করোনাভাইরাসের কারণে টালমাটাল বিশ্ব। অর্থনীতির অবস্থা নাজুক। চাকরি হারিয়েছে মানুষ। দরিদ্রতা বেড়ে গেছে। করোনার টিকা বাজারে আসার খবরে অনেক কিছু স্বাভাবিক হওয়ার ইঙ্গিত মিললেও, এই ক্ষতি সামলে উঠতে বেগ পেতে হবে বিশ্বকে। কয়েকটি দেশের সরকার করোনা মহামারি ঠিকভাবে মোকাবিলা করতে পারলেও অনেক দেশই সামাজিক নিরাপত্তা ঘাটতি ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার অভাবে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে খুব একটা সহায়তা করতে পারেনি। ফলে, শ্রমিকেরাও কাজে ফিরতে পারেননি। পরিস্থিতি আরও জটিল করে দিয়েছে অনানুষ্ঠানিক খাতে থাকা বিপুলসংখ্যক শ্রমিক।
২ কোটি ২০ লাখ কর্মসংস্থান হারিয়েছে
এই করোনা মহামারিতে উন্নত অর্থনীতির দেশগুলো ২ কোটি ২০ লাখ কর্মসংস্থান হারিছে। অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা ওইসিডির গতকাল বুধবার প্রকাশিত বার্ষিক কর্মসংস্থান আউটলুক এ তথ্য পাওয়া গেছে। এতে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাস সংকটের সময়ে চাকরি ধরে রাখতে ব্যবস্থা নেয়ায় মাত্র ২ কোটি ১০ লাখ চাকরি বাঁচানো সম্ভব হয়েছে। এরপরও ধনী দেশগুলো দীর্ঘ মেয়াদে বেকারত্বের হার বৃদ্ধির আশঙ্কায় রয়েছে। কারণ, অনেক কম দক্ষ কর্মী মহামারির সময়ে নতুন চাকরি শুরু করতে না পেরে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
ওইসিডির প্রধান স্টিফেন কারসিলো বলেন, এই মহামারি সংকট চলার সময় হারিয়ে যাওয়া অনেক চাকরি আর পুনরুদ্ধার করা যাবে না। ২০২১ সালের মে মাস পর্যন্ত ওইসিডিভুক্ত দেশগুলোর বেকারত্বের হার কমে হয়েছে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। তবে এখনো তা করোনা পূর্ববর্তী অবস্থার চেয়ে ১ শতাংশ কম। ওইসিডিজুড়ে যে ২ কোটি ২০ লাখ মানুষ কাজের বাইরে রয়েছেন, তাদের মধ্যে ৮০ লাখ বেকার এবং ১ কোটি ৪০ লাখ নিষ্ক্রিয় রয়েছেন বলে মনে করা হয়।
ওইসিডি মনে করে না ২০২৩ সালের তৃতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত কর্মসংস্থান পরিস্থিতি করোনা পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরবে। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলো দ্রুত উন্নতি করতে পারে। কারণ, এই সংকট তারা উন্নত দেশের চেয়ে ভালোভাবে পরিচালনা করেছে।
এই টেকসই বেকারত্বের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে বঞ্চিত, দুর্বল, নারী ও স্বল্প দক্ষ শ্রমিকদের ওপর, যারা মহামারির এই সময়ে সবচেয়ে বেশি কষ্টের শিকার হয়েছেন।
তবে ওইসিডির কর্মসংস্থান, শ্রম ও সামাজিকবিষয়ক পরিচালক স্টিফানো স্কারপেটা বলেন, চাকরি ও মজুরির ক্ষেত্রে তরুণদের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ ধরে এই দাগ থেকে যেতে পারে। ওইসিডির মতে, তরুণদের ওপর প্রভাব অপেক্ষাকৃত বয়স্কদের চেয়ে কমপক্ষে দ্বিগুণ হয়েছে। কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো ও স্পেনের তরুণেরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বেকারত্বে ভুগছে তরুণরা
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার তথ্যানুসারে, ২০২০ সালে সারা বিশ্বে তরুণদের বেকারত্বের হার দাঁড়িয়েছে ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ। তবে ২৫-এর বেশি বয়সী মানুষের বেকারত্বের হার দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ২ শতাংশ।
