পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ধরে নিয়ে গিয়ে পায়ে গুলি করছে। পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন করে মেরে ফেলা হচ্ছে। আইন যতই থাকুক, আইনের প্রয়োগ করতে মানুষ ভয় পাচ্ছে। সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে যেভাবে বিদায় দেওয়া হয়েছে, তাতে একটা বার্তাই দেওয়া হচ্ছে, বেশি বাড়াবাড়ি করা যাবে না। ক্ষমতা ধরে রাখার যত কৌশল আছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্যাতন করা বলে জানিয়েছেন আইনজীবী আসাদুজ্জামান।
জাতিসংঘ ঘোষিত নির্যাতিত ব্যক্তিদের সমর্থনে আন্তর্জাতিক দিবসে গতকাল শনিবার ‘বাংলাদেশে নির্যাতনের পরিস্থিতি, নির্যাতনের শিকার ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণে প্রতিবন্ধকতাসমূহ’ শীর্ষক এক অনলাইন আলোচনা সভায় আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী কমিটির সদস্য আসাদুজ্জামান এ’ কথা বলেন।
এ সময় আসকের মহাসচিব নূর খান জানান, দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে ‘নির্যাতন’ এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে এখান থেকে শুধু মানবাধিকার বা এনজিও ঘরানার কাজ দিয়ে মুক্তি পাওয়ার সুযোগ নেই।
মানবাধিকারকর্মী নূর খান বলেন, সাম্প্রতিক কালে পুরান ঢাকার একজন আইনজীবীকে উঠিয়ে নিয়ে ভয়াবহ নির্যাতন করা হয়েছে। কয়েক বছর আগে খুলনায় ছাত্রদল নেতাকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। এ নির্যাতনের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
তিনি আরও বলেন, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে একজন রাজনৈতিক কর্মী নিখোঁজ হওয়ার পর তাকে ট্রাকচাপা দিয়ে মারা হয়েছে বলে দাবি করেছে ভুক্তভোগীর পরিবার। অথচ এসব হত্যাকাণ্ডকে দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। রাষ্ট্রের তরফ থেকে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। গুম হওয়ার পর দু’একজন গোপনীয়ভাবে মানবাধিকারকর্মীদের কাছে যে বয়ানগুলো দিয়েছেন, তা কল্পনা করা যায় না, কী ধরনের নির্যাতনের শিকার তারা হয়েছেন।
দেশে একটা বিভীষিকাময় অবস্থা চলছে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, তুলে নিয়ে নির্যাতন করবে, মারবে, ধরবে। আর ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে বলতে হবে, নিজে থেকে পালিয়েছিলাম। এ অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হলে শুধু স্ব স্ব প্রতিষ্ঠান উদ্যোগ নিলেও খুব বেশি এগোনো যাবে না। বাংলাদেশের নাগরিক রাজনৈতিক অধিকারের জায়গায় যে ধরনের ব্যত্যয় ঘটছে, এখান থেকে শুধু মানবাধিকার বা এনজিও প্যাটার্নের কাজ দিয়ে মুক্তি পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এমন একটা অবস্থায় আমরা পৌঁছেছি যে স্বাভাবিক অঙ্কের হিসাবে আর চলবে না।
আসকের পরিচালক নীনা গোস্বামী হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরে বলেন, হেফাজতের মৃত্যু ও নির্যাতনের অনেক অভিযোগের বিপরীতে অনেক কম মামলা হয়েছে। অধিকাংশ ভুক্তভোগী বা তার পরিবার নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে আইনের আশ্রয় নেওয়া তথা মামলা করার সাহস পান না। আর অধিকাংশ মামলা তথ্যগত ভুল দেখিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। একটি মামলার রায় হয়েছে। বর্তমানে দুটি মামলার বিচার কার্যক্রম চলমান।
এছাড়া এই আলোচনা সভায় আসকের নির্বাহী পরিচালক গোলাম মনোয়ার কামাল সংবিধানে নির্যাতনকে অবৈধ ঘোষণার তথ্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন, আটক বা গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুলিশ, পুলিশের গোয়েন্দা শাখা, র্যাব বা অন্যান্য রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করার অভিযোগ অহরহ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে।
আসকের সাবেক চেয়ারপারসন আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, মানবাধিকার কমিশন পরিচালনা আমলাদের দিয়ে হবে না। আমলাদের দিয়ে কোনও কমিশন, সেটা দুর্নীতি দমন কমিশন হোক কিংবা মানবাধিকার কমিশনই হোক, সেটা হবে না। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন মানবাধিকার যাতে লঙ্ঘিত না হয়, সেটার জন্য নেই। বরং যাঁরা মানবাধিকার লঙ্ঘন করছেন, তাঁদের সুযোগ করে দিচ্ছে। রডের বদলে বাঁশ দেওয়া হয়। আশ্রয়ণের নামে যে ঘরগুলো করা হচ্ছে, অনেক ঘর কিছুদিনের মধ্যে ভেঙে পড়ছে। এর জন্য জন্য দায়ী আমলা বা প্রশাসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
সাংবাদিক আবু সাঈদ আহমেদ বলেন, সাংবাদিকেরা ভয়ের সংস্কৃতির মধ্যে আছেন। একদিকে করপোরেট হাউসগুলোর দৌরাত্ম্য, যেখানে ব্যবসায়িক স্বার্থ প্রাধান্য পায়, অন্যদিকে অসংখ্য অনলাইন গণমাধ্যম তৈরি হয়েছে, যাদের নীতিনৈতিকতার বালাই নেই। আবার যাঁরা সত্যিকার সাংবাদিক, তাঁরা কাজ করতে পারছেন না নানামুখী চাপের কারণে, তাঁরা আত্মনিয়ন্ত্রণ করতে বাধ্য হচ্ছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ গোলাম সরোয়ার বলেন, ‘হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু আইনে যিনি অভিযোগ করবেন, তাকে সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার যে দুর্বলতা রয়েছে, সেটা আমাদের দেখতে হবে। ফৌজদারি মামলায় সাজার হার মাত্র তিন থেকে চার ভাগ। সাজার হার এত কম থাকা মানেই বিচারব্যবস্থায় মানুষের মধ্যে আস্থার অভাব পরিলক্ষিত হয়। আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা করতে ভয় পাচ্ছি। যারা মামলা করছেন, তাদের অনেকে হয়রানির শিকার হচ্ছেন।’
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৫৯০
আপনার মতামত জানানঃ