রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের করোনা ইউনিটে এক দিনে আরও ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর চলতি মাসের ১৯ দিনে এই হাসপাতালের করোনা ইউনিটে মারা গেছেন ১৯৩ জন। এর মধ্যে শনাক্ত হওয়ার পর মারা গেছেন ১০৫ জন। বাকিদের মৃত্যু হয় উপসর্গ নিয়ে। শনিবার ( ১৯ জুন) রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, এই হাসপাতাল এখন করোনা ভাইরাসের হটস্পটে পরিণত হয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ১১ দিনে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২৩ জন রোগীকে করোনা ইউনিটে স্থানান্তরিত করা হয় এবং বৃহস্পতিবার সর্বোচ্চ ৩৮ জনকে স্থানান্তরিত করা হয়। এই পরিসংখ্যান উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
রামেক হাসপাতালের কর্মকর্তা ও চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, রোগীরা যখন হাসপাতালে প্রবেশ করে তখন তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার সীমিত সুযোগ, সচেতনতার অভাব এবং তাদের পরিচারকদের পাশাপাশি হাসপাতালের কর্মীদের স্বাস্থ্যবিধির প্রতি অবহেলার কারণে এমন ঘটনা ঘটছে।
যেমন- ইউসুফ আলী নেফ্রোলজি বিভাগের একটি ওয়ার্ডে এক সপ্তাহ ধরে চিকিৎসাধীন থাকাকালে গত বুধবার রাতে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। ইউসুফের জামাতা হজরত আলী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘গত ১০ জুন ৫০ বছর বয়সী এই ব্যক্তিকে কিডনি ও ডায়াবেটিসজনিত সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। বৃহস্পতিবার ভোরে তাকে করোনার ইউনিটে স্থানান্তরিত করা হয়।’
আলী আরও বলেন, ‘হাসপাতালে আনার সময় তার কিডনি সমস্যা ছাড়া অন্য কোনো সমস্যা ছিল না। বুধবার হাসপাতালে এক সপ্তাহ পূর্ণ হওয়ার দিনে তার জ্বর এবং কাশি দেখা দেয়। পরে তার নমুনা সংগ্রহ করা হয় এবং পরীক্ষা করে দেখা যায় তিনি কোভিড-১৯ পজিটিভ।’
মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মো. খলিলুর রহমান জানান, তার ওয়ার্ডগুলোতে সবচেয়ে বেশি রোগীদের করোনার ইউনিটে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের ওয়ার্ডে আসা বেশিরভাগ রোগীর করোনার কোনো উপসর্গ থাকে না। তারা ডায়রিয়া বা পেট ব্যথা নিয়ে আসে, কিন্তু শেষে দেখা যায় তারা সংক্রমিত হয়েছেন। বেশিরভাগই বাইরে থেকেই সংক্রমিত হয়ে আসেন।’
হৃদরোগ বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক মো. রইস উদ্দিন জানান, হাসপাতালে প্রবেশের সময় সংক্রমিত রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা এ জাতীয় পরিস্থিতি রোধ করতে পারত।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, জেনে বা অজান্তেই সংক্রমিত রোগীরা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন এবং ভর্তি রোগীরা হাসপাতালের কর্মী বা অন্য রোগীদের দ্বারা সংক্রমিত হচ্ছেন। একই হাসপাতালে সব ধরণের রোগীদের চিকিৎসা দিতে গেলে এই ধরনের ঘটনা এড়ানোর কোনো উপায় নেই।
সরকারি রামেক হাসপাতালে মোট ৫৬টি ওয়ার্ডে ১২০০ শয্যা আছে। সেখানে রাজশাহী বিভাগের আট জেলা এবং খুলনা বিভাগের অনেক জেলা থেকে রোগীরা চিকিৎসা নিতে যান।
গত বছর মার্চে দেশে করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে উত্তর অঞ্চলের বৃহত্তম এই হাসপাতালে সাধারণ রোগের কিছু ওয়ার্ড কমিয়ে একটি করোনা ইউনিট খোলা হয়েছে এবং ধীরে ধীরে এটি প্রসারিত করা হয়েছে।
সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর করোনা রোগীদের ভিড় সামাল দিতে রামেক হাসপাতালের করোনার ইউনিটে এখন ১১টি ওয়ার্ডে ৩০৯টি শয্যা রয়েছে। এর মধ্যে করোনা আক্রান্ত গুরুতর রোগীদের চিকিত্সার জন্য ২০ শয্যার আইসিইউ ইউনিটও আছে।
করোনায় ৭ শতাধিক মৃত্যু
রাজশাহী বিভাগে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ৭ শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এ পর্যন্ত সরকারি হিসেবে মৃত্যু হয়েছে ৭১০ জনের। তবে প্রকৃত সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
রাজশাহী বিভাগের ৮ জেলায় শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘন্টায় নতুন করে ৮১৮ জনের মধ্যে করোনা শনাক্ত হয়েছে। এই সংখ্যা শনাক্ত হয়েছে র্যাপিড এন্টিজেন টেস্ট ও ল্যাব টেস্টের মাধ্যমে; সেই সঙ্গে বিভাগের মধ্যে সর্বোচ্চ ৩৫৯ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে রাজশাহী জেলায়।
এদিকে প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকে শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত রাজশাহী বিভাগে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৮ হাজার ১০৯ জন। বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের দপ্তর সূত্র মতে, ঈদের পর চাঁপাইনবাবগঞ্জ করোনার হটস্পট হয়ে উঠলেও পরে হয়েছে রাজশাহী। বর্তমানে বিভাগের নওগাঁ, বগুড়া, নাটোর, সিরাজগঞ্জ ও পাবনা জেলাতেও সংক্রমণ বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। বিভাগে সংক্রমণের হার ৩০ ভাগের উপরে যা সারা দেশের গড় সংক্রমণের তুলনায় শতকরা ১৫ ভাগ বেশি।
রাজশাহী বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বিভাগে করোনা মৃত্যু ৭১০ জনের মধ্যে সর্বোচ্চ ৩৪০ জন বগুড়ার বাসিন্দা। বগুড়ায় প্রথম দফাতেই মৃত্যু হয় সবচেয়ে বেশি। তার পরে রাজশাহীতে ১২০ জন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৮৭ , নওগাঁ জেলায় ৬০, নাটোরে ৩৯, সিরাজগঞ্জে ২৭ পাবনায় ২২ এবং জয়পুরহাটে ১৭ জন করোনায় মারা গেছেন।
শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় শুধুমাত্র রাজশাহী মেডিকেলে মারা গেছেন ১০ জন। এর মধ্যে পাঁচজন চাঁপাইনবাবগঞ্জে ও রাজশাহীর পাঁচজন।
এদিকে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে এখনো সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি চলছে বলে জানিয়েছেন বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাবিবুল আহসান তালুকদার।
এই দুই জেলায় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সামাজিক সংক্রমণ ঘটায় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসনে সময় লাগছে। এছাড়া বিভাগের অন্যান্য জেলাতেও ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণের আশঙ্কা দেখা গেছে। কারণ রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের পার্শ্ববর্তী জেলাগুলির সংক্রমণের হার গত এক সপ্তাহে ঊর্ধ্বমুখী।
এসডব্লিউ/এমএন/এফএ/১৫৫৯
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