রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দায়িত্ব পালনরত ৮৪ শতাংশ ট্রাফিক পুলিশ সদস্যই শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছেন। ‘ট্রাফিক এয়ার পলিউশন অ্যান্ড রেসপিরেটরি হেলথ: অ্যা ক্রস-সেকশনাল স্টাডি অ্যামং ট্রাফিক পুলিশ ইন ঢাকা সিটি (বাংলাদেশ)’ শীর্ষক এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। সম্প্রতি জার্নাল অব মেডিকেল সায়েন্স অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল রিসার্চে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে এ তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গবেষক দল রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দায়িত্বরত ৩৮৪ জন ট্রাফিক পুলিশ সদস্যের কাছ থেকে শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা-সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে। সাক্ষাত্কার হিসেবে সংগৃহীত এসব তথ্যের বিশ্লেষণে দেখা যায়, ট্রাফিক পুলিশের এ সদস্যদের মধ্যে ৮৪ শতাংশই শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত নানা সমস্যায় ভুগছেন।
গবেষক দলের অন্যতম সদস্য হিসেবে ছিলেন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) রিসার্চ ফিজিশিয়ান ডা. সাকিলা ইয়াসমিন। গবেষণা কার্যক্রম বিষয়ে তিনি বলেন, গবেষণার অংশ হিসেবে রাজধানীর মহাখালী থেকে উত্তরা পর্যন্ত সড়কের বিভিন্ন মোড়ে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের সাক্ষাত্কার গ্রহণ করা হয়। আসলে শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা বিষয়টি ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’ উত্তরের মাধ্যমে জানা সম্ভব নয়। এজন্য আমরা তাদের কাছ থেকে কাশি, কফ, নাক দিয়ে পানি পড়া, গলা বন্ধ থাকা ও শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন ধরনের তথ্য সংগ্রহ করি। পরবর্তী সময়ে এসব তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গবেষণায় অংশ নেয়া অধিকাংশ পুলিশ সদস্যই শ্বাসতন্ত্রের সমস্যায় ভুগছেন।
গবেষক দল ট্রাফিক পুলিশের সাক্ষাত্কার গ্রহণের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সড়কের মোড়গুলোয় বাতাসে পিএম ২.৫ ও পিএম ১০-এর মাত্রা পরিমাপ করে। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেসব এলাকায় পিএম ২.৫ ও পিএম ১০-এর মাত্রা বেশি, সেসব এলাকার ট্রাফিক পুলিশের মধ্যে শ্বাসতন্ত্রের সমস্যায় ভোগার হারও বেশি। এ প্রসঙ্গে ডা. সাকিলা ইয়াসমিন বলেন, পুলিশ সদস্যের সঙ্গে কথা বলার শুরুতে, মাঝখানে ও শেষে সাক্ষাত্কারস্থলের পিএম ২.৫ ও পিএম ১০-এর মাত্রার তথ্য সংগ্রহ করা হয়। পরে তা গড় করে স্থানগুলোর বাতাসের মান নির্ণয় করা হয়েছে। এ তথ্য থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে, উচ্চমাত্রার পিএম ২.৫ ও পিএম ১০ রয়েছে এমন স্থানে দায়িত্ব পালন করা পুলিশ সদস্যদের শ্বাসপ্রশ্বাস-সংক্রান্ত সমস্যার হারও অনেক বেশি।
শ্বাসতন্ত্রের সমস্যায় ভোগা ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের মধ্যে ধূমপান-সংক্রান্ত তথ্যও সংগ্রহ করেছে গবেষক দল। বায়ুদূষণের কারণে তৈরি হওয়া শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা ধূমপায়ী ও অধূমপায়ী পুলিশ সদস্যদের মধ্যে প্রায় একই। ধূমপায়ী ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের মধ্যে শ্বাসতন্ত্রের সমস্যায় ভোগার হার ৮৫ দশমিক ৫ শতাংশ। আর অধূমপায়ীদের মধ্যে এ হার ৮৩ দশমিক ২ শতাংশ।
রাজধানীর বিভিন্ন মোড়ে কর্মরত ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেও একই ধরনের চিত্র পাওয়া গেছে। গত এক সপ্তাহে ২৫ থেকে ৩০ জন পুলিশ সদস্যের সঙ্গে কথা বলা হলে তাদের অধিকাংশই শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত বিভিন্ন সমস্যার কথা জানান। কারওয়ান বাজারের সার্ক ফোয়ারায় দায়িত্বরত ট্রাফিক কনস্টেবল মোস্তফা কামালের ভাষ্য, চাকরিতে যোগদানের আগে শ্বাসজনিত কোনো সমস্যা ছিল না। এখন প্রায় সময় শ্বাস নিতে সমস্যা অনুভূত হচ্ছে।
একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা জানান রাজধানীতে কর্মরত এক ট্রাফিক ইন্সপেক্টরও। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, প্রায় ৩৫ বছর ধরে পুলিশে কাজ করছি। ট্রাফিকে যোগদানের শুরু থেকেই শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত নানা সমস্যায় ভুগছি। মাঝখানে কয়েক বছর অন্য দায়িত্বে ছিলাম, তখন এ ধরনের সমস্যা অনেক কমে যায়। এখন ট্রাফিক পুলিশে আসার পর আবার বেড়ে গেছে। বেশির ভাগ সময়ই নাক বন্ধ হয়ে থাকে, গলায়ও সমস্যা হয়।
শ্বাসতন্ত্রের নানা সমস্যা নিয়ে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসেন অনেক পুলিশ সদস্য। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের বক্ষব্যাধি ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. মো. আবু নোমান বলেন, যাদের বাইরে দীর্ঘ সময় ধরে দায়িত্ব পালন করতে হয়, তারাই বেশি শ্বাসজনিত বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছেন। মূলত খারাপ পরিবেশের জন্য তাদের এ সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। এজন্য পুলিশ সদস্যদের যারা বাইরে দায়িত্ব পালন করেন, তাদের সবসময় মাস্ক ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছি, যাতে ধুলোবালি কম লাগে। বাইরে দায়িত্ব পালন করলে সচেতনতার বিকল্প নেই।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগের দায়িত্বে রয়েছেন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. মুনিবুর রহমান। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে এ কর্মকর্তা বলেন, দিনের দীর্ঘ একটি সময় ধরে রাস্তায় দায়িত্ব পালন করতে হয় ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের। একদিকে রোদ-বৃষ্টি, অন্যদিকে বাতাসের দূষণ। এমন পরিবেশে কাজ করতে গিয়ে শ্বাসতন্ত্রের নানা সমস্যায় ভুগতে হয় তাদের। শুধু তা-ই নয়, শব্দদূষণের কারণে শ্রবণ সমস্যায়ও পড়তে হচ্ছে অনেককে। ট্রাফিক পুলিশের একজন সদস্যকে যদি নাগরিক হিসেবে চিন্তা করেন, তাহলে তার নগর সুবিধাটা কোথায়? এ বিষয়গুলো আলোচনায় আনা প্রয়োজন।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফ এ/১৫২৯
আপনার মতামত জানানঃ