জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে বিশ্বে প্রতিনিয়ত তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে এবং এক সময়কার শীতল পৃথিবী ক্রমশ উষ্ণ হতে হতে এখন চূড়ান্ত স্পর্শ করতে যাচ্ছে বলেও অনেক বিজ্ঞানীদের মত। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসার অধিভুক্ত সংস্থা গোডার্ড ইনস্টিটিউট অব স্পেস স্টাডিজ (জিআইএসএস)-এর সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে যে, গত ৭ বছর ধরে ধারবাহিকভাবে বেড়েছে বিশ্বের উষ্ণতা, যার চুড়ান্ত প্রকাশ দেখা গেছে ২০২১ সালের জুন মাসে।
এরইমধ্যে যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় এবং জার্মানির টুইবেনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক জানিয়েছেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে রয়েছে মানবদেহ ক্ষুদ্রাকৃতির হওয়ার সম্পর্ক। বৃহস্পতিবার (৮ জুলাই) প্রকাশিত এক গবেষণায় এই তথ্য জানানো হয়েছে।খবর সিএনএন
এই গবেষণাটি প্রকাশ হয়েছে ন্যাচার কমিউনিকেশনস জার্নালে।
গবেষকেরা জানিয়েছেন, বিগত দশ লাখ বছরে মানুষের দেহের গড় আকার উল্লখযোগ্যভাবে ওঠানামা করেছে। আর এর সঙ্গে সংযোগ রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের।
গবেষকেরা দেখেছেন, জলবায়ু-বিশেষ করে তাপমাত্রা-গত দশ লাখ বছরে মানুষের দেহের আকার বদলে বড় ভূমিকা রেখেছে। শীত ও কঠিন জলবায়ুর সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে অপেক্ষাকৃত বড় শরীরের। আর অপেক্ষাকৃত উষ্ণ আবহাওয়ায় থাকা মানুষের আকার ছোট ছিলো।
জলবায়ু-বিশেষ করে তাপমাত্রা-গত দশ লাখ বছরে মানুষের দেহের আকার বদলে বড় ভূমিকা রেখেছে। শীত ও কঠিন জলবায়ুর সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে অপেক্ষাকৃত বড় শরীরের। আর অপেক্ষাকৃত উষ্ণ আবহাওয়ায় থাকা মানুষের আকার ছোট ছিলো।
গবেষকেরা জানিয়েছেন, আধুনিক মানুষ বা হোমো সেপিয়েন্স-এর উদ্ভব হয়েছে যে ফ্যামিলি থেকে সেই হোমো জেনাস ফ্যামিলির তিনশ’রও বেশি ফসিলের মস্তিষ্ক ও শরীরের আকারের মাপ সংগ্রহ করেছিলেন তারা। এসব তথ্যের সঙ্গে গত দশ লাখ বছরের পৃথিবীর আঞ্চলিক জলবায়ু পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ওই ফসিলগুলো জীবিত অবস্থায় কোন জলবায়ুতে বসবাস করেছেন তা খতিয়ে দেখেছেন গবেষকেরা।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইভোলিউশনারি ইকোলোজির অধ্যাপক আন্দ্রে মনিকা বলেন, ‘এই সম্পর্ক বহু প্রাণীর ক্ষেত্রেই পাওয়া গেছে— এমনকি সমসাময়িক মানুষের মধ্যেও, কিন্তু এখন আমরা জানতে পারছি যে, গত দশ লাখ বছরে মানুষের শরীরের আকার পরিবর্তনে এটাই অন্যতম চালিকা শক্তি।’
এদিকে তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে মানুষের দেহের আকার ক্ষুদ্রাকৃতির হলেও মানুষের মস্তিষ্ক কিন্তু হাঁটছে উল্টো পথে। অর্থাৎ, মানুষের দৈহিক আকার ক্ষুদ্রাকৃতির হলেও মস্তিষ্ক অন্যান্য প্রাণী থেকে তুলনামূলক বড়।
নীল তিমি আকারের দিক থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণী। এর গড় ওজন হয়ে থাকে ১৭০ টনের মতো। কিন্তু একটি জায়গায় মানুষের থেকে পিছিয়ে নীল তিমি। সেটি হলো মস্তিষ্ক। দেহের আকারের অনুপাতে তিমির মস্তিষ্ক বেজায় ছোট। মোটে ছয়-সাত কেজি। অথচ ৫০-৬০ কেজি ওজনের মানুষের দেহেও থাকে প্রায় দেড় কেজি ওজনের মস্তিষ্ক!
