দক্ষিণ এশিয়ায় নদীর পানি নিয়ে বিবাদ, বৈষম্য সবসময় মনোযোগ না পেলেও এটা বলতেই হবে আঞ্চলিক রাজনীতি-অর্থনীতিতে এর প্রভাব গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রে নদীর পানির ব্যবস্থাপনা ও ব্যবহার পারস্পরিক সম্পর্কের গতিপ্রকৃতিকে নির্ধারণ করতে বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। ১৯৪৭-এ দেশভাগের মানচিত্র দেখলে খেয়াল করা যায় মূলত দুটি অববাহিকাকে আলাদা করেছিল নতুন সীমান্ত। সূত্র:বণিক বার্তা।
পশ্চিম দিকে ছিল সিন্ধু অববাহিকা (ভারত ও পাকিস্তান) আর পূর্বে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকা (ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল)। অনেক ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যকার চুক্তির মাধ্যমে পানি বণ্টনের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ হয়, কিন্তু তা সবসময় ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে এমনটা নয়। পানি নিয়ে বৈষম্যের কারণে ভাটির দেশগুলোয় সন্দেহের মনোভাব সবসময়ই রয়ে গেছে। আর এ সন্দেহ অমূলক নয়। ছোট্ট একটি উক্তিতে উপমহাদেশের পানি রাজনীতির দীর্ঘ আর জটিল ইতিহাস অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। এ বছর জুনে বিবিসি বাংলায় তিস্তা নদীর বাংলাদেশ অংশে পরিস্থিতিটা কেমন তা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তাতে রংপুরের একটি গ্রামের একজন নারী বলছিলেন, ‘যখন পানি ভারতে আঁটে না তখনই পানি ছেড়ে দেয়। আমাদের বসতবাড়ি-ভিটে, মনে করেন যে জায়গা-জমি সব চলে গেছে। এখন আমাদের থাকাও খুব রিস্কের ওপর।’ এটা বর্ষাকালের চিত্র। আর বাকি পুরো সময়টায় বাংলাদেশ অংশে তিস্তা যেন মরুভূমির সংস্করণ। মানুষ হেঁটে নদী পার হয়।
তিস্তার উৎপত্তি ভারতের সিকিমে। এরপর পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে নীলফামারী জেলায়। ভারত ও বাংলাদেশের ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদীর মধ্যে তিস্তা চতুর্থ। নীলফামারীর ডিমলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের পর লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা হয়ে আবার কুড়িগ্রামের চিলমারীর কাছাকাছি এসে ব্রহ্মপুত্রে মিশেছে নদীটি। ১৯৪৭-এর আগে তিস্তা প্রবাহিত হতো তখনকার প্রিন্সলি স্টেট সিকিম ও বাংলা প্রদেশের মধ্য দিয়ে। উভয়ই তখন ব্রিটিশ ভারতের অধীন। তাই তখন নদীর পানি ভাগাভাগির মতো বিষয় ছিল না। দেশভাগের মুহূর্ত ঘনিয়ে এলে মুসলিম লীগ নেতারা জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিংকে পূর্ব পাকিস্তানে যুক্ত করতে চেয়েছিলেন। কারণ তিস্তার প্রবাহের উজানের বড় অংশকে নিজেদের রাষ্ট্রে না রাখতে পারলে যে সামনের দিনে সমস্যা দেখা দেবে তা তখনই তারা অনুভব করতে পেরেছিলেন। দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি নিজেদের সীমানায় এলে তিস্তার পুরো মধ্য ও শেষভাগ পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হতো। আর তাহলে এ নদীর পানি ব্যবহার ও ভবিষ্যৎ যেকোনো হাইড্রোপাওয়ার প্রকল্প বাস্তবায়নে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা যাবে—এই ছিল তখনকার মুসলিম নেতাদের ভাবনা।
স্থানীয় জনমিতিতে অমুসলিমদের প্রাধান্য থাকায় এ অঞ্চল ভারতে দিয়ে দেয়া হয়। নদীর পানির বিষয়টি ছাড়াও আরো কারণ ছিল দার্জিলিংকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার আগ্রহের পেছনে। ১৯৪৭-এর ১৫ আগস্ট দার্জিলিংয়ে পাকিস্তানের পতাকাও তোলা হয়েছিল।
বঙ্গীয় ইতিহাস সমিতির সভাপতি ও সাবেক অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ আনন্দগোপাল ঘোষ ভারতীয় একটি সংবাদপত্রকে বলেন, দেশভাগের সময়ে দার্জিলিং জেলা চেয়েছিল পাকিস্তান। কারণ দার্জিলিং ছিল বনাঞ্চলে ভরা। জঙ্গল থেকেই আসত কাঠের জোগান। তা থেকে তৈরি করা যাবে নৌকা। প্রাথমিক পর্যায়ে সে সম্মতিও মেলে। তাই মুসলিম লিগ ১৯৪৭-এর ১৫ আগস্ট পাকিস্তানের পতাকা তোলে দার্জিলিংয়ে। সে পতাকা দুদিন ছিল। জলপাইগুড়ি ছিল আদিবাসী-প্রধান। আর ছিলেন রাজবংশী তথা ক্ষত্রিয়রা। এ জনগোষ্ঠী আগ্রহী ছিল পাকিস্তানে যোগ দিতে। আনন্দগোপালের কথায়, ‘তারা মনে করতেন, ভারতে থাকলে বর্ণহিন্দুরা তাদের শাসন করবে। তাই তারাও ছিলেন পাকিস্তানে ভুক্ত হওয়ার পক্ষে।’ তখন জলপাইগুড়ির নবাব মোশারফ হোসেন ছিলেন মুসলিম লীগে। তিনি চেষ্টা করেন যাতে জলপাইগুড়ি পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। তাই জলপাইগুড়ির কিছু জায়গায় ১৫ আগস্ট উড়েছিল পাকিস্তানের পতাকা।
