অভিনেত্রী পরীমনির মামলার এজাহারে নাম ছিল না নাসির উদ্দিন মাহমুদকে গ্রেপ্তার করার সময় আটক তিন নারীর। তবুও নাসির উদ্দিন মাহমুদ, তুহিন সিদ্দিকী অমি ও এই তিন নারীকে গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। তাদের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে মাদক মামলায়। এর মধ্যে আরও একটি বিতর্কিত প্রসঙ্গ, এই তিন নারীকে গ্রেপ্তারের পর পরই কোনপ্রকার তদন্ত ছাড়াই পুলিশ দাবি করেছে, তারা নাসির ও অমির ‘রক্ষিতা’। পুলিশের এহেন কাজকর্মের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী ও নারী নেত্রীরা। তারা প্রশ্ন তুলেছেন, একজন নামকরা অভিনেত্রীকে ন্যায় বিচার দিতে গিয়ে অন্য তিন নারীর সঙ্গে অন্যায় করা হচ্ছে না তো?
এ প্রসঙ্গে সিনিয়র আইনজীবী শাহদীন মালিক গণমাধ্যমকে বলেন, “পুলিশ যা পারে না, তার সবগুলোই করে। পুলিশ কী পারে, আর কী পারে না তার অনেক আইন আছে। অনেকে সেই আইন জানে না। জানলেও তোয়াক্কা করে না। আমরা এগুলো মেনে নিতে নিতে তারা যা ইচ্ছে তাই করছে। আমাদের সংবিধানে বলা আছে, কারো সঙ্গে অমানবিক আচরণ ও ব্যবহার করা যাবে না। এ নিয়ে সুপ্রীম কোর্টের রায়ও আছে। এখন কাউকে গ্রেপ্তারের পর এই ধরনের ‘উপাধি’ দেওয়া তো মানবিক আচরণের পর্যায়ে পড়ে না।”
“সহযোগী আর রক্ষিতার মধ্যে কিন্তু অনেক পার্থক্য আছে। রক্ষিতা বলা কিন্তু অত্যন্ত আপত্তিকর। পরীমনিকেও তো নানাভাবে হেনস্তা হতে হয়েছে। তার মামলা তো পুলিশ প্রথমে নিতে চায়নি।”
এদিকে, কোন অপরাধ ভাইরাল হয়ে গেলে আমাদের পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কমিক বুকের সুপারহিরো হয়ে ওঠা খুব স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অপরাধীকে গ্রেপ্তার করতে তখন তাদের মাত্র কয়েক ঘণ্টা বা কয়েক দিন লাগে। পরীমনির মামলার পর অনেকটা সেরকমই ঘটেছে। এমনকি পরীমনি গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশীদকে উল্লেখ করে বলেন, ‘স্যার অনেকটা ম্যাজিকের মতো সবকিছু করেছেন। এতোটা তাড়াতাড়ি ম্যাজিকের মতো পুলিশ আমাকে সহযোগিতা করবে সেটা আমি ভাবতে পারিনি। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দেখলাম অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমার বিশ্বাস সঠিক বিচার পাবো।’
তবে অন্যক্ষেত্রে মামলা না নেয়া থেকে শুরু করে, তদন্তে ঢিলেমি, তদন্ত প্রতিবেদনে জমা দিতে কয়েক বছর নেয়ার মতো ঘটনা ঘটছে অহরহ। এমনকি নাম এক হওয়ায় ভুল ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের কৌশল তাদের কাছে থেকে বাইরের দেশের পুলিশদের শিখে নেয়া উচিত।
পুলিশের আত্মপক্ষ সমর্থন
পরীমনির অভিযোগের ভিডিও ভাইরাল হবার পর গত সোমবার দুপুরে সাভার থানায় তিনি মামলা করেন। এর দুই ঘন্টার মধ্যে পুলিশ উত্তরায় অমি’র বাসায় অভিযান চালিয়ে নাসির উদ্দিন মাহমুদ, তুহিন সিদ্দিকী অমি ও তিন নারীকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের পর সাংবাদিকদের সামনে অভিযানের বিষয়ে বলতে গিয়ে ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেন, ‘যে তিন নারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তারা নাসির ও অমির রক্ষিতা। তাদের বিরুদ্ধেও মামলা করা হচ্ছে।’
গ্রেপ্তারের পরই কাউকে ‘রক্ষিতা’ বলা কতটা ন্যায়সঙ্গত, সে বিষয়ে হারুন অর রশীদ গণমাধ্যমকে বলেন, “এরা তো কেউ নাসির বা অমির স্ত্রী না। তাহলে এদের পরিচয় কী? এই মামলার তদন্ত চলছে, তদন্ত শেষ হলে বলা যাবে।” তদন্ত শেষ হলেই যদি বলা যাবে, তাহলে তদন্তের আগে গ্রেফতারের পরপরই কেন ‘রক্ষিতা’ বলা। কাউকে সামাজিকভাবে হেয় করা কি অপরাধের মধ্যে পড়ে না? নাকি পুলিশের যে কাউকে সামাজিকভাবে হেয় করার বৈধতা আছে।
যদিও এই তিন নারী সম্পর্কে গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, নাসির উদ্দিনের একজন প্রতিবেশী দাবি যে এই নারীদের একজন অমির দ্বিতীয় স্ত্রী। আর একজন তাদের বাড়িতে কাজ করেন। নাসির উদ্দিন মাহমুদের প্রতিবেশী নারী উদ্যোক্তা দেবী গাফফার এই তিন নারী গ্রেপ্তারের প্রসঙ্গে গণমধ্যমকে বলেন, “গ্রেপ্তারের পর আমি নাসির উদ্দিনের ছেলের সঙ্গে কথা বলেছি। সে আমাকে বলেছে, এই তিন নারীর একজন অমির দ্বিতীয় স্ত্রী। আরেকজন বাড়ির কাজের মানুষ। অন্যজনকে তারা চেনে না। এখন তাদের পরিচয় যাই হোক না কেন, পুলিশ গ্রেপ্তারের পরপরই কোন তদন্ত না করে তাদের কী রক্ষিতা বলতে পারে? পরীমনির ঘটনার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কী?