মস্তিষ্কের আকারের দিক থেকে মানুষ এই বিশ্বের অন্য সব প্রাণী থেকে আলাদা। মানুষই একমাত্র মেরুদণ্ডী প্রাণী, যাদের মস্তিষ্ক দেহের আকারের অনুপাতে সবচেয়ে বড়। মানুষের মস্তিষ্ক সবচেয়ে জটিল, নিউরনের ঘনত্বও থাকে বেশি। আর এই উন্নত মস্তিষ্কের জোরেই নীল তিমিকে হারিয়ে পৃথিবীতে রাজত্ব করছে দুপেয়ে মানুষ।
কিন্তু মানুষের মস্তিষ্ক এত বড় হলো কী করে? দ্য ইকোনমিস্ট সাময়িকীতে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, গবেষক ডেভিড হসলার ও তার দল এক জাতের বানরের ওপর পরীক্ষা চালান। তাতে নতুন ধরনের এক জিনের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এই জিনটি হলো নচ২এনএল (এনওটিসিএইচ২এনএল)।
গবেষকেরা বলছেন, পরীক্ষা চালানো বানরের দেহে এই জিন পাওয়া যায়নি। শুধু বানর নয়, শিম্পাঞ্জি ও গরিলা বাদে পৃথিবীর অন্য কোনো প্রাণীর ডিএনএ-তেই এই জিন পাওয়া যায়নি। আর পাওয়া গেছে মানুষের দেহে। শিম্পাঞ্জি ও গরিলায় থাকা নচ২এনএল (এনওটিসিএইচ২এনএল) নামের জিন পুরোপুরি নিষ্ক্রিয়। কিন্তু মানুষে সক্রিয়। বিবর্তনের ধারায় তা তিনটি সংস্করণও তৈরি করে ফেলেছে। এগুলো হলো এ, বি ও সি।এই তিন সংস্করণের নচ জিন মানুষের দুটি বিলুপ্ত প্রজাতির মধ্যেও ছিল। সেগুলো হলো নিয়ানডার্থাল ও ডেনিসোভানস।
গবেষকদের ধারণা, ৩০ থেকে ৪০ লাখ বছর আগে নচ২এনএল (এনওটিসিএইচ২এনএল) নামের জিনটি সক্রিয় হতে শুরু করে এবং তখন থেকেই পৃথিবীর বুকে মানুষ প্রজাতির প্রাণীর জয়জয়কার শুরু হয়।
ডেভিড হসলারের গবেষণায় দেখা গেছে, নচ২এনএল (এনওটিসিএইচ২এনএল) কোষের সংখ্যা বৃদ্ধি করে। এই জিনের অনুপস্থিতিতে কোষের স্বাভাবিক বৃদ্ধি হয়। কিন্তু নচ২এনএলের প্রভাবে কোষের সংখ্যা বেড়ে যায়। বেড়ে যায় মস্তিষ্কের নিউরনের সংখ্যাও। আর সেটিই মানুষের মস্তিষ্ক বড় হওয়ার মূল কারণ।
জীববিজ্ঞানী পিয়েরে ভনডারহেঘেনের গবেষণাতেও একই জিনের প্রভাব দেখা গেছে। এই দুই পৃথক গবেষণায় এটি প্রমাণিত হয়েছে যে মানুষের মস্তিষ্ক বড় হওয়ার পেছনে নচ২এনএল (এনওটিসিএইচ২এনএল) নামের জিনের ভূমিকাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
ঠিক কীভাবে মানুষের মস্তিষ্ক এত উন্নত হলো— তার নিখুঁত বিশ্লেষণ এখনো অজানা। যন্ত্রের উদ্ভাবন একটি ব্যাখ্যা হতে পারে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, সাম্প্রতিক উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে মানব মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণায় আরেকটি নতুন দিগন্তের উন্মোচন হলো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গেই একদিন মানুষ জানতে পারবে নিজেদের মস্তিষ্কের পুরো রহস্য।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩২৮
আপনার মতামত জানানঃ