ভারতের বিচারব্যবস্থায় যৌন অপরাধ সংক্রান্ত মামলাগুলোর রায় প্রায়ই আলোচনার জন্ম দেয়, কিন্তু দিল্লি হাইকোর্টের সাম্প্রতিক রায়টি আলোচনার পরিসর আরও বিস্তৃত করেছে। আদালত বলেছে— কেবল ‘শারীরিক সম্পর্ক’ কথাটির ব্যবহার ধর্ষণের প্রমাণ নয়, যদি না তা প্রমাণ এবং নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দ্বারা সমর্থিত হয়। রায়ের এই অংশটি অনেকের কাছে হয়তো ঠান্ডা যুক্তির মতো শোনালেও, আইনের কাঠামো এবং বিচার প্রক্রিয়ার গভীরে গেলে বোঝা যায়, এর প্রভাব হতে পারে সুদূরপ্রসারী। বিচারপতি মনোজ কুমার ওহরির বেঞ্চ এই পর্যবেক্ষণ দেওয়ার সময় শুধু এক অভিযুক্তকে খালাস দেননি, বরং এক নতুন ব্যাখ্যা দিয়েছেন যৌন অপরাধ সংক্রান্ত সাক্ষ্যগ্রহণ ও তদন্তের মানদণ্ডে।
মামলাটি শুরু হয় ২০২৩ সালে, যখন অভিযোগ ওঠে যে এক ব্যক্তি বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০১৪ সালে এক কিশোরীর সঙ্গে এক বছরের বেশি সময় ধরে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়ার পর ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় অভিযুক্তকে। কিন্তু হাইকোর্টে আপিলের সময় আদালত লক্ষ্য করে, মামলার গোড়াতেই গুরুতর ত্রুটি ছিল। অভিযোগে ও সাক্ষ্যে বারবার “শারীরিক সম্পর্ক” শব্দটি ব্যবহৃত হলেও, এর প্রকৃতি বা অর্থ স্পষ্ট করা হয়নি। সেই সম্পর্ক ছিল জোরপূর্বক, নাকি প্রতারণার মাধ্যমে, নাকি পারস্পরিক সম্মতিতে— তা নির্ধারণে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ হাজির করা হয়নি। আদালত বলেন, কোনো অপরাধ প্রমাণের জন্য কেবল শব্দ নয়, প্রমাণই মুখ্য। আবেগ নয়, তথ্যই বিচারব্যবস্থার ভিত্তি।
দিল্লি হাইকোর্টের এই রায় অনেক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, এটি যৌন অপরাধের মামলায় ‘শব্দের’ চেয়ে ‘প্রমাণ’-এর গুরুত্বকে সামনে এনেছে। ভারতীয় দণ্ডবিধি ও পকসো আইনে ‘শারীরিক সম্পর্ক’ শব্দটির কোনো আইনগত সংজ্ঞা নেই। তাই আদালতের বক্তব্য ছিল— সাক্ষী বা ভুক্তভোগী যখন এই শব্দ ব্যবহার করেন, তখন সেটির মাধ্যমে কী বোঝাতে চান, তা আদালতকে স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে। শিশুসাক্ষীর ক্ষেত্রে এই প্রয়োজন আরও বেশি, কারণ তাদের ভাষায় প্রায়ই আইনি পরিভাষা থাকে না। তারা ঘটনার বর্ণনা দেয় তাদের অভিজ্ঞতা ও মানসিক বয়স অনুযায়ী। আদালতের মতে, এই জায়গায় বিচারকের ভূমিকা নীরব দর্শকের মতো নয়; বরং তাঁকে সক্রিয়ভাবে প্রশ্ন করে জানতে হবে, শিশুটি ঠিক কী বোঝাতে চায়।
রায়ে আরও বলা হয়, প্রসিকিউশন ও তদন্তকারী সংস্থাগুলোর দায়িত্ব হচ্ছে ভুক্তভোগীর বক্তব্যের বিস্তারিত অংশ আদালতের সামনে উপস্থাপন করা। কিন্তু এই মামলায় প্রসিকিউশন সেই কাজটি করেনি। এমনকি ফরেনসিক বা চিকিৎসা প্রতিবেদনও হাজির করা হয়নি, ফলে পুরো মামলাটি দাঁড়িয়েছিল কেবল মৌখিক সাক্ষ্যের ওপর। আদালত বলেন, সাক্ষ্য গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু যদি সেই সাক্ষ্যে অপরাধের প্রকৃতি স্পষ্ট না হয়, তাহলে তা দিয়ে দণ্ড দেওয়া আইনের পরিপন্থী। তাই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে খালাস দেওয়াই ছিল একমাত্র পথ।
