ভারতের করোনা পরিস্থিতির সাথে মিলে যাচ্ছে দেশের বর্তমান অবস্থা। গতকাল শুক্রবার বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বিভাগ জানায় দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় ১৩২ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। অন্যদিকে, নতুন করে ৮ হাজার ৪৮৩ জন কোভিড রোগী শনাক্ত হয়েছেন। আক্রান্তের হার ২৮.২৭ শতাংশ। তার আগের দিন বৃহস্পতিবার আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৪৩ জন, যেটি এ পর্যন্ত একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড। এ নিয়ে গতকাল পর্যন্ত করোনাভাইরাসে পরপর ছয় দিন একশোরও বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটলো। আর এতেই বদলে গেছে দেশের কবরস্থানের চিত্র। আগে থেকেই সারি সারি খুঁড়ে রাখা হচ্ছে নতুন কবর।
সারি সারি কবর লাশের অপেক্ষায়
কবরস্থান জুড়ে ঝকঝকে নতুন নেমপ্লেটে মৃতের নাম। প্রতিদিন লাশ আসছে অসংখ্য। এজন্যই এই কবর খুঁড়ে রাখা। নতুন কোনও লাশ এলেই একে একে পূরণ হবে পাশের খালি কবরগুলো। এই দৃশ্য আগে দেখেনি রায়েরবাজার কবরস্থানটি। এমন আগে কখনও খুঁড়ে রাখা হয়নি কবর। মহামারি বদলে দিয়েছে সব। কবরস্থানে ঢুকলেই এখন জেঁকে ধরছে একরাশ বিষণ্ণতা। অসহায়ত্ব।
সাধারণত মুসলমান কেউ মারা যাওয়ার পরই শুরু হয় দাফনের আনুষ্ঠানিকতা। কবর খোঁড়া থেকে শুরু করে বাঁশ কাটা। কিন্তু রাজধানীর বড় এই কবরস্থানের চিত্র ভিন্ন। আগেই অন্তত ২৫টি কবর খুঁড়ে রাখা হয়েছে করোনা ব্লকে। দেখে মনে হবে, কবরগুলো যেন অপেক্ষা করছে লাশের জন্য।
রায়েরবাজার স্মৃতিসৌধের ঠিক পেছনে কবরস্থানেরও ৮ম ব্লকে ২৫টি কবর তৈরি করে রাখা হয়েছে। পাশেরগুলো সদ্য পূর্ণ হওয়া। খুঁড়ে রাখা কবরে জমে আছে বৃষ্টির পানি। পাশেই মাটির স্তূপ। একটু দূরেই কেটে রাখা হয়েছে বাঁশ। লাশ রাখার ঘরে অপেক্ষা করছেন কর্মীরাও। সাইরেন শুনলেই তারা এগিয়ে যান কবরের দিকে।
জানতে চাইলে কবরস্থানটির সিনিয়র মোহরার আব্দুল আজিজ বলেন, ‘আমরা সব সময় লাশ গ্রহণের জন্য প্রস্তুত। লাশ আসলে কর্মীদের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। তবে আগের তুলনায় এখানে তেমন একটা করোনায় মারা যাওয়া লাশ আসছে না। গত জুন থেকে ১২টি লাশ দাফন হয়েছে।’
পিক এখনও দূরে, পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ এবং মৃত্যু নিয়ে এরই মধ্যে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে আগামী কিছুদিনের মধ্যে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এসব বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এবং মৃত্যুর হার আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
অতীতের প্রবণতা এবং বর্তমান পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে সংক্রামক রোগ বিষয়ক সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর-এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এস এম আলমগীর ধারণা করছেন যে চলতি সংক্রমণের সর্বোচ্চ চূড়ার দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
তিনি বলেন আমার মনে হচ্ছে না এখনও পিক (সর্বোচ্চ চূড়া) এসেছে। পরিস্থিতি দিন-দিন খারাপ হচ্ছে।
গত এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের একদল গবেষক বলেছিলেন যে জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ নাগাদ বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের পিক বা সর্বোচ্চ চূড়া আসতে পারে।
বাংলাদেশ কমো মডেলিং গ্রুপ-এর আওতায় এই গবেষণা করেছেন একদল গবেষক, যারা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কনসোর্টিয়ামের অংশ হিসেবে তা করেন। কমো মডেলিং গ্রুপে পিক বা সর্বোচ্চ চূড়া বলতে দিনে অন্তত ১০/১২ হাজার সংক্রমণ শনাক্ত হওয়াকে বোঝানো হয়।
আইইডিসিআর বলছে, বাংলাদেশে ৩০টির বেশি জেলায় শনাক্তের হার ১০ শতাংশের বেশি। আর ২০টির বেশি জেলায় সংক্রমণের হার ৩০ শতাংশ কিংবা তার চেয়েও বেশি।
এ প্রসঙ্গে আলমগীর বলেন, ঢাকা এবং চট্টগ্রামসহ বড় শহরগুলোতে সংক্রমণের হার আবারও বাড়তে শুরু করেছে এবং এই প্রবণতা আরও কিছুদিন অব্যাহত থাকবে।
তিনি বলেন, যেসব জায়গায় সংক্রমণ এরই মধ্যে অনেক বেশি হয়েছে, সেখানে হয়তো তা কমতে শুরু করবে। আবার নতুন নতুন জায়গায় সংক্রমণের হার বাড়তে থাকবে।
বাংলাদেশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রতিদিন যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করে, তাতে দেখা যাচ্ছে যে ২৮শে জুন থেকে ১লা জুলাই পর্যন্ত চারদিনে কোভিড রোগী শনাক্তের মোট সংখ্যা ৩৩ হাজারের বেশি।
গত চারদিন যাবত দেখা যাচ্ছে, নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় কোভিড রোগী শনাক্তের হার প্রায় ২৫ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি চারজনের মধ্যে একজন আক্রান্ত।
তবে উত্তর-পশ্চিম এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর কোথায়ও কোথায়ও শনাক্তের হার ৬০ শতাংশ পর্যন্ত রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, গ্রামের দিকে সংক্রমণ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে গেছে এবং ভালো চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে না পারলে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেড়ে যাবে। এছাড়া গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্যবিধি বলতে কিছু নাই, এটাই বাস্তবতা।
বর্তমানে জাতীয়ভাবে শনাক্তের হার বাড়তে বাড়তে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত হয়েছে এবং এই হার বেড়ে হয়তো ৩০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। এটাই স্বাভাবিক যে আক্রান্তের সংখ্যা যত বেশি হবে মৃত্যুর সংখ্যা ততই বাড়তে থাকবে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৮২০
আপনার মতামত জানানঃ