স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা পূর্বাভাস দিয়েছেন যে, দেশে ভারতীয় ধরন ছড়িয়ে পড়লে জুন মাসের শেষ দিকে কোভিড-১৯ সংক্রমণ চরম আকার ধারণ করতে পারে। সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে করোনার ভারতীয় ধরনের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার কারণে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন জুনের শেষের দিকে বাংলাদেশ করোনা ভাইরাসের সবচেয়ে খারাপ প্রাদুর্ভাবের মুখোমুখি হতে পারে।
তারা বলছেন, ভারতীয় ধরন হিসাবে পরিচিত বি-১.৬১৭ সীমান্তবর্তী জেলাগুলি থেকে অন্যান্য অঞ্চলে প্রবেশ করতে পারলে, জুলাইয়ের প্রথম দিকে বাংলাদেশে প্রতিদিন ২০,০০০ এরও বেশি আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, মৃত্যুর হারও বাড়তে পারে তীব্র আকারে।
যদিও কয়েকদিন ধরে দেশটির গড় কোভিড পজিটিভিটি হার ছিল ৮ দশমিক ১৫%, তবে ভারতীয় সীমান্তের বিভিন্ন জেলায় এটি খুব বেশি ছিল।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ ৫৫% সংক্রমণ হারের সাথে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ জেলা এবং ইতোমধ্যে স্থানীয় প্রশাসনকে সাত দিনের কঠোর লকডাউন দিতে বাধ্য করেছে।
সাতক্ষীরা, যশোর, ঝিনাইদহ, দিনাজপুর, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, সিলেট ও মৌলভীবাজারের মতো সীমান্তবর্তী কয়েকটি জেলায়ও সংক্রমণের হার বেশি।
ইউএনবির সাথে আলাপকালে ডিজিএইচএসের মুখপাত্র রুবেদ আমিন বলেছেন, ভারতের মারাত্মক ধরনটি ইতিমধ্যে দেশে প্রবেশ করেছে এবং সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে ভাইরাসটির পূর্ণ মাত্রায় প্রাদুর্ভাব হতে পারে।
তিনি বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী ও যশোরসহ সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে করোনার ভারতীয় ধরনে আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে।
বলেন, এটি উদ্বেগজনক খবর। এই ধরনটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে লোকজন যদি স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মেনে না চলে এবং মাস্ক ব্যবহারের প্রতি অবহেলা প্রকাশ করে তবে সংক্রমণের হার মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে।
ডিজিএইচএসের প্রাক্তন পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ বে-নাজির আহমেদ বলেন, পশ্চিমবঙ্গে ১৫,০০০ এরও বেশি সহ বেশ কয়েকটি সপ্তাহ ধরে ভারত ৩ লাখেরও বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। ভারতীয় ধরনের কারণে নেপালেও ৮,০০০ -৯,০০০ আক্রান্ত দেখা গেছে। সুতরাং, যদি এই ধরনটি সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে তবে আমরা পরের মাসের শেষের দিকে বা জুলাইয়ের শুরুতে প্রতিদিন ২০,০০০ এরও বেশি আক্রান্তের রেকর্ড করতে পারি।
“সরকার যদি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয় এবং লোকজনদের মাস্ক পরতে বাধ্য করতে না পারে এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষা নির্দেশিকা মেনে না চলে তবে দৈনিক আক্রান্ত আরও বেড়ে ৪০,০০০ হতে পারে।”
বাংলাদেশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডা তিন দেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের একটি গ্রুপ বাংলাদেশ কমো মডেলিং গ্রুপ (বিসিএমজি) ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যে, ঈদের ছুটি কাটানোর জন্য গ্রামের বাড়িতে যেতে চাওয়া মানুষের ঢেউয়ে ব্যাপক জমায়েত হবার কারণে, একইসাথে দেশে ভারতীয় ধরন ছড়িয়ে পড়ার কারণে আগামী জুনের মাঝামাঝি বা সেই মাসের শেষের দিকে দেশটি করোনাভাইরাসের মারাত্মক আক্রমণের মুখোমুখি হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহ ও অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবার অভাব পরিস্থিতি আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
