ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তারের পর আহমেদ কবির কিশোরকে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বদ্ধ এক ঘরে আটকে রেখে বেদম নির্যাতন করে। নির্যাতনের বিষয়ে জামিনে মুক্ত হয়ে কিশোর কান্না বিজরিত কণ্ঠে সেদিনই দেশের গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন। এবার নির্যাতনের অভিযোগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দায়ী করে মামলার আবেদন করেছেন কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর। আজ বুধবার (১০ মার্চ) দুপুরে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েশের আদালতে তিনি এ মামলার আবেদন করেন। আদালতের কাছে তিনি তার ওপর নির্যাতনের বিচার চেয়েছেন।
তবে মামলার আবেদনে কারো নাম উল্লেখ করা হয়নি। অজ্ঞাতনামাদের আসামি করা হয়েছে। এসময় আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ শেষে আদেশ পরে দিবেন বলে জানিয়েছেন।
কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর বলেন, আমাকে আটকের পর নির্যাতন করা হয়েছে। আমি এ বিষয়ে নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে আদালতের কাছে মামলা নেয়ার আবেদন করেছি।
কিশোরের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, আটকের পর কিশোরকে নির্যাতন করা হয়েছে। নির্যাতনে তার কানের পর্দা ফেটে গেছে। আমরা আজ আদালতে হেফাজতে নির্যাতন আইনে মামলা নিতে আবেদন করেছি। আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করেছেন। এ বিষয় পরে আদেশ দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন আদালত।
এর আগে গত ৩ মার্চ হাইকোর্টের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ কার্টুনিস্ট কিশোরের ছয় মাসের জামিন মঞ্জুর করেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় প্রক্রিয়াগত ত্রুটি ও কার্টুনিস্ট কিশোরের অসুস্থতার কথা জানিয়ে তার জামিনের আর্জি জানিয়েছিলেন আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। নিম্ন আদালতে ৬ বার আবেদন করে ব্যর্থ হয়ে ৩ মার্চ হাইকোর্টে জামিন পান কিশোর। পরদির তিনি তিনি ছাড়া পান।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দশ মাস ধরে কারাভোগের পর জামিনে মুক্তি পাওয়া কার্টুনিস্ট কিশোর আজ বুধবার দুপুরে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে এই মামলাটি করেন।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক কে এম ইমরুল কায়েস আজ বেলা দেড়টার পর থেকে প্রায় আধা ঘণ্টা কিশোরের জবানবন্দি রেকর্ড করেন। সেখানে কিশোর তার ওপর হওয়া নির্যাতনের বর্ণনা দেন।
আদালতের কাছে কিশোর বলেন, গত বছরের ২ মে সন্ধ্যা পৌনে ছয়টার দিকে তার কাকরাইলের বাসায় ১৭–১৮ জন লোক এসে তাকে প্যান্ট–শার্ট পরে বাইরে আসতে বলেন। এ সময় তার মুঠোফোন ও কম্পিউটার জব্দ করেন ওই লোকেরা। তাদের মধ্যে একজনের নাম জসিম বলে তিনি তখন শুনতে পান। কিশোর ওই লোকদের কাছে জানতে চান, কী অপরাধে তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে কি না। তখন তাকে বলা হয়, ‘নিচে গিয়ে গাড়িতে ওঠ, পরে সব জানতে পারবি।’ তারা আমাকে কোনো রকম গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দেখাতে পারে নাই। আমার বাসা থেকে আমার মোবাইল ফোন, সিপিইউ ও পোর্টেবল যত ধরনের ডিজিটাল ডিভাইস ছিল তা অবৈধভাবে নিয়ে যায়।’
তিনি বলেন, ‘আমাকে যখন হাতকড়া পরিয়ে বাসার নিচে নামানো হয়, তখন বাসার সামনে ৬/৭ টি গাড়ি অপেক্ষা করছিল। আমার বাসার সামনে অনেক লোকজন জড়ো হয় এবং একটি গাড়িতে আমাকে ওঠানো হয়। আমি তখন প্রচণ্ডভাবে জোরে জোরে চিৎকার করতে থাকি। কিন্তু তারা গাড়িতে অনেক জোরে জোরে শব্দ করে গান বাজনা বাজাচ্ছিল। হয়তো আমার চিৎকার বাইরে শোনা যাচ্ছিলো না।’