এই রায় শুধু এক ব্যক্তির মুক্তি নয়, এটি একটি নীতি-নির্ধারণী দৃষ্টান্তও। আদালত এখানে যে বিষয়টি সামনে এনেছেন, তা হলো— ধর্ষণের মামলায় প্রমাণ ও ভাষার সম্পর্ক। অনেক সময় সমাজে বা মিডিয়ায় ‘শারীরিক সম্পর্ক’ শব্দটি ব্যবহার হয় যৌন সম্পর্ক বোঝাতে, কিন্তু আইনি প্রেক্ষাপটে এটি যথেষ্ট নয়। কারণ, আইন ধর্ষণকে সংজ্ঞায়িত করে ‘অনিচ্ছাকৃত বা জোরপূর্বক যৌন সংসর্গ’ হিসেবে। তাই শুধু “শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে” বলা মানেই ধর্ষণ নয়, যদি না তা প্রমাণিত হয় যে তা ছিল জোর করে বা প্রতারণার মাধ্যমে।
এই রায় ভারতের আইনি ইতিহাসে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এনে দিয়েছে। আদালত দেখিয়েছে, ন্যায়বিচার মানে শুধু অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া নয়, বরং সঠিক প্রক্রিয়ার নিশ্চয়তা দেওয়া। অনেক সময় জনমতের চাপ বা আবেগের বশে আদালতকে ‘দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি’ দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু বিচারপতি ওহরির ভাষায়, আদালত আবেগে নয়, আইনে চলে। রাষ্ট্র যদি তার দায়িত্বে ব্যর্থ হয়, আদালতের কাজ হলো প্রমাণের আলোয় সত্য উদ্ঘাটন করা, প্রতিশোধ নয়।
আইনজীবী মহলে এই রায় নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কেউ বলছেন, এটি প্রমাণ-নির্ভর বিচারব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করবে; আবার কেউ আশঙ্কা করছেন, এতে অনেক ধর্ষণ মামলায় অভিযুক্তরা ফাঁকফোকর দিয়ে বেঁচে যেতে পারে। তবে বেশিরভাগ আইনি বিশেষজ্ঞই একমত, এই রায় ভবিষ্যতে শিশু ও নারী নির্যাতন মামলায় তদন্তের মানদণ্ডকে আরও কঠোর করবে। আদালত নিজেই বলেছে, শিশুসাক্ষীর বক্তব্য গ্রহণের ক্ষেত্রে বিচারকের সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্য। শিশুর ভাষা ও মনস্তত্ত্ব বুঝে তার বয়ান রেকর্ড করা উচিত, যাতে সত্য বিকৃত না হয়।
ভারতের সামাজিক বাস্তবতায় ধর্ষণ এখনো একটি গভীরভাবে আবেগপ্রবণ ও জটিল ইস্যু। অনেক সময় অভিযোগের পেছনে সত্য লুকিয়ে থাকে, আবার অনেক সময় অভিযোগের আড়ালেই অন্য স্বার্থ কাজ করে। এই দুই চরমতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা আদালতের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। দিল্লি হাইকোর্ট সেই ভারসাম্যের দিকেই ইঙ্গিত করেছে। তারা বলেছে, আইন মানে প্রতিশোধ নয়, প্রক্রিয়া। কোনো মানুষ অপরাধী হলে তাঁকে শাস্তি পেতেই হবে, কিন্তু সেই শাস্তি হতে হবে প্রমাণের ভিত্তিতে, অনুমানের নয়।
রায়ের শেষাংশে আদালত বলেন, শিশু বা কিশোর সাক্ষীর বক্তব্য শুধু শুনলেই চলবে না, তার ভাষা, প্রেক্ষাপট ও মানসিক অবস্থাও বিবেচনায় নিতে হবে। শিশুরা অনেক সময় ভয়, বিভ্রান্তি বা সামাজিক চাপে সত্য সম্পূর্ণভাবে বলতে পারে না। তাই আদালতকে সেই ভয়ভীতি ভেদ করে সত্য বুঝতে হবে। এই জায়গায় মানবিকতা ও যুক্তি—দুটির সংমিশ্রণই বিচারকের আসল দায়িত্ব।
দিল্লি হাইকোর্টের এই রায় শুধু ভারতের নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার বিচারব্যবস্থার জন্য একটি দৃষ্টান্ত। এটি মনে করিয়ে দেয়, অপরাধপ্রমাণের ভার যতটা অভিযুক্তের ওপর নয়, তার চেয়েও বেশি রাষ্ট্র ও আদালতের ওপর। রাষ্ট্র যখন ব্যর্থ হয়, আদালত তখন শুধু আইন নয়, বিবেক দিয়েও বিচার করে। কিন্তু সেই বিবেককে পরিচালিত করতে হয় প্রমাণের আলোয়, আবেগের ঝড়ে নয়। এই রায় তাই কেবল এক মামলার সমাপ্তি নয়, বরং বিচারব্যবস্থার দায়িত্ব ও সীমারেখা নতুন করে নির্ধারণের এক প্রামাণ্য দলিল হয়ে থাকবে।
আপনার মতামত জানানঃ