আমেরিকার মিনিয়াপোলিসের কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জর্জ ফ্লয়েডের (George Floyd) মৃত্যুর ঘটনায় অভিযুক্ত পুলিশ কর্মী ডেরেক চৌভিনকে দোষী সাব্যস্ত করল মার্কিন আদালত। তার বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ প্রমাণ হয়েছে। এর পরই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ফ্লয়েডের পরিবার। আদালতের রায়ের পর তারা এক হোটেলে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন। সেখানে জর্জের এক ভাই বলেন, “আজ আমরা আবার শ্বাস নিতে পারছি।”
গত বছর মিনিয়াপোলিসে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডকে মাটিতে ফেলে ঘাড়ের উপর হাঁটু চেপে ধরেন পুলিশ কর্মী ডেরেক চৌভিন। তখন ফ্লয়েড বার বার বলছিলেন, “আমি শ্বাস নিতে পারছি না। আমি শ্বাস নিতে পারছি না।” কিন্তু তার পরেও ওই পুলিশ কর্মী তাকে ছাড়েননি। সেই অবস্থাতেই মাটিতে চেপে রেখেছিলেন জর্জকে। কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি মারা যান। মর্মান্তিক, অমানবিক সেই ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হয়ে যায় সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সংবাদমাধ্যমে। আমেরিকা-সহ গোটা বিশ্বে নিন্দার ঝড় ওঠে। বর্ণবিদ্বেষের অভিযোগে আগুন জ্বলে ওঠে মিনিয়াপোলিসে। হাজার হাজার শ্বেতাঙ্গও কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে নামবতার স্বপক্ষে “ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটারস” প্ল্যাকার্ড নিয়ে পথে নামেন।
সিএনএনের খবরে বলা হয়, মিনেসোটার হেনেপিন কাউন্টি আদালত তিনটি অভিযোগেই ডেরেক চৌভিনকে দোষী সাব্যস্ত করেছেন। এগুলো ‘সেকেন্ড ডিগ্রি’ অনিচ্ছাকৃত খুন, ‘থার্ড ডিগ্রি’ খুন এবং ‘সেকেন্ড ডিগ্রি’ নরহত্যা। আইন অনুযায়ী ‘সেকেন্ড ডিগ্রি’ অনিচ্ছাকৃত খুনের জন্য সর্বোচ্চ ৪০ বছর কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। ‘থার্ড ডিগ্রি’ খুনের জন্য সর্বোচ্চ কারাদণ্ড হয় ২৫ বছরের। অন্যদিকে ‘সেকেন্ড ডিগ্রি’ নরহত্যার দায়ে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ২০ হাজার ডলার জরিমানা।
আদালত রায় ঘোষণার সময় জানিয়েছেন, পরবর্তী আট সপ্তাহের মধ্যে চৌভিনের কারাদণ্ডাদেশ ঘোষণা করা হবে। দোষী সাব্যস্ত করে রায় ঘোষণার সময় ডেরেক চৌভিনকে আদালতে হাজির করা হয়। তিনি তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। আদালত রায় ঘোষণার পর তাকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। মার্কিন মিডিয়াগুলো বলছে, এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন চৌভিন।
রায় ঘোষণার পরপর আদালতের বাইরে থাকা ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনকারীরা উল্লাস প্রকাশ করেন। ন্যায়বিচার হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তাঁরা।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও যে জবাবদিহিতা থাকা দরকার সেটিই এই রায়ের মাধ্যমে পাওয়া গেলো। রায় ঘোষণার পর পরই ফ্লয়েড পরিবারকে টেলিফোন করেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট কমালা হ্যারিস।
জো বাইডেনকে বলতে শোনা যায়, অবশেষে ন্যায়বিচার হলো। আমাদের আরো অনেক কিছু করতে হবে। পদ্ধতিগত বর্ণবাদের বিরুদ্ধে এটি ছিল প্রথম পদক্ষেপ, প্রেসিডেন্ট বলেন।
টেলিভিশনে দেয়া জাতীর উদ্দেশ্যে ভাষণে বাইডেন বলেন, পদ্ধতিগত বর্ণবাদ পুরো জাতীয় আত্মার উপর একটি কলঙ্ক।
এরইমধ্যে মিস হ্যারিস আইনপ্রণেতাদের জর্জ ফ্লয়েড নামে একটি বিল পাসের নির্দেশ দিয়েছেন যা যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশিং ব্যবস্থায় সংস্কার আনবে। তিনি বলেন, এই বিল জর্জ ফ্লয়েডের লিগ্যাসির অংশ। এটি দীর্ঘদিন ধরে সম্পন্ন হওয়ার অপেক্ষায় ছিল।
মিনেয়াপোলিসের পুলিশ ফেডারেশন নামে একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, যারা পুলিশের প্রতিনিধিত্ব করে তারা জুরিদের তাদের “নিবেদিত কাজ সম্পন্ন করায়” এবং “বিশাল একটি বোঝা” বহনে সহায়তা করার জন্য ধন্যবাদ জানায়। ফেডারেশন বলে, “আমরা ওই ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায়ের কাছে গিয়ে আমাদের দুঃখিত হওয়ার বিষয়টি জানাতে চাই যা আমরা প্রতিনিয়ত অনুভব করেছি। এই মামলায় কেউই আসলে বিজয়ী নয়, সেই সাথে জুরিদের সিদ্ধান্তের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা রয়েছে।”
জর্জ ফ্লয়েডের কী হয়েছিল?
