিতে উঠে পড়ে লেগেছে হিন্দুত্ববাদী দলগুলো। যদিও উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতাসীন বিজেপি এই অভিযোগ মানতে নারাজ।
মুসলিম নির্যাতনের লোমহর্ষক সব ঘটনা
নির্বাচনের আগে রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকেই পরিকল্পিতভাবে মুসলিমদের ওপর সেখানে হামলা চালানো হচ্ছে বলে খবর আসছে; মারধর করে তাদের ‘জয় শ্রীরাম’ বলতেও বাধ্য করা হচ্ছে। এই ধরনের ঘটনাগুলোর ভিডিও করে তা ছেড়ে দেয়া হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়াতেও, যাতে মুসলিম সমাজে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
সমাজকর্মী ও অ্যাক্টিভিস্টদের মতে, নির্বাচনের আগে রাজ্যে হিন্দু-মুসলিম মেরুকরণের লক্ষ্যেই খু্ব পরিকল্পনা করে এই কান্ডগুলো ঘটানো হচ্ছে।
বাবার সঙ্গে মিলে রাস্তার ময়লা কুড়িয়ে বাঁচা ছেলেটি ভয়ে কাঁপাতে কাঁপতে জানায়, ‘প্রথমে মাটিতে ফেলে রড দিয়ে পেটায়, তারপর হাত-পা মুচড়ে দিয়ে লাথি মারতে থাকে আমাকে।’ সে আরও বলেছিল, হিন্দুরা তাদের বাড়িতে এলে সে নিশ্চয় পানি খাওয়াবে, কিন্তু কোনওদিন আর ভুলেও কোনও মন্দিরে জল খেতে ঢুকবে না।
চলতি বছরের মার্চের মাঝামাঝি, দিল্লির কাছে উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদের একটি হিন্দু মন্দিরে ঢুকে পানি খাওয়ার অপরাধে বারো-তেরো বছরের একটি ছেলেকে মাটিতে ফেলে নৃশংসভাবে মারধর করছিল দু’তিনজন যুবক। বেধড়ক মারের পাশে চলতে থাকে অকথ্য গালিগালাজ। নির্যাতিত বাচ্চা ছেলেটির নাম আসিফ।
মোবাইল ফোনে গোটা ঘটনার ভিডিও করে পরে হোয়াটসঅ্যাপে আর ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয় ওই যুবকরাই। যার হেনস্থার ভিডিও দেখে গোটা ভারত শিউড়ে উঠেছিল, সেই আসিফ পরে বিবিসিকে জানায় শুধু মুসলিম হওয়ার জন্যই তাকে সেদিন ওভাবে মার খেতে হয়েছিল।
বাবার সঙ্গে মিলে রাস্তার ময়লা কুড়িয়ে বাঁচা ছেলেটি ভয়ে কাঁপাতে কাঁপতে জানায়, ‘প্রথমে মাটিতে ফেলে রড দিয়ে পেটায়, তারপর হাত-পা মুচড়ে দিয়ে লাথি মারতে থাকে আমাকে।’ সে আরও বলেছিল, হিন্দুরা তাদের বাড়িতে এলে সে নিশ্চয় পানি খাওয়াবে, কিন্তু কোনওদিন আর ভুলেও কোনও মন্দিরে জল খেতে ঢুকবে না।
এই ভয়াবহ নৃশংসতার মাত্র তিন মাস পড়ে গাজিয়াবাদের কাছে লোনিতে সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ আবদুস সামাদকে একটি নির্জন জায়গায় টেনে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে মারধর করা হয়। জোর করে তাকে ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে বাধ্য করা হয়, কাঁচি দিয়ে কেটে দেয়া হয় লম্বা দাড়ি। আর এখানেও ভিডিও ধারণ করা হয় গোটা ঘটনাটির।
বৃদ্ধ এই মানুষটি কাঁদতে কাঁদতে পরে জানিয়েছিলেন, ‘ওরা শুধু আমাকে শ্রীরাম শ্রীরামই বলায়নি; বারবার বলছিল, করবি আর পাকিস্তানের দালালি?’
পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের মুজফফরনগর ও শামলিতে ‘মকতুব’ নামে একটি এনজিও-র হয়ে সেখানে দাঙ্গাপীড়িতদের মধ্যে বহুদিন ধরে কাজ করছেন রাবিহা আবদুররহিম। রাবিহা বিবিসিকে জানাচ্ছেন, মুসলিম ছেলেদের মারধর ক’রে বা মেয়েদের হেনস্তা ক’রে তার ভিডিও তুলে রাখার ঘটনা সেখানে প্রায়ই ঘটছে।
‘মুসলিমদের লিঞ্চিং উপেক্ষা করা বা চুপচাপ বরদাস্ত করা এক জিনিস, কিন্তু হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়ে মুসলিমদের হত্যাকে সমর্থন করছে, উৎসব করছে – ভাবা যায়? এতো গণহত্যার প্রথম ধাপ!’
শুধু তাই নয়, ওই এলাকার গ্রামে গ্রামে হিন্দু জাঠরা বড় বড় জমায়েত বা মহাপঞ্চায়েত ডেকে সেই সব নির্যাতন উদযাপন করছেন, মুসলিমদের প্রকাশ্য হুমকি দেয়া হচ্ছে।
রাবিহার ভাষ্যমতে, ‘মুসলিমদের লিঞ্চিং উপেক্ষা করা বা চুপচাপ বরদাস্ত করা এক জিনিস, কিন্তু হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়ে মুসলিমদের হত্যাকে সমর্থন করছে, উৎসব করছে; ভাবা যায়? এতো গণহত্যার প্রথম ধাপ!’
এ বছরের জুলাই মাসের শুরুতেই উত্তরপ্রদেশের নয়ডাতে একটি গাড়িতে তুলে নিয়ে সম্পূর্ণ অচেনা লোকজন মেরে অজ্ঞান করে রাস্তায় ফেলে দিয়েছিল বৃদ্ধ কাজিম আহমেদকেও। লম্বা দাড়ি আর ফেজ টুপি থেকে তাকে খুব সহজেই চেনা যায় মুসলিম বলে। আর সে জন্যই তাকে নিশানা করেছিল হামলাকারীরা।
কোনোক্রমে প্রাণে বেঁচে ফেরা আহমেদ পরে বলেন, ‘আলিগড়ের বাসের জন্য যখন অপেক্ষা করছিলাম, তখন ওই গাড়িটি এগিয়ে এসে আমায় লিফট দিতে চায়। কিন্তু আমায় গাড়িতে তুলেই যখন ওরা জানালার কালো কাঁচ নামিয়ে দেয়, তখনই আমি প্রমাদ গুনি। নামিয়ে দেয়ার জন্য কাকুতি-মিনতি করলেও তাতে ওরা কান দেয়নি, আমার দাড়ি টেনে ধরে একধারসে কিল-চড়-ঘুষি মারতে থাকে; দিতে থাকে খুব খারাপ গালাগালি!’
নির্বাচন আর হিন্দুত্ববাদীদের ফাঁদে মুসলমানেরা
নির্বাচনের আগে ভারতের এই রাজ্যে মুসলিম নির্যাতন যেন একটা প্যাটার্ন অনুসরণ করে করা হচ্ছে। এই যে ধারাবাহিকভাবে রাজ্যের একটি সম্প্রদায়ের মানুষজন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, পুলিশ-প্রশাসনের প্রচ্ছন্ন মদত ছাড়া এটা কি আদৌ সম্ভব!
