চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার গোন্ডামারা ইউনিয়নে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে পুলিশের গুলিতে আহত আরও এক শ্রমিক মারা গেছেন। গতকাল বুধবার সন্ধ্যা সাতটার দিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। এ নিয়ে বিক্ষোভে সংঘর্ষের ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াল ৬-এ।
নিহতের নাম শিমুল আহমেদ (২২)। সে মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার বরইতলা এলাকার আবদুল খালেকের ছেলে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক জহিরুল হক ভুঁইয়া গণমাধ্যমকে বলেন, আহত শ্রমিকদের মধ্যে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। তিনি পেটে গুলিবিদ্ধ ছিলেন।
তিনি বলেন, ‘যেদিন হাসপাতালে আনা হয়েছিল সে দিন প্রথমে ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। একই দিন অবস্থার অবনতি হলে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। বুধবার সন্ধ্যায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় আইসিইউতে তার মৃত্যু হয়েছে। তার মরদেহ হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে।’
এর আগে গত ১৭ এপ্রিল বাঁশখালীর গণ্ডামারা এলাকায় নির্মাণাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রে শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষে নিহত পাঁচজন হলেন- কিশোরগঞ্জের ফারুক আহমদের ছেলে মাহমুদ হাসান রাহাত (২২), চুয়াডাঙ্গার অলিউল্লাহর ছেলে মো. রনি হোসেন (২৩), নোয়াখালীর আব্দুল মতিনের ছেলে মো. রায়হান (১৯), চাঁদপুরের মো. নজরুলের ছেলে মো. শুভ (২২) এবং বাঁশখালীর পূর্ব বড়ঘোনার আবু ছিদ্দিকির ছেলে মাহমুদ রেজা (১৯)।
এদিকে গুলিতে আহত অন্তত ১২ জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত শ্রমিকেরা হলেন আমিনুল ইসলাম (২৫), মো. আমির (২৪), মো. দিদার (২১), মো. বিল্লাল (২৬), মো. আযাদ (১৮), মো. কামরুল (২৬), শাকিল (২৩), মুরাদ (২৫), মিজান (১৮), রাহাত (২৮), হাবিবুল্লাহ (১৮), হাসান (৪০) ও অভি (২০)।
হতাহতের ঘটনায় একই দিন দিবাগত রাতে দুটি মামলা রুজু হয়েছে। এর মধ্যে থানার এক কর্মকর্তা বাদী হয়ে অজ্ঞাত আড়াই হাজার জনের একটি মামলা করেন। অপর মামলা বিদ্যুৎকেন্দ্রের চিফ কোর্ডিনেটর ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে ২২ জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাত আরও এক হাজার ৫০ জনকে আসামি করে দায়ের করেছেন।
এস এস প্লান্টে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকদের বেতন ভাতা নিয়ে বিক্ষোভ চলছিল। গত ১৬ এপ্রিল থেকে শ্রমিকদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। এর জেরে পরদিন শনিবার সকালে প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকে বসেন শ্রমিক নেতারা। বৈঠক চলার সময় দাবি-দাওয়া আদায় নিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। এক পর্যায়ে দুপুর পৌনে ১২টার দিকে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। এ সময় পুলিশ গুলি ছুঁড়লে ঘটনাস্থলেই চারজন নিহত হন। আহত হন অন্তত ২৫ জন। পরে বিকালে চমেক হাসপাতালে মারা যান আরও একজন।
প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, এস.আলম গ্রুপের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের শ্রমিকরা বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধ, রোজার মধ্যে ১০ ঘণ্টার পরিবর্তে ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস বাস্তবায়ন, শুক্রবারের ডিউটির সময় ৮ ঘণ্টার পরিবর্তে ৪ ঘণ্টা নির্ধারণসহ ১০ দফা দাবিতে আন্দোলন করছিল। বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকের প্রতিনিধিরা আগের দিন শ্রমিকদের দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাস দিয়ে পরের দিন তা অস্বীকার করায় শ্রমিকরা উত্তেজিত হয়ে কাজ বন্ধ কর দিলে তাদের কাজে যোগ দিতে বাধ্য করতে শক্তি প্রয়োগ করা হয়। তখন শ্রমিকরা বিক্ষোভ সমাবেশ শুরু করলে বিক্ষোভরত শ্রমিকদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে পাঁচ জনকে হত্যা এবং অর্ধশতাধিক শ্রমিককে মারাত্মকভাবে জখম করা হয়।
বাঁশখালীতে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ২০১৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি এস আলম গ্রুপের এসএস পাওয়ার লিমিটেডের সঙ্গে ও চীনা প্রতিষ্ঠান সেপকো ও এইচটিজির মধ্যে চুক্তি হয়। ২০১৭ সাল থেকে গণ্ডমারা এলাকায় প্রায় ৬০০ একর জমিতে ২৫০ কোটি ডলার ব্যয়ে এটির নির্মাণকাজ শুরু হয়।
চুক্তি হওয়ার পর থেকেই গ্রামবাসীদের একটি পক্ষ এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিরোধিতা করেন পরিবেশ দূষিত হওয়ার কথা বলে। আরেকপক্ষ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পক্ষ নেয়।
এর জেরে ২০১৬ সালের এপ্রিলে দুই পক্ষের সংঘর্ষ হয়। তখন নিহত হন ৬ জন। এ ঘটনার পাঁচ বছর পর ফের হতাহতের ঘটনা ঘটলো বিদ্যুৎকেন্দ্র এলাকায়।
জানা গেছে, ঘটনার পর বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ কাজ কয়েক দিন বন্ধ থেকে আবার আস্তে-ধীরে চালু হচ্ছে। বর্তমানে ওই এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। গ্রেফতার আতঙ্কে একপ্রকার পুরুষশুন্য হয়ে পড়েছে এলাকাটি। বেশিরভাগ শ্রমিকরা এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন।
ওই ঘটনার তদন্তে পুলিশের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের এবং জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে চার সদস্যের পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। তাদের সাত কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। নিহত শ্রমিকদের প্রত্যেককে ৩ লাখ এবং আহত ব্যক্তিদের ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণের ঘোষণা দেয় এস আলম কর্তৃপক্ষ।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, এ ঘটনায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তে কী আসবে, আমরা জানি না। কিন্তু এটা জানা যে কোনো তদন্ত কিংবা ক্ষতিপূরণ নিহত শ্রমিকদের ফিরিয়ে দিতে পারবে না। এস আলম গ্রুপ কর্তৃপক্ষ নিহত শ্রমিকদের প্রত্যেককে ৩ লাখ এবং আহত ব্যক্তিদের ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণের ঘোষণা দিয়েছে। অর্থ দিয়ে মানুষ হত্যার ক্ষতিপূরণ হয় না। এ ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতে যাতে না ঘটে, সে জন্য দরকার সংশ্লিষ্ট সবার জবাবদিহি ও শ্রমিক হত্যার ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩১৫
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