এদিকে বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে অনেক বাংলাদেশী বৈধ পথে আসা-যাওয়া করলেও অনেকে অবৈধভাবে সীমান্ত পেরিয়ে আসা-যাওয়া করছেন। যারা অবৈধ পথে আসা-যাওয়া করেন তাদের সবসময় ধরা যায় না। ফলে তাদের মাধ্যমে সংক্রমণ কতটা ছড়িয়ে যাচ্ছে সেটি নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে।
অধ্যাপক ইকবাল কবির বলেন, সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে ব্যাপক হারে করোনাভাইরাসের পরীক্ষা করাতে হবে। কিন্তু সেটি হচ্ছে না। মানুষ আমাদের কাছে এসে টেস্ট করাবে – এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমাদের আগ্রহী হয়ে মানুষের কাছে গিয়ে টেস্ট করাতে হবে। একমাত্র টেস্টই পারে সংক্রমণ কমাতে, বলেন অধ্যাপক কবির।
ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলা ভারতের সীমান্তের সাথে যুক্ত। সে এলাকা দিয়ে অনেকে অবৈধ পথে ভারতে আসা-যাওয়া করে। ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার একজন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি গণমাধ্যমকে বলেন, অবৈধ পথে কিছু মানুষ এখনো ভারতে যাওয়া-আসা করছে। চলতি মে মাসে ভারত থেকে অবৈধ পথে বাংলাদেশে ঢোকার সময় অন্তত ৩০ জনকে আটক করেছে বিজিবি।
ঝিনাইদহের সিভিল সার্জন সেলিনা বেগম গণমাধ্যমকে বলেন, ভারত থেকে যারা আসছে তাদের টেস্ট এবং কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা হচ্ছে। সে জেলায় এখন করোনাভাইরাস শনাক্তের হার ১০ শতাংশের মতো বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তবে ডাঃ বে-নাজির আহমেদ মনে করেন, সীমান্তবর্তী জেলাগুলি এখন ভারতীয় ধরন বিস্তারকে কেন্দ্র করে ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কিছুটা কম দেখছে।
তিনি বলেন, ভারতের মতো একই দৃশ্য বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করবে কিনা তা এখনও বলা মুশকিল। আমরা পরিস্থিতিটি এক বা দুই সপ্তাহ পরে পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারব। এটি প্রাদুর্ভাবের স্তর এবং সরকারের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার উপর নির্ভর করে।
তিনি বলেন, আমরা যদি বড় শহরগুলিতে ছড়িয়ে পড়ার আগে কঠোর লকডাউন প্রয়োগ করে স্থানীয়ভাবে ভারতীয় ধরন আটকে দিতে পারি তবে আমরা ভারত এবং নেপালের মতো বিপজ্জনক পরিস্থিতি নাও দেখতে পারি।
ডাঃ বি-নাজির বলেন, প্রথমে যে অঞ্চলে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে সে অঞ্চলে ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের জন্য আমাদের চেষ্টা চালাতে হবে যাতে এটি দেশের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে না পারে। ভারতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত আমাদের অবশ্যই কঠোর নজরদারি দিয়ে সীমান্ত বন্ধ রাখতে হবে।
তিনি বলেন, সরকারের তাৎক্ষণিকভাবে কিছু সম্ভাব্য কোভিড-১৯ পরিস্থিতি নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা উচিত এবং সেগুলি মোকাবেলায় প্রস্তুত হওয়া উচিত।
তিনি বলেন, অক্সিজেন, উচ্চ-প্রবাহের অনুনাসিক কাননুলা অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটারগুলি জেলা এবং কেন্দ্রীয় হাসপাতালগুলোতে থাকতে হবে, বিভাগীয় হাসপাতালে পর্যাপ্ত অক্সিজেন এবং আইসিইউ বেড নিশ্চিত করতে হবে যাতে ৯৫% রোগী তাদের নিজস্ব বিভাগ বা জেলাগুলিতে চিকিৎসা পান।
তিনি বলেন, পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে উঠলে সরকারের অক্সিজেনের চাহিদা নির্ধারণ করা উচিত এবং অক্সিজেন আমদানি করে স্থানীয় উৎপাদন বাড়িয়ে তা পূরণের জন্য এখন থেকে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। সরকারকে এখন সেই দেশগুলির সাথে যোগাযোগ করা উচিত যেখানে প্রয়োজনের সময় অক্সিজেন আমদানি করতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩২১
–State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