ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেফতার হওয়া কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর প্রায় এক বছর ধরে কারাবন্দি আছেন। তার সাথেই গ্রেফতার হওয়া লেখক মুওশতাক আহমেদ কয়দিন আগে কারাগারে বন্দি অবস্থায় মারা যান। তার মৃত্যুকে ঘিরে গোটা বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বাতিলসহ মুশতাক হত্যার প্রতিবাদে এখনো আন্দোলন চলছে। এরই মধ্যে শোনা গেল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেফতার কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরকে ছয় মাসের জামিন দিয়েছেন আদালত। আজ বুধবার (৩ মার্চ) বিচারপতি এম এনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ ছয় মাসের জন্যে কিশোরের জামিন মঞ্জুর করে এ আদেশ দেন। তবে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন,ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিতে সারা দেশে আন্দোলনরত আন্দোলনকারীদের সান্ত্বনা হিসাবে আদালতের এই রাজনৈতিক রায়।
আদালত বলেছে, কিশোর যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে আছেন এবং এই মামলায় গ্রেফতার হওয়ার পর দিদারুল ভূইয়া এবং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক পরিচালক মিনহাজ মান্নান নিম্ন আদালত ও হাই কোর্টের এই বেঞ্চ থেকে জামিন পেয়েছেন, সেই বিবেচনায় আহমেদ কবির কিশোরকে ছয় মাসের জামিন দেওয়া হল।
আদালতে কিশোরের জামিন আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন বাপ্পী।
এর আগে গত সোমবার (১ মার্চ) তার জামিন আবেদনের ওপর শুনানি শেষ হয়। এ বিষয়ে আদেশের জন্য আজ দিন ধার্য করেন আদালত।
অন্য কোনো মামলা না থাকায় এর ফলে কিশোর শিগগিরই মুক্তি পাবেন বলে জানিয়েছেন তার আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। আইনজীবী জ্যেতির্ময় বড়ুয়া সাংবাদিকদের বলেন, ‘আহমেদ কবির কিশোরের নামে আর কোনো মামলা নেই। ফলে তার মুক্তি পেতে বাধা নেই। এ প্রক্রিয়াটি দুই-তিনদিনের মধ্যেই সম্পন্ন করার চেষ্টা করা হবে’।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন বাপ্পী বলেন, ‘কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর ১০ মাস ধরে কারাগারে আছেন। মূলত এই বিবেচনায় তাকে ছয় মাসের জামিন দিয়েছে আদালত। মামলাটির যে পুনঃতদন্ত চলছে, আগামী ১৫ মার্চ তার প্রতিদেবন জমা দেওয়ার তারিখ রয়েছে’।
গত বছরের মে মাসে লেখক মুশতাক আহমেদ, কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর, রাষ্ট্রচিন্তার সদস্য দিদারুল ইসলাম ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক মিনহাজ মান্নানকে র্যাব গ্রেফতার করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক কথাবার্তা ও গুজব ছড়ানোর অভিযোগে তারাসহ মোট ১১ জনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করে র্যাব। সেই মামলায় দুজন জামিনে মুক্তি পেলেও মুশতাক ও কিশোরের জামিন আবেদন ছয়বার নাকচ হয়। এর মধ্যে লেখক মুশতাক আহমেদ ২৫ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে আটটার দিকে কারাগারে মারা যান। তার মৃত্যুর পর বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়।
লেখক মুশতাক আহমেদের কারাগারে মৃত্যুর বিচার, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার থাকা ব্যক্তিদের মুক্তি ও আইনটি বাতিলের দাবিতে কয়েকটি সংগঠনের উদ্যোগে রাজধানী থেকে আন্দোলন ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে গোটা বাংলাদেশে।
আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী বক্তারা বলেন, ‘দেশে যে দুর্নীতি-লুটপাট চলছে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করতেই এ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। আর এর শিকার হচ্ছেন সাংবাদিক, লেখক, কলামিস্ট, শিক্ষকসহ মুক্তচিন্তার মানুষ। গত ২০১৯ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এক হাজার ৯৮৩ জনের নামে মামলা হয়েছে। ২০২০ সালে ৭৫ জন সাংবাদিককে জেলে যেতে হয়েছে। এ আইনের মাধ্যমে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। যা একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশে কখনও কাম্য নয়। এ আইনের বিরুদ্ধে যারা আন্দোলন করছেন তাদেরও পুলিশি হামলায় রক্তাক্ত করা হচ্ছে এবং মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে।’
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে লেখক মুশতাক আহমেদের হত্যার বিচার দাবিসহ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিতে এখনো আন্দোলন চলমান রয়েছে। এরইমধ্যে আজ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেফতার কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরকে ছয় মাসের জামিন দিয়েছেন আদালত।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলমান আন্দোলন ও আন্দোলনকারীদের সান্ত্বনাস্বরুপ কিশোরকে জামিন দেওয়া হয়েছে। তারা বলেন, সারা দেশে স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়া আন্দোলনকে বাগে আনতেই সরকারের এ রাজনৈতিক কৌশল। একইসাথে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বহালের পক্ষ নিয়ে সরকার কিশোরকে জামিন দিয়ে আন্দোলনকে শিথিল ও ভিন্নভাবে নেওয়ার চেষ্টা হিসাবে প্রয়াস নিয়েছেন।
তারা মনে করেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রক্ষার জন্য সরকারের বিভিন্ন পক্ষ থেকে বিভিন্নভাবে প্রয়াস নিচ্ছেন। মন্ত্রীদের বিভিন্ন সভা সেমিনারে বক্তব্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বহালের পক্ষে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করে যাচ্ছেন। আইনটি বাতিলের দাবিতে বিস্তৃত হয়ে পড়া আন্দোলনকে সংকুচিত ও পরিশেষে থামিয়ে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন কৌশলগত অবস্থান নিতে সরকারের অবস্থান লক্ষ্য করা গেছে। তারই অংশ হিসাবে ছয় ছয় বার জামিন নাকচ করার পর আচমকা এই জামিন মঞ্জুরে স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহের সৃষ্টি করে বলে বিশেষজ্ঞরা জানান। তারা মনে করেন, আন্দোলনকারীদের সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য সরকার কিশোরকে জামিন দিয়ে থাকতে পারেন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৪৩
আপনার মতামত জানানঃ