ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলায় অগ্রণী ব্যাংকের প্রায় এক কোটি ৮০ লাখ টাকা লুটপাটের ঘটনায় ব্যাংকের সাবেক বরখাস্তকৃত শাখা ব্যবস্থাপক শৈলেন বিশ্বাসসহ চার কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে নিরীক্ষা প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেডের অডিট অ্যান্ড ইন্সপেকশন ডিভিশন ১-এর ২৬তম অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে তাদের দোষী সাব্যস্ত করে তদন্ত রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়েছে। তবে এখনও তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা করা হয়নি।
২৩৮ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে কালীগঞ্জ অগ্রণী ব্যাংকের লুটপাটের ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে গ্রাহক ও ব্যাংকের অর্থ লুটপাটের সঙ্গে যাদের দায়ী করা হয়েছে তারা হলেন, সাবেক বরখাস্তকৃত শাখা ব্যবস্থাপক শৈলেন বিশ্বাস, ক্যাশ অফিসার আব্দুস সালাম ওরফে বাইট্টা সালাম ওরফে সুদিপ্ত সালাম, বর্তমান ইবি শাখার প্রিন্সিপাল অফিসার কামরুজ্জামান ও অস্থায়ী মাঠ সহকারী আজির আলী।
গত বছর অক্টোবর মাসে কালীগঞ্জ অগ্রণী ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির খবর প্রকাশ পেলে সাময়িকভাবে ম্যানেজার ও ক্যাশ অফিসারসহ ৩ জনকে বরখাস্ত করে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারী করে হেড অফিস। এরপর ৫ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটির প্রধান নিযুক্ত হন হেড অফিসের সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার জাকারিয়া মন্ডল। এছাড়া তদন্ত টিমে হেড অফিসের এসও অডিটর গোবিন্দ চন্দ্র দাস, ফারুক হোসেন, এসপিও সুব্রত কুমার সাহা ও এসও জুলহাস উদ্দীনকে সদস্য করা হয়। বিভিন্ন ব্যক্তির নামে বেনামে ঋণ দেখিয়ে ব্যাংকের ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা লুটপাট করা হয়েছে বলে অভিযোগ।
জানা যায়, কালীগঞ্জ উপজেলার নিশ্চিন্তপুর গ্রামের জগন্নাথ বিশ্বাসের ছেলে শৈলেন ২০১৭ সালের ১৭ জুলাই শাখা ম্যানেজার পদে যোগ দেন। তার বিরুদ্ধে আগেও নানা অনিয়ম-অভিযোগের তদন্ত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কোঠায় ২০১৭ সালের ৫ অক্টোবর কালীগঞ্জ শাখায় অফিসার ক্যাশ পদে যোগ দেন হরিণাকুণ্ড উপজেলার ভেড়াখালী গ্রামের আবদুস সালাম। অথচ তাকে ঋণ শাখায় দায়িত্ব দেয়া হয়। শৈলেন ও সালামকে সঙ্গে করে প্রতারক আজির আলী নতুন পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামে। স্থানীয় চক্রের সহযোগিতায় তারা জালিয়াত সিন্ডিকেট গড়ে তোলে। কৃষকসহ কাল্পনিক গ্রহীতাদের নামে কাগজপত্র তৈরি করে এবং ভুয়া স্বাক্ষর করে তারা কৃষিঋণ নেন।
জানা গেছে, কৃষকদের ৪ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদে এক লাখ টাকার নিচে সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে আসছিল ব্যাংকটি। অনুমান এক হাজার ১০০ জনের নামে পৌনে চার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়। ব্যাংকটির আঞ্চলিক অফিস থেকে প্রতি বছর তদারকি করা হয়েছে। একাধিক এজিএম ও ডিজিএমও শাখা পরিদর্শন করেছেন। কিন্তু কারও চোখে জালিয়াতির বিষয়টি এতদিন ধরা পড়েনি।
জালিয়াতির দায়ে শৈলেন বিশ্বাসকে চুয়াডাঙ্গায় বদলি করা হলে শাখায় নতুন ব্যবস্থাপক হিসেবে যোগ দেন এসপিও নাজমুস সাদাত। তিনি যোগদানের পর বেরিয়ে আসে টাকা আত্মসাতের মহাজালিয়াতির খবর। ব্যাংকের কোটি টাকার ওপরে আর্থিক কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত থাকার পরও সাময়িক বরখাস্ত ছাড়া তাদের বিরুদ্ধে এখনও কোনো মামলা হয়নি বলে অভিযোগ।
