মিয়ানমার জান্তা প্রধান প্রথমবারের মতো গত রোববার (২৩ মে) চীনা ভাষার ফোয়েনিক্স টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রোহিঙ্গাদের ফেরা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। গত ১ ফেব্রুয়ারি সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখলের পর এই প্রথম তিনি কোনো গণমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দেন।
সাক্ষাৎকারে তিনি আবারও দাবি করেছেন, বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা কোনো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত নয়।
তার ভাষ্যমতে, ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতালাভের পরই রোহিঙ্গাদের উত্থান।
সোমবার বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
মিন অং হ্লাইং বলেন, ‘আমরা স্বাধীনতা অর্জনের পর আদমশুমারিতে ‘বাঙালি’, ‘পাকিস্তানি’, ‘চট্টগ্রাম’ শব্দ নিবন্ধন করা হয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গা বলতে কোনো শব্দ ছিল না। তাই আমরা এটি কখনো গ্রহণ করিনি।’
মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গাদের বাঙালি বলে মনে করে। তাদের মতে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকে আসা বহিরাগত। যদিও অনেক রোহিঙ্গাই শত বছর ধরে সেখানে বসবাস করছে।
২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী নৃশংস নির্যাতন চালায়। জাতিসংঘের তদন্তকারীরা একে গণহত্যার উদ্দেশ্যে হত্যাযজ্ঞ বলে আখ্যায়িত করেছেন। নির্যাতন থেকে জীবন বাঁচাতে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বানের পানির মতো এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। এসব রোহিঙ্গাদের কি রাখাইনে ফেরত যেতে অনুমোদন দেয়া হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে মিন অং হ্লাইং পাল্টা প্রশ্ন করেন। তিনি বলেন, যদি এক্ষেত্রে মিয়ানমারের আইন না মানা হয়, তাহলে কী করার আছে? তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি না পুরো বিশ্বের মধ্যে এমন কোনো দেশ আছে, যারা তাদের নিজেদের শরণার্থী বিষয়ক আইনকে অতিক্রম করে শরণার্থীদের আশ্রয় দেবে।
রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আহ্বানেও কাজ হবে না বলে সাক্ষাৎকারে ইঙ্গিতে জানান মিন অং হ্লাইং। তাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে মুখে কোনো জবাব না দিয়ে মাথা নাড়েন মিয়ানমারের এই জান্তা।
২০১৭ সালে ২৫ আগস্ট রাখাইনে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর বেশ কয়েকটি চৌকিতে হামলা হয়। এর জের ধরে সেখানে সহিংস অভিযান শুরু করে মিয়ানমারের সেনা ও পুলিশ। গুলি-আগুনে নিহত হয় হাজারো রোহিঙ্গা। অভিযানের মুখে প্রাণভয়ে সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আসে। তখন সেনাপ্রধানের দায়িত্বে ছিলেন মিন অং হ্লাইং।
গত বছরের নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি নেতৃত্বাধীন সরকারকে গত ১ ফেব্রুয়ারি ক্ষমতাচ্যুত করে মিন অং হ্লেইংয়ের সামরিক বাহিনী। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যখন গণহত্যা চালানো হয় সেই সময় অং সান সু চিও সেনাবাহিনীর পক্ষে সাফাই গেয়েছিলেন।
রোহিঙ্গা গণহত্যায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে সমর্থনের অভিযোগে তৎকালীন স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চিও আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়েছেন। তবে সু চি ও দেশটির সেনাবাহিনী এই অভিযোগ অস্বীকার করে দাবি করেছে, রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে বৈধ অভিযান চালালে শরণার্থীরা বাংলাদেশে পালায়।
অভ্যুত্থানের পরপরই মিন অং হ্লেইং বলেছিলেন, বাংলাদেশ থেকে শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে। কিন্তু মিয়ানমার সেনাপ্রধানের এই ঘোষণার পরও রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে কোনও ধরনের অগ্রগতির লক্ষণ এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি। যদিও অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়ার পর দেশটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কঠিন লড়াই করতে হচ্ছে সামরিক জান্তা সরকারকে।
বর্তমানে সব মিলিয়ে এখন ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে নোয়াখালীর ভাসানচর এবং কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে। আশ্রয় নেয়া এসব রোহিঙ্গাদের নিজদেশে ফেরাতে কয়েক দফা আলোচনা এবং দুবার প্রত্যাবাসনের তারিখও ঠিক হয়। কিন্তু মিয়ানমার সরকারের অনীহায় তা ভেস্তে যায়।
আর এখন করোনা পরিস্থিতি ও মিয়ানমারে জান্তা সরকার ক্ষমতায় আসার পর আন্দোলনের কারণে প্রত্যাবাসন নিয়ে নেই কোনো আলোচনা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও নেই কোনো উদ্যোগ। তবে রয়টার্স জানিয়েছে, চীনের সহায়তায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের মধ্যে পুনরায় আলোচনা শুরু প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গত ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলে নেয় জান্তা। আটক করা হয় স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি ও প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টকে। অভ্যুত্থানের কয়েক দিন পর থেকেই জান্তাবিরোধী বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে পুরো মিয়ানমার। বিক্ষোভকারীদের দাবি সুস্পষ্ট, সেনাশাসন প্রত্যাহার এবং সু চিসহ সব রাজবন্দীর মুক্তি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৪৬
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