তিনি আরও বলেন, ‘পরবর্তীতে আমি বুঝতে পারলাম আমাকে পুরানো একটি স্যাঁতস্যাঁতে বাড়ির রুমে নিয়ে আসা হয়। এরপর প্রজেক্টরের মাধ্যমে একটির পর একটি কার্টুন আমাকে দেখানো হচ্ছিলো। সেগুলোর মর্মার্থ আমার কাছ থেকে জানতে চাওয়া হচ্ছে। করোনা নিয়ে আমার কিছু কার্টুন দেখিয়ে বলে কেন এগুলো আঁকছস? কার্টুনের চরিত্রগুলো বিষয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়। এক পর্যায়ে আমার কানে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করা হয়। এরপর আমি বোধশক্তি হারিয়ে ফেলি। বুঝতে পারছিলাম আমার কান দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। তারপর স্টিলের পাতের লাঠি দিয়ে আমার পায়ের হাঁটুতে আঘাত করা হয়। যন্ত্রণা ও ব্যথায় আমি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ি।’
কিশোর নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে আদালতের কাছে বিচার চান। কিশোরের মামলার আবেদনের বিষয়ে দু–এক দিনের মধ্যে আদেশ দেওয়া হবে বলে আদালত জানান।
কিশোরের ভাই আহসান কবির ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে জানান, ফৌজদারি কার্যবিধির নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ (২০১৩ সনের ৫০ নং আইন) এর ৪/৫/৬/৭ ধারা মোতাবেক অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে আদেশ দিতে আবেদন করেছেন কিশোর। আদালত আদেশের জন্য দুই দিন সময় নিয়েছেন।
আহসান কবির গণমাধ্যমকে জানান, কিশোরের পায়ে বেশ কিছু আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তবে কোনও হাড়ে ফাটল ধরেনি। পায়ের স্নায়ুতে আঘাত লাগার ফলে হাঁটতে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করেন তিনি। এছাড়া তার কানের পর্দায় খুব জোরালো আঘাত রয়েছে। আঘাতের কারণে কানের পর্দার পাশে রক্ত জমে সেখানে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব সেখানে যন্ত্র প্রতিস্থাপন করতে চান চিকিৎসকরা।এছাড়া দীর্ঘদিন ডায়বেটিসের মাত্রা অনিয়ন্ত্রিত থাককার ফলে গ্লুকোমাজনিত ছানির সৃষ্টি হয়েছে কিশোরের চোখে।
তবে আহমেদ কবির কিশোরের এই নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তিনি বিবিসিকে বলেন, কারাগারে কোন নির্যাতন হয়নি এবং অন্য কোথাও হয়ে থাকলে তা খতিয়ে দেখা হবে।
তিনি বলেন, “ওনাকে কোথায় নির্যাতন করলো, আমরা জানবো কী—আটক অবস্থায়তো কোন নির্যাতন হয়নি। এখন কোথায় হয়েছে – আমি তাদের স্টেটমেন্ট…। আমাদের জেলখানায় কোন নির্যাতন কাউকে করা হয় নাই। আমরা না দেখে বলতে পারবো না”।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের আটক ব্যক্তিদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে অনেকেই তা প্রকাশ করতে সাহস পান না। দুয়েকজন তা প্রকাশ করলেও তার পর কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় না বলে তারা উল্লেখ করেন। তারা বলেন, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতন একদিকে যেমন আইন বিরোধী অপরদিকে অমানবিক। আদালতে বিচার করে রায় ঘোষণা করার আগে অভিযুক্তকে কোনোভাবেই আঘাত করতে পারে না বলে জানান তারা। তারা বলেন, এবিষয়ে ভোক্তভুগীর অবশ্যই বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে।
উল্লেখ্য, গত বছরের মে মাসে লেখক মুশতাক আহমেদ, কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর, রাষ্ট্রচিন্তার সদস্য দিদারুল ভূঁইয়া ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক মিনহাজ মান্নানকে গ্রেফতার করে র্যাব। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক কথাবার্তা ও গুজব ছড়ানোর অভিযোগে তখন ১১ জনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়। সেই মামলায় দুজন জামিনে মুক্তি পেলেও মুশতাক ও কিশোরের জামিন আবেদন ছয়বার নাকচ হয়। এরই এক পর্যায়ে গত মাসে কারাগারে থাকা অবস্থায় অসুস্থ হয়ে মুশতাক খান মারা যান। এর পরই গত ৩ মার্চ কিশোরকে জামিন দেয়ার আদেশ দেয় আদালত। আর ৪ মার্চ মুক্তি পান তিনি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭০০
আপনার মতামত জানানঃ