প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করছেন খুনের আসামি বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজ ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রউফ। গত ২ মে নিজের সহযোগী ক্যাডারদের নিয়ে রউফ কক্সবাজারে প্রমোদ ভ্রমণে যান। অথচ জেলা পুলিশের একাধিক ইউনিট বলছে, রউফসহ হত্যাকাণ্ডে জড়িত তার সহযোগী ক্যাডারদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
গত ১১ মার্চ বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম-সম্পাদক তাকবীর ইসলামকে খুনের ঘটনার পর প্রায় দুই মাস অতিবাহিত হয়ে হলেও এখনও গ্রেফতার হননি ক্যাডাররা।
আ’লীগ নেতাদের আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে রউফ
সূত্র মতে, গত এক মাস ধরে আব্দুর রউফ তার নিজ গ্রাম বগুড়া ধুনটের বিলচাপড়ি গ্রামেই অবস্থান করেন। পাশের গ্রাম শাজাহানপুরের শৈলধুকরী গ্রামে তার খালার বাড়ি। রাতে সেখানে তাকবীর হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়া আরও আট সহযোগী নিয়ে রউফ অবস্থান করেন।
প্রতিদিনই তিনি তিনটি মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে ধুনট উপজেলা সদরে এসে মহড়া দেন বলে জানিয়েছেন একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী। তাদের ভাষ্য অনুসারে বেপরোয়া রউফ পুলিশকে কখনও পরোয়া করেননি। কারণ বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবর রহমান মজনু ও দফতর সম্পাদক আল রাজি জুয়েলসহ বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে তার সখ্যতা রয়েছে। এ কারণে কাউকে ভয় করেন না রউফ।
উল্টো জেলা ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর তার আস্থাভাজন নেতাদের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দলের অন্য কোনও অঙ্গসংগঠনে প্রবেশ করার চেষ্টা করছেন। এদিকে, ধুনট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কৃপা সিন্ধু বালা বলেন, তার এলাকায় খুনি রউফের অবস্থান সম্পর্কে তিনি কোনও তথ্য জানেন না। এমনকি রউফ এবং তার সহযোগীরা আদালত থেকে আগাম জামিন নিয়েছেন বলেও তার জানা নেই।
পরিবর্তে নির্দোষ ব্যক্তিকে গ্রেফতার
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চাঞ্চল্যকর এই মামলায় পুলিশ আল-আমিন নামের যাকে গ্রেফতার করে জবানবন্দি রেকর্ড করে তার নাম এজাহারে উল্লেখ নেই। যে কারণে অভিযোগ উঠেছে হত্যাকাণ্ডে জড়িত এজাহারভুক্ত আসামিকে গ্রেফতার করে জবানবন্দি রেকর্ড না করে মামলার বাইরের একজনকে গ্রেফতার করে জবানবন্দি নেয়া হয়েছে।
জানা যায়, বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম-সম্পাদক তাকবির ইসলাম খানকে চাপাতি দিয়ে আঘাতকারীদের একজন আল আমিন (২৪) হত্যার দায় স্বীকার করেন। গত ১৮ মার্চ তিনি অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আহমেদ শাহরিয়ার তারিকের আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। সিসিটিভি ফুটেজে শনাক্ত করার পর তাকে কাহালু থেকে গ্রেফতার করা হয়।
তবে তাকবীরের বাবা জহুরুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, পুলিশ আল-আমিন নামে যাকে গ্রেফতার করে জবানবন্দি রেকর্ড করেছে তার নাম এজাহারে নথিভুক্ত নেই। এতে করে আমরা সন্দেহ করছি রউফ এবং তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে চার্জশিট হলেও আদালত থেকে তাদের সহজে মুক্তি পেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আল-আমিনের জবানবন্দি
১১ মার্চ সন্ধ্যায় বগুড়া শহরের প্রাণকেন্দ্র সাতমাথায় প্রকাশ্যে ছাত্রলীগ নেতা তাকবীর খুনের মিশনে রউফ সরাসরি অংশ নেন এবং নেতৃত্ব দেন। আর এই খুনটি ছিল পূর্ব পরিকল্পিত। বেশ কয়েকটি এলাকার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ, নিহত তাকবীরের জবানবন্দি, প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা এবং ১৬৪ ধারার জবানবন্দি সবকিছুই রউফের বিপক্ষে রয়েছে।
গ্রেফতার হওয়া আল-আমিন পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বীকার করেছেন ১১ মার্চ সন্ধ্যায় রউফসহ অন্যান্যরা আজিজুল হক কলেজের পাশে ওয়াপদা গেটে একত্রিত হন। এরপর ২৫-৩০ জন মিলে মোট ১০টি মোটরসাইকেলে করে তাদেরকে সাতমাথায় নিয়ে আসেন। খুনের প্রস্তুতিস্বরূপ সবার হাতেই লোহার রড, পাইপ ও ধারালো অস্ত্র ছিল। এরপর সাতমাথায় আগে থেকে বসে থাকা তাকবীর ও তার সহযোগীদের ওপর অতর্কিত হামলা চালানোর নির্দেশ দেন রউফ।
এসময় তার হাতে থাকা চাপাতি দিয়ে তাকবীরকে প্রথম কোপ দেয়ার পর রক্তমাথা চাপাতিটি সরিয়ে ফেলার জন্য রউফ আল-আমিনের হাতে দেন। পরে তারা আবার কলেজে ফিরে আসেন।
কেন হত্যা করা হয় তাকবীরকে?
বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক এবং শহরের মালতিনগর এলাকার বাসিন্দা তাকবীর ইসলাম। দলের সভাপতি পদের প্রার্থিতার দ্বন্দ্বে তুচ্ছ ঘটনায় ১১ মার্চ প্রতিপক্ষের হামলায় আহত হয়ে ১৬ মার্চ তিনি মারা যান।
ঘটনার পর বগুড়া আজিজুল হক কলেজ শাখার ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রউফ (সদ্য বহিষ্কৃত), তার সহযোগী ক্যাডার জাহিদ, আনোয়ার, তারেকসহ একাধিক জনকে অভিযুক্ত করে মামলা করা হয়। এদিকে, রউফ প্রথমে চেষ্টা করেন মামলা দায়ের করা থেকে বাদীপক্ষকে বিরত রাখতে। এ কারণে তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবর রহমান মজনুকে দিয়ে জেলার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কাছে ফোন করান। সেটি সম্ভব না হলে এখন চেষ্টা করছেন চার্জশিটে হুকুমের আসামি হওয়ার জন্য।
কেন গ্রেফতার হচ্ছে না রউফ?
তাকবীরের মা আফরোজা ইসলাম বলেন, বিচার নিয়ে সংশয়ে আছি। ক্ষমতাসীন দলের অনেকেই মামলাটি আপস করে নেয়ার হুমকি দিচ্ছে। আবার পুলিশের অবহেলার কারণে মূল আসামিসহ অন্যরাও গ্রেফতার হচ্ছে না। এরপরও আশায় আছি ন্যায়বিচার পাব। তাকবীরের বাবা জহুরুল ইসলাম বলেন, আমার ছেলে মেধাবী ছিল। ভালো রাজনীতি বুঝত। তাকে প্রকাশ্যে খুন করা হল। যেভাবে মামলাটি নিয়ে চক্রান্ত চলছে তাতে আমরা বিচার পাব কি-না সন্দিহান।
মামলাটি বর্তমানে তদন্ত করছেন সদর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আব্দুল মালেক। তিনি বলেন, তাকবীর হত্যা মামলাটির তদন্ত শেষ পর্যায়ে। মামলার ১ নম্বর আসামি আব্দুর রউফের হত্যাকাণ্ডে সরাসরি সংশ্লিষ্টতা তদন্তে পাওয়া গেছে। শিগগিরই মামলাটির চার্জশিট আদালতে দাখিল করা হবে।
আসামিরা গ্রেফতার না হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ঘটনার পরপরই রউফ পালিয়ে ঢাকায় চলে যান। এরপর ২৫ মার্চ উচ্চ আদালত থেকে ছয় সপ্তাহের জন্য আগাম জামিন নিয়েছেন বলে শুনেছি। তার সঙ্গীরাও একই কাজ করেছেন। এ কারণে তাদেরকে গ্রেফতার করা যায়নি। সম্ভবত আসামিরা দেশে নেই।
তিনি আরও বলেন, এটি প্রকাশ্য হত্যাকাণ্ড। অনেক প্রত্যক্ষদর্শী রয়েছে। একজন আসামি জবানবন্দি দিয়েছেন। হত্যার শিকার ব্যক্তিও মৃত্যুর আগে সাক্ষ্য দিয়েছেন। এখানে জটিলতার কিছু নেই। মূল আসামি রউফই হবে। অন্যরাও সহযোগী হিসেবে থাকবেন। বগুড়া সদর থানার ওসি তদন্ত আবুল কালম আজাদ বলেন, রউফকে ধরতে পুলিশের একাধিক টিম শুরু থেকে মাঠে ছিল। কিন্তু তারপরও তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। এখন শিগগিরই তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১২০৯
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