তবে এর বিপরীতে আবার পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, “অমি আমাদের কাছে বলেছে, এর মধ্যে কেউ তার স্ত্রী না। কাজের লোকের কথাও বলেনি। ফলে অন্য কে কী বলল, সেটা দিয়ে তো হবে না।” তবে আমাদের পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কবে থেকে অপরাধী বা অভিযুক্তর কথা এতো সিরিয়াসলি নিচ্ছে, সেটা আমাদের জানা নেই!
রক্ষিতা বলা কি পুলিশের শাস্তিযোগ্য অপরাধ?
এই তিন নারীকে ঘিরে তৈরি হচ্ছে প্রশ্নের জাল। কেন তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে একপক্ষ এই নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। অন্যদিকে বড় একটি অংশ তিন নারীকে ঘিরে পুলিশের আপত্তিকর মন্তব্য নিয়ে জোর প্রতিবাদ জানাচ্ছে। তাদের দাবি, ঘটনার সময় তারা সেখানে ছিল না। পরীমনির করা মামলায় তাদের নামও নেই। তবুও কেন এই হয়রানি!
সুপ্রীমকোর্টের প্রবীণ আইনজীবী মনসুর হাবিব এ প্রসঙ্গে বলেন, “ওই তিন নারীকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ তাদের নিয়ে যা বলেছে, সেটা দুভার্গ্যজনক। পুলিশ এটা বলার এখতিয়ার রাখে না। আইনগতভাবে এটা বলার সুযোগ নেই।”
বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপ্রধান অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, “কোন নারীকে গ্রেপ্তারের পর এই ধরনের শব্দ ব্যবহার করা খুবই অন্যায়। আইনজীবী হিসেবে আমি বলতে পারি, একজন নারীকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ কোনভাবেই এই ধরনের মন্তব্য করতে পারে না। আমি মনে করি এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।”
এ প্রসঙ্গে মানবাধিকার কর্মী ও নারীনেত্রী খুশি কবীর বলেন, “সহযোগী আর রক্ষিতার মধ্যে কিন্তু অনেক পার্থক্য আছে। রক্ষিতা বলা কিন্তু অত্যন্ত আপত্তিকর। পরীমনিকেও তো নানাভাবে হেনস্তা হতে হয়েছে। তার মামলা তো পুলিশ প্রথমে নিতে চায়নি। এখন এই তিন নারীর বিষয়টি আপনারা যেভাবে ভাবছেন, ওভাবে হয়ত কেউ ভাবেনি। তাদের তো কোন দোষ নেই। ফলে এই তিন নারীর বিষয়ে নারী সংগঠনগুলোকে ভূমিকা নিতে হবে।”
কী পরিচয় ওই তিন নারীর?
গ্রেপ্তার হওয়া এই তিন নারীর পুরো পরিচয় জানা যায়নি। এমনকি তাদের গ্রেপ্তারের পরও পরিবারের কোন সদস্য আইনজীবীর সঙ্গেও যোগাযোগ করেনি।
নাসির উদ্দিন মাহমুদ ও তুহিন সিদ্দিকী অমির আইনজীবী ঢাকা বারের সভাপতি আব্দুল বাতেন বলেন, “নাসির উদ্দিন ও অমির পরিবারের লোকজন আমার সঙ্গে কথা বলে তাদের পক্ষে দাঁড়াতে বলেছেন। তবে ওই তিন নারীর পরিবারের কোন সদস্য আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।”
সোমবার রাজধানীর উত্তরা-১ নম্বর সেক্টরের-১২ নম্বর রোডের বাসায় অভিযানের পর ওই দিন রাতে বিমানবন্দর থানায় পুলিশ যে মাদক আইনে মামলা করেছে, সেখানেও এই তিন নারীর পুরো পরিচয় উল্লেখ করা হয়নি। শুধু তাদের নাম লেখা রয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৫৫১
-State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