মহামারিতে মধ্য আয়ের দেশগুলোর তরুণেরা সবচেয়ে বেশি বেকার হয়েছেন। যেমন আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা ও পেরু। এ দেশগুলোর অর্থনীতি পর্যটনের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। আর এ পর্যটন খাতে সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান হয় তরুণদের।
এ ছাড়া উন্নত দেশগুলোর মতো সক্ষমতা তাদের নেই। ফলে দীর্ঘমেয়াদি লকডাউন দিয়ে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও কর্মীদের জন্য বড় অঙ্কের প্রণোদনা ঘোষণা করাও তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি।
আইএলওর তথ্যে দেখা যায়, যেসব দেশে প্রণোদনা বা সরকারি সহায়তা কম দেওয়া হয়েছে, তারাই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে। তার মানে অবশ্য এই নয় যে উন্নত দেশের তরুণদের গায়ে আঁচ লাগেনি। ইউরোপের তরুণেরাও আক্রান্ত হচ্ছেন। মহামারির শুরুতে স্পেন ও ইতালি ইউরোজোন সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছিল। স্পেনের পুনরুদ্ধার কার্যক্রম উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করেছে।
আইএলওর হিসাব অনুসারে, সারা বিশ্বের পর্যটন, হোটেল ও ক্যাটারিংয়ের ৫৫ শতাংশ কর্মী নারী। এ ছাড়া লকডাউনের মধ্যে স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শিশুদের দেখাশোনা ও পড়ানোর বাড়তি দায়িত্বও নারীকে পালন করতে হয়েছে।
আইএলওর তথ্যে দেখা যায়, মধ্য আয়ের দেশগুলোতে পুরুষের বেকারত্বের হার যেখানে ২৩ দশমিক ৭ শতাংশ, সেখানে নারীদের ক্ষেত্রে তা ২৯ শতাংশ। এর আগে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ‘ওয়ার্ল্ড আনএমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সোস্যাল আইটলুক: ট্রেন্ড ২০২১’ শীর্ষক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, কোভিড-১৯ মহামারির কারণে আগামী বছরের (২০২২ সাল) শেষ নাগাদ বিশ্বে কর্মসংস্থানহীন মানুষের সংখ্যা দাঁড়াবে সাড়ে ২০ কোটি। ২০১৯ সালে যা ছিল ১৮ কোটি ৭০ লাখ। করোনার কারণে এই সময় কর্মহীন মানুষ বেড়েছে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোয় চাকরি হারাতে যাচ্ছে সাড়ে ১২ কোটি মানুষ।
বাংলাদেশের পরিস্থিতি
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাস সংকটে বিশ্বে প্রতি ছয়জনের একজন বেকার হয়েছে আর বাংলাদেশের প্রতি চারজন যুবকের মধ্যে একজন কর্মহীন বা বেকার রয়েছে (২৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ)। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই এই বেকারত্ব বাড়ছে।
করোনাভাইরাসের কারণে তৈরি হওয়া মন্দায় ব্যাংকিং, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান কর্মীদের বেতন কমিয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান খরচ কমাতে কর্মী ছাঁটাই করেছে। আর বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই নতুন কর্মী নিয়োগ বন্ধ করে দিয়েছে।
বাংলাদেশের চাকরি সংক্রান্ত একটি জনপ্রিয় ওয়েবসাইট বিডিজবসের প্রধান নির্বাহী একেএম ফাহিম মাশরুর এ প্রসঙ্গে বলন, আগে যেরকম বিজ্ঞাপন আসতো, করোনার কারণে সেটা ৬০%, ৭০% কমে গেছে। মে মাসে একটু বাড়লেও এখনো ৫০% কম আছে। যেসব বিজ্ঞাপন আসছে, সেখানে অভিজ্ঞ লোক চাওয়া হচ্ছে, ফ্রেশ গ্রাজুয়েটদের চাহিদা আরও অনেক কমে গেছে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৭৩০
আপনার মতামত জানানঃ