২০২০ সালের ২৫শে মে মিনেয়াপোলিসের একটি দোকান থেকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনেছিলেন ৪৬ বছর বয়সী জর্জ ফ্লয়েড। দোকানের এক সহায়তাকর্মী মনে করেছিলেন যে, তিনি ২০ ডলার মূল্যের একটি নকল বিল ব্যবহার করছিলেন এবং ফ্লয়েড যখন সিগারেটের প্যাকেটটি ফেরত দিতে চাননি তখন তিনি পুলিশ ডাকেন।
পুলিশ পৌঁছানোর পর তারা জর্জ ফ্লয়েডকে তার পার্ক করে রাখা গাড়ি থেকে নামতে বলেন এবং তার হাতে হাতকড়া পরিয়ে দেয়া হয়। পুলিশের গাড়িতে তোলার সময় ফ্লয়েড চিৎকার করার চেষ্টা করলে ধ্বস্তাধস্তি হয়। তারা তাকে জোর করে মাটিতে ফেলে দেহের ওজন দিয়ে চেপে ধরেন।
ডেরেক চৌভিন তার হাঁটু ফ্লয়েডের পিছনের ঘাড়ের উপর ৯ মিনিট ধরে চেপে ধরে বসে থাকে। এসময় ফ্লয়েড অন্তত ২০বার বলেছিলেন যে, তিনি শ্বাস নিতে পারছেন না। ফ্লয়েড বলছিলেন, “দয়া করুন, দয়া করুন, দয়া করুন”। যখন অ্যাম্বুলেন্স এসে পৌঁছায় ততক্ষণে জর্জ ফ্লয়েড নিথর হয়ে গেছেন। এর এক ঘণ্টা পর তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
বিচারে কী হয়?
চৌভিনের বিচারের সময় বিচারকেরা ৪৫ জন প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দী শোনেন এবং কয়েক ঘণ্টা ধরে ভিডিও ফুটেজ দেখেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে অনেকেই ঘটনাটির নিখুঁত বর্ণনা দেন। অনেকেই ভিডিও ফুটেজটি দেখার সময় কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন এবং সেসময় তারা “অসহায়” বোধ করার কথা জানান।
ফ্লয়েডের প্রেমিকা কোর্টনি রস এবং তার ছোট ভাই ফিলোনিস ফ্লয়েড মিলে মৃত ফ্লয়েডের অতীত জীবন বর্ণনা করেন।
বিশেষজ্ঞরা বলেন যে, জর্জ ফ্লয়েড অক্সিজেন না পেয়েই মারা গেছেন এবং এটা হয়েছে চাওভিন ও তার সহকর্মীদের কারণে। শুনানিতে কোন বক্তব্য না দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন চাওভিন।
অভিযোগগুলো কী?
নরহত্যা হচ্ছে যখন কেউ অনিচ্ছাকৃতভাবে অন্য আরেক ব্যক্তির মৃত্যুর কারণ হয়। সেকেন্ড ডিগ্রি মার্ডার হচ্ছে, হত্যাকাণ্ডটি ইচ্ছেকৃত অথবা অনিচ্ছাকৃত ছিল। এই অপরাধের সর্বোচ্চ সাজা ৪০ বছর। থার্ড ডিগ্রি মার্ডার মানে হচ্ছে, কোন ব্যক্তি এমন কোন কাজ করেছে যার কারণে অন্য এক বা একাধিক ব্যক্তির প্রাণনাশ হয়েছে।
পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশ কর্মকর্তাদের দোষী সাব্যস্ত হওয়ার ঘটনা বিরল। এমনকি তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের ঘটনাও কম। তবে ভবিষ্যতে এ ধরণের ঘটনার ক্ষেত্রে মার্কিন বিচার ব্যবস্থা কিভাবে নেবে তার একটি উদাহরণ হিসেবে এই রায়কে দেখা হয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১২৫০
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