কক্সবাজার শহরে একটি বেসরকারি হাসপাতালে এক রোহিঙ্গা রোগীর ছোট বোনকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় জড়িত থাকায় তিন কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
তবে ধর্ষণের কথা অস্বীকার করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, উত্ত্যক্তের অভিযোগ ওঠায় তিন কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার (১লা জুলাই) রাতে শহরের হাসপাতাল সড়কে ‘জেনারেল হাসপাতাল কক্সবাজার’ নামের বেসরকারি হাসপাতালে এই ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ উঠেছে।
চাকুরিচ্যুত কর্মচারীরা হলেন হাসপাতালের সিকিউরিটি ম্যান নুরুল হক (২৬), লিফট ম্যান আতাউর রহমান (২২) ও অফিস সহকারী (পিয়ন) মো. শফি (২০)।
সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার তরুণী ওই হাসপাতালে ভর্তি এক রোগীর ছোট বোন। তিনি উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের ১৪ নম্বর হাকিমপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা। তবে হাসপাতালে ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে কুতুপালংয়ের এমএসএফ-হল্যান্ড হাসপাতাল।
ঘটনাটি ১ জুলাই রাতের হলেও সেটি জানাজানি হয় শনিবার সকালে হাসপাতাল থেকে রোগীকে ছাড়পত্র দেয়ার পর। এ নিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হওয়ায় তদন্তে নেমেছে জেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
জানা গেছে, ১ জুলাই রাতে কক্সবাজার শহরের ‘জেনারেল হাসপাতাল কক্সবাজারের’ ছাদে নিয়ে ওই তরুণীকে ধর্ষণ করে হাসপাতালেরই তিন কর্মচারী।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে প্রাপ্ত অভিযোগে জানা গেছে, গত ১ জুলাই রাতে রোহিঙ্গা নারী রোগী ভর্তি থাকা ওই ওয়ার্ডে হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও অন্য কেউ উপস্থিত ছিলেন না। এ সুযোগে হাসপাতালটির সিকিউরিটিম্যান নুরুল হক, লিফটম্যান আতাউর রহমান ও অফিস সহকারি মিলে রোহিঙ্গা রোগীর ছোট বোনকে কৌশলে ছাদে নিয়ে ধর্ষণ করে।
পরদিন গত ২ জুলাই ভূক্তভোগী তরুণী ও তার রোগী বোন ঘটনার ব্যাপারে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে মৌখিকভাবে অভিযোগ করেন। অভিযোগের পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ওই দিন রাতে দায়িত্বে থাকা সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে এক স্থানে জড়ো করে। পরে ভূক্তভোগী তরুণীকেও সেখানে নিয়ে আসা হয়। এসময় সেখানে উপস্থিত থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ঘটনায় জড়িত থাকা তিনজনকে চিহ্নিত করে ভূক্তভোগী তরুণী। এ ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে অভিযুক্ত তিন কর্মচারীকে চাকুরিচ্যুত করেছেন।
এদিকে পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া স্বত্বেও রোহিঙ্গা রোগীকে শনিবার সকালে ছাড়পত্র দিয়ে দেন বলে অভিযোগে জানা যায়।
জেনারেল হাসপাতালের মহাব্যবস্থাপক আরিফুল ইসলাম জানান, গত ২৭ জুন আর্ন্তজাতিক সংস্থা মেডিসিনস্ স্যান্স ফ্রন্টিয়ারস্ (এমএসএফ-হল্যান্ড) এর উখিয়ার কুতুপালংস্থ হাসপাতালের রেফার করা এক রোহিঙ্গা নারী রোগীকে জরায়ু সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এমএসএফ এর এক নারী প্রতিনিধি ওই রোহিঙ্গা রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে আসে।
পরে ওই রোহিঙ্গা রোগীকে (২৩) হাসপাতালের ষষ্ঠ তলার ৬০৪/এ নম্বর সিটে ভর্তি করা হয়। রোগীর সঙ্গে হাসপাতালে আসে ১৭ বছর বয়সী এক ছোট বোন। তারা উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের ১৪ নম্বর হাকিম পাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা। তবে জেনারেল হাসপাতালে রোগীর ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে উখিয়ার কুতুপালংস্থ এমএসএফ-হল্যান্ড হাসপাতাল।
তিন কর্মচারীকে চাকুরিচ্যুত করার বিষয়টি স্বীকার করলেও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি করেন জেনারেল হাসপাতালের মহাব্যবস্থাপক আরিফুল ইসলাম।
তিনি বলেন, হাসপাতালে প্রতিদিন যে জনবল, রোগী ও তাদের স্বজনরা উপস্থিত থাকেন, “এ রকম পরিবেশে ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটার সুযোগ নেই। ঘটনার রাতে ধর্ষণ নয়, রোগীর এক স্বজনের সঙ্গে ইভটিজিংয়ের ঘটনা ঘটেছে।
“ভুক্তভোগী তরুণীর কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত তিন কর্মচারীকে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে।”
আইনের দিক থেকে ইভটেজিংয়ের মতো ঘটনাটিও অপরাধ এবং অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে নিজেরাই কেন ব্যবস্থা নিয়েছেন তার ব্যাখা দেন আরিফুল।
তিনি বলেন, “ভুক্তভোগী তরুণী অবিবাহিতা। তার ভবিষ্যৎ জীবনের কথা চিন্তা করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ঘটনাটি ব্যাপক আকারে রূপ দিতে চাইনি। এই কারণে ইভটিজিংয়ের ঘটনাটি আইন-শৃংখলা বাহিনীর সংশ্লিষ্টদের অবহিত করা হয়নি।”
অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. সামছু-দৌজা নয়ন জানান, বিভিন্ন মাধ্যমে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের খবর শুনেছেন। ঘটনাটি বিস্তারিত জানতে এমএসএফ-হল্যান্ড এর সংশ্লিষ্টদের কাছে ব্যাখা চাওয়া হবে। ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. মো. মাহবুবুর রহমান জানান, ঘটনাটি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। সত্যতা পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কক্সবাজার সদর থানার পরিদর্শক (অপারেশন) মো. সেলিম উদ্দিন জানান, সংঘবদ্ধ ধর্ষণের বিষয়ে ভুক্তভোগী তরুণী বা তার পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। গণমাধ্যমে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী তদন্ত চলছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে আইনি পদক্ষেপ নেয়া হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর বোনকে ধর্ষণের ঘটনা ন্যক্কারজনক ও নিন্দনীয়। হাসপাতালের ভিতরে এমন ঘটনা ঘটলে নারী রোগী ও তার সঙ্গে আসা নারীদের নিরাপত্তার অভাব রয়েছে। এমন ঘটনা ঘটলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দায় এড়াতে পারে না। কেউ দোষী হলে তাকে আইনের হাতে সোপর্দ করা উচিত।
তারা বলেন, হাসপাতালের সুনাম ক্ষুণ্ণ হবার ভয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের গণধর্ষণের মত ভয়াবহ ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছে। দোষীদের লঘু শাস্তিতে পার করে দেওয়া গুরুতর অন্যায়। সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের উচিত ঘটনার তদন্ত করে দোষীদের উপযুক্ত শাস্তির নিশ্চয়তা করা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭১৮
আপনার মতামত জানানঃ