তবে অগ্রণী ব্যাংকের খুলনার জিএম ফারুক আহম্মেদ বুধবার বিকালে মোবাইল ফোনে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সত্যতা নিশ্চিত করে জাতীয় এক দৈনিককে জানান, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিভাগীয়ভাবে তদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। এখন সম্পূরক চার্জশিট প্রদান করবে অডিট বিভাগ।
তিনি বলেন, তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার বিষয়টি সময়ের ব্যাপার মাত্র। অভিযুক্তরা কোনোভাবেই ছাড় পাবেন না বলে তিনি উল্লেখ করেন।
তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লিখিত ব্যাংক কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাচারিতা, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়। তারা মৃত, বিদেশ থাকা ও নাম-পরিচয়বিহীন অর্ধশত ব্যক্তির নামে ঋণ দিয়ে টাকা আত্মসাৎ করেন।
তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বরখাস্তকৃত শাখা ব্যবস্থাপক শৈলেন বিশ্বাস, ক্যাশ অফিসার আব্দুস সালাম, বর্তমান ইবি শাখার প্রিন্সিপাল অফিসার কামরুজ্জামান ও মাঠকর্মী আজির আলী ৪১ লাখ ৭৯ হাজার ৯৩১ টাকা ভুয়া ঋণ উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত।
কালীগঞ্জ উপজেলার মৃত আরশেদ আলীর ছেলে হোসেন আলী ২০১৯ সালের ৩ জুলাই ইন্তেকাল করেন। তার নামে ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি ৪৭ হাজার টাকার ঋণ উত্তোলন করা হয়েছে। অস্থায়ী মাঠ সহকারী আজির আলী মৃত হোসেন আলীর বাড়িতে গিয়ে ঋণ গ্রহণের বিষয়ে স্বীকারোক্তি দিতে চাপ প্রয়োগ করেন।
একইভাবে কালীগঞ্জের মৃত মনির উদ্দীন মালিথার নামে ৫০ হাজার টাকা, মনোহরপুর গ্রামের আব্দুল মালেকের নামে ৪৮ হাজার টাকা, আহম্মদ আলীর নামে ৬০ হাজার টাকা ও নিতাই মল্লিকসহ একাধিক মৃত ব্যক্তিদের নামে ২৭ হাজার টাকা ঋণ তুলে পকেটস্থ করেন।
বিদেশে থাকা পুকুরিয়া গ্রামের মনিরুল, নজরুল ইসলাম, টিটো বিশ্বাস, মনোহরপুর গ্রামের ইস্রাফিল, বড়সিমলা গ্রামের শাহিনুর, ছোট সিমলা গ্রামের হায়দার আলী, আব্দুল হামিদ, মধুসুদন, ভারতে চলে যাওয়া অধীর কুমার দাসের নামেও তাদের অজান্তে চার লাখ ৭৬ হাজার ৯৩১ টাকার ঋণ তোলা হয়।
এ ছাড়া মঞ্জুরিকৃত ঋণের চেক গ্রাহককে কম টাকা দিয়ে অবশিষ্ট ১২ লাখ ৬৮ হাজার ৭০০ টাকা আত্মসাৎ করেন। ঋণ হিসাবে কৃষকরা জমা দিলেও প্রতারণা ও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে তারা দুই লাখ ৭৮ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেন।
জাল মাঠ পাড়চা তৈরি করে চক্রটি এক কোটি ২২ লাখ ৬৭ হাজার ৭০৬ টাকার ঋণ দিয়েছেন। আবাদি জমির প্রমাণক গ্রহণ না করে ২৫ লাখ ৬৩ হাজার ৭৯৬ টাকার ঋণ দেন।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানান, সরকারি আধা সরকারি সমস্ত প্রতিষ্ঠানকেই দায়িত্বরত কিছু মানুষ নিজেদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভেবে আসছে। কোনো ধরনের জবাবদিহিতার তোয়াক্কা না করে একেরপর এক অনিয়ম দুর্নীতি করে যাচ্ছে। তারা বলেন, কৃষকের ঋণ খাতা কলমে লেখা থাকলেও আদতে বাস্তবচিত্র তেমনটা বলে না। ব্যাংকের অসাধু শ্রেণির ঘুষ বাণিজ্য ও প্রতারণার কারণে হয়রানির শিকার হওয়া কৃষকেরাও ঋণগ্রহণের ব্যাপারে তেমন একটা আগ্রহ দেখায় না। এই অসাধু শ্রেণিকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে বিচারের সম্মুখীন করার দাবি জানান তারা।
এসডব্লিউ/ডিজে/১৭৫০
আপনার মতামত জানানঃ