এ প্রসঙ্গে রাজ্যে ক্ষমতাসীন বিজেপির মুখপাত্র সাক্ষী দিবাকর বিবিসিকে বলেন, ‘আমাদের সরকার সবার পাশে আছে, সবার উন্নয়নের জন্য কাজ করছে। ধর্মের ভিত্তিতে কোনও বিভেদ করার প্রশ্নই ওঠে না। আপনি যে ঘটনাগুলোর কথা বলছেন তার প্রতিটিতে যথাযথ তদন্ত হয়েছে, অভিযুক্তরা আটক হয়েছে।’
দীর্ঘদিন উত্তরপ্রদেশ পুলিশের মহাপরিচালক পদে থাকা সাবেক পুলিশ কর্মকর্তাদের বিক্রম সিং বিবিসিকে বলেন, ‘যে কোনও সভ্য সমাজে এরকম মেরুকরণের চেষ্টা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ও হতাশার। এগুলো কখনওই হওয়া উচিত নয়। উত্তরপ্রদেশে বহু শতাব্দী ধরে হিন্দু ও মুসলিমরা যেমন শান্তিতে পাশাপাশি থেকেছে, তেমনি এখানে নানা ডিসটার্বিং ফল্টলাইনও আছে।’
বয়স বারো হোক বা বাহাত্তর, মুসলিমদের পরিকল্পিতভাবে মারধর করা হচ্ছে, জোর করে বলানো হচ্ছে জয় শ্রীরাম। গোটা ঘটনার ভিডিও করে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়াতে, যেগুলো দেখে উল্লাসে ফেটে পড়ছে জাঠদের মহাপঞ্চায়েত।
তিনি বলেন, ‘তবু আমি পুলিশের ওপর ভরসা হারাতে রাজি নই, রাজ্য পুলিশের নতুন ডিজি মুকুল গোয়েল আমার নিজের হাতে-গড়া অফিসার। তার চাপের কাছে মাথা না-নোয়ানোর ক্ষমতা ও সততায় আমার পূর্ণ আস্থা আছে। তবে এটাও মনে রাখা দরকার উত্তরপ্রদেশ পুলিশ বিশ্বের সবচেয়ে বড় পুলিশ বাহিনী; ডিজি’র নির্দেশ সব সময় ঠিকমতো নিচুতলায় পৌঁছয় না।’
দিল্লিতে সুপরিচিত লেখিকা ও অ্যাক্টিভিস্ট ফারাহ নাকভি’রও বিন্দুমাত্র সংশয় নেই, উত্তরপ্রদেশে যা ঘটছে সেটাও করা হচ্ছে আসন্ন নির্বাচনকে মাথায় রেখেই। যতই অবিশ্বাস্য শোনাক নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে বিশেষ করে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে বাস্তবতা কিন্তু এটাই। বয়স বারো হোক বা বাহাত্তর, মুসলিমদের পরিকল্পিতভাবে মারধর করা হচ্ছে, জোর করে বলানো হচ্ছে জয় শ্রীরাম। গোটা ঘটনার ভিডিও করে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়াতে, যেগুলো দেখে উল্লাসে ফেটে পড়ছে জাঠদের মহাপঞ্চায়েত।
আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির সাবেক ছাত্রনেত্রী ও অ্যাক্টিভিস্ট আফরিন ফতিমা বিবিসিকে বলেন, এ রাজ্যে মুসলিমদের মধ্যে একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। আর পুরোটাই করা হচ্ছে পরিকল্পিত ছকে। গবেষণা বলে, যে কোনও দাঙ্গার পরেই মুসলিমরা কিন্তু মিশ্র বসতির এলাকা ছেড়ে গিয়ে নিজেদের ঘেটোতে (ঘেটো হল এমন এলাকা যেখানে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর সদস্যরা বাস করেন; বিশেষত সামাজিক, আইনী বা অর্থনৈতিক চাপের ফলে। ঘেটোগুলো প্রায়শই শহরের অন্যান্য অঞ্চলগুলির চেয়ে বেশি দরিদ্র বলে পরিচিত।) গিয়ে বাস করতে চায়। এখানেও ভোটের আগে ভয় দেখিয়ে ঠিক সেভাবেই মুসলিমদের কোণঠাসা করে ফেলা হচ্ছে।’
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৭১০
আপনার মতামত জানানঃ