মানবসৃষ্ট কারণে পৃথিবীজুড়ে জলবায়ু বদলে যাচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা দিন দিন বাড়ছে বলে শীতজনিত মৃত্যুহার কমছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গরম আবহাওয়ার কারণে সৃষ্ট জটিলতায় মৃত্যু।
বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী দ্য ল্যানসেট প্ল্যানেটারি হেলথে বুধবার প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এ তথ্য।
অতীতে বিভিন্ন গবেষণায় বৈশ্বিক মৃত্যুহারে উচ্চ ও নিম্ন তাপমাত্রার প্রভাব বিশ্লেষণ করে দেখা হয়েছে।
নতুন গবেষণায় কখন, কীভাবে তাপমাত্রায় পরিবর্তন এসেছে আর সেসবের ফল কী ছিল, বিশেষ করে একবিংশ শতাব্দীর পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। কারণ গত ১০০ বছরে প্রতি দশকে তাপমাত্রা বেড়েছে গড়ে শূন্য দশমিক ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস করে।
গবেষণা প্রতিবেদনটির সহ-প্রধান ও অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ইউমিং গুও বলেন, ‘প্রতিকূল তাপমাত্রার কারণে বিশ্বজুড়ে মৃত্যুহার নিয়ে এটি প্রথম গবেষণা।
তিনি বলেন, ‘২০০০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সময়ের তথ্যনির্ভর এ গবেষণা। কারণ শিল্পবিপ্লব যুগের পর এ সময়েই সবচেয়ে বেশি বৈশ্বিক তাপমাত্রা দেখেছে বিশ্ব।’
গবেষণায় পাঁচটি মহাদেশের ৪৩টি দেশের তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। জলবায়ু, আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি, জনসংখ্যাভিত্তিক অবস্থা, অবকাঠামোগত পার্থক্য ও জনস্বাস্থ্য সেবাসহ বেশ কিছু বিষয়ের ওপর তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
সব তথ্যের বিশদ বিশ্লেষণ ও শ্রেণিবদ্ধ করার পর গুও ও তার সহকর্মীরা দেখেছেন, ২০০০ সালের পর উচ্চ তাপমাত্রাজনিত জটিলতায় মৃত্যু বেড়েছে শূন্য দশমিক ২১ শতাংশ। বিপরীতে শীতের কারণে মৃত্যু কমেছে শূন্য দশমিক ৫১ শতাংশ। অর্থাৎ অতীতের তুলনায় এখন গরমে প্রাণহানি বেশি হচ্ছে, শীতে কমছে।
২০০০ সালের পর উচ্চ তাপমাত্রাজনিত জটিলতায় মৃত্যু বেড়েছে শূন্য দশমিক ২১ শতাংশ। বিপরীতে শীতের কারণে মৃত্যু কমেছে শূন্য দশমিক ৫১ শতাংশ। অর্থাৎ অতীতের তুলনায় এখন গরমে প্রাণহানি বেশি হচ্ছে, শীতে কমছে।
গবেষণায় আভাস মিলেছে, বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে শীতে প্রাণহানির নিম্নমুখী হারকেও ছাড়িয়ে যাবে গরমে মৃত্যুর ঊর্ধ্বমুখী হার।
গুও বলেন, ‘দীর্ঘমেয়াদে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মৃত্যুর মিছিল আরও দীর্ঘ হবে। কারণ গরমে মৃত্যুহার প্রতিনিয়ত বাড়ছে।’
গরমে প্রাণহানি বাড়ার এই উদ্বেগজনক আভাস এরই মধ্যে সঠিক প্রমাণ হয়েছে। কারণ প্রতি বছর গ্রীষ্মে বিভিন্ন অঞ্চলে নতুন করে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হচ্ছে; বাড়ছে দাবদাহের সংখ্যা, স্থায়িত্ব ও তীব্রতা।
প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে দাবদাহে গত কয়েক দিনে প্রাণ গেছে প্রায় এক হাজার মানুষের। পরবর্তী দুই মাসে উত্তর গোলার্ধ্বে তাপমাত্রা আরও বাড়বে বলে অঞ্চলটিতে গ্রীষ্মে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে টেক্সাসে তীব্র শীতে প্রাণ গেছে দুই শতাধিক মানুষের। এ ঘটনাকে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে শীতজনিত মৃত্যুহার বৃদ্ধির উদাহরণ বলছেন গবেষকরা।
গরম বা শীতের আধিক্যে এশিয়ায় মৃত্যু বেশি
গবেষণায় আরও জানা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের ফলে সৃষ্ট ঝুঁকিও বিশ্বের একেক অঞ্চলে একেক রকম।
অঞ্চলের হিসেবে আবহাওয়ায় পরিবর্তনের প্রভাবে মৃত্যু সবচেয়ে বেশি এশিয়ায়। এ মহাদেশে গরম বা শীতের আধিক্যে প্রতি বছর গড়ে মারা যায় ২৬ লাখ মানুষ।
তালিকায় পরের অবস্থানে আফ্রিকা। যদিও অঞ্চলটিতে গরম ও শীতে প্রাণহানি এশিয়ার অর্ধেকও নয়।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে তীব্র গরম বা শীতের সংস্পর্শে সারা বিশ্বে বছরে মৃত্যু হয় ৫০ লাখ মানুষের। এ সংখ্যাটি বিশ্বজুড়ে মোট মৃত্যুর নয় দশমিক ৪৩ শতাংশ।
তাপমাত্রার ওঠানামার তীব্রতার প্রভাবে মোট বৈশ্বিক মৃত্যুর তিন-চতুর্থাংশই ঘটে এশিয়া ও আফ্রিকায়; মৃত্যু হয় ৩৮ লাখ মানুষের। শুধু আফ্রিকায় এ সংখ্যা ১২ লাখ।
এ ছাড়া ইউরোপে এ সংখ্যা বছরে গড়ে ৮ লাখ ৩৫ হাজার। যুক্তরাষ্ট্রে পৌনে ২ লাখ ও দক্ষিণ আমেরিকায় ১ লাখ ৪১ হাজার।
তবে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এতকাল এসব প্রাণহানির হিসাবের বেশিরভাগই শীতকেন্দ্রিক। নিম্ন তাপমাত্রায় মৃত্যুহার বেশি বিশেষ করে সাব-সাহারান আফ্রিকায়।
অন্যদিকে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে সাম্প্রতিককালে শীতজনিত মৃত্যু কমেছে অন্যান্য অঞ্চলে, বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়।
আবার ইউরোপে প্রতি বছর একদিকে তীব্র শীতে প্রাণ যায় ছয় লাখ ৫৭ হাজার মানুষের। অন্যদিকে যেকোনো অঞ্চলের তুলনায় এই মহাদেশেই গরমে মৃত্যুও সবচেয়ে বেশি প্রায় এক লাখ ৭৯ হাজার।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বজুড়ে মৃত্যুহারে পরিবর্তন সম্পর্কে নতুন ও বিস্তারিত অনেক তথ্য উঠে এসেছে এ গবেষণায়।
এর ওপর নির্ভর করে আগামী কয়েক দশকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমাতে করণীয় নির্ধারণ করতে চায় পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৫১
আপনার মতামত জানানঃ