এখানে জলপাইগুড়ি প্রশ্নে তিস্তা নদীর নিয়ন্ত্রণ ছিল মুসলিম লীগের মুখ্য ইস্যু। ১৯৪৭-এ সীমানা নির্ধারণের সময় হিন্দু মহাসভা ও মুসলিম লীগের মধ্যে জলপাইগুড়িকে নিয়ে টানাটানি শুরু হয়। জেলাটিতে অমুসলিমরাই (৭৬ দশমিক ২ শতাংশ) সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। থানাগুলোর অল্প কয়েকটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল মুসলিমরা। কিন্তু তিস্তা নদীর ক্যাচমেন্ট বেসিন হিসেবে তারা জলপাইগুড়িকে পূর্ব পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিল। সেক্ষেত্রে কৃষিপ্রধান এ অঞ্চলের জন্য সেচ সুবিধা নিশ্চিত করা যেত। এছাড়া ছিল জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের হাতছানি। এছাড়া এ জেলার চা, কাঠ ইত্যাদি সম্পদ ছিল নতুন দেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু র্যাডক্লিফ রেখা জলপাইগুড়ির বেশির ভাগ অংশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত করে দেয়।
এখানে আরেকটি ঘটনাকে স্মরণ করা যেতে পারে। ৭০ ভাগ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মুর্শিদাবাদ জেলা ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সেখানে৷ ১৭ আগস্ট পর্যন্ত পাকিস্তানের পতাকাই উড়েছিল। মুর্শিদাবাদকে ভারতে যুক্ত করে হিন্দুপ্রধান খুলনাকে পাকিস্তানে দেয়া ছিল একটি শর্ত মাত্র। কারণ কলকাতা বন্দর যে হুগলি নদীর তীরে অবস্থিত তা এই মুর্শিদাবাদেই গঙ্গা থেকে পৃথক হয়েছে। ফলে মুর্শিদাবাদ পাকিস্তানে থাকলে কলকাতা ও কলকাতা বন্দরের সক্ষমতা পাকিস্তানের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ত।
তিস্তার ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল তিস্তা ড্যাম প্রজেক্ট। এটা ছিল একটা বহুমুখী প্রকল্প। এর অধীনে তিস্তায় দার্জিলিং ও জলপাইগুড়িতে কয়েকটি ড্যাম নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল, যেখান থেকে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করা হতো। এ বিদ্যুৎ সেক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের জন্য ব্যবহার করা যেত। তখনকার পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তান অংশে কোনো কয়লা খনি ছিল না, যা ছিল তা পশ্চিম বাংলায়। তাই বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা মাথায় রেখে তিস্তার এ প্রকল্প পূর্ব পাকিস্তানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এ প্রকল্পে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও উত্তরবঙ্গের কৃষির জন্য সেচ সুবিধা নিশ্চিত করার ভাবনাও ছিল। এছাড়া দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ির সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের অমুসলিম অধ্যুষিত এলাকার সরাসরি ভৌগোলিক সংলগ্নতা ছিল না। বরং এ এলাকার সঙ্গে পূর্ব বাংলার মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলোরই সরাসরি যোগাযোগ ছিল। এসব যুক্তিতেই মুসলিম লীগ জলপাইগুড়িকে পূর্ব বাংলার সঙ্গে যুক্ত করার দাবি জানিয়েছিল।
দেশভাগের পর পরই ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানের কর্তৃপক্ষের মধ্যে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল। একই সময়ে পাকিস্তান সরকার সিন্ধুর পানি বণ্টন নিয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনা করছিল। তিস্তা তখন ফাইলের তলায় চলে যায়। ১৯৬০-এ সিন্ধু পানি চুক্তি স্বাক্ষরের পর গঙ্গা ও তিস্তার ইস্যু আবার সামনে চলে আসে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ হয়েছে ১৯৭১ সালে। কিন্তু তিস্তার পানি বন্টনের সমাধান এখনো হয়নি। বরং তিস্তার উজানে ভারত বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ অংশে তিস্তা হয়ে যায় মরুভূমিসম, আর বর্ষায় পানি ছেড়ে দেয়ায় বন্যায় প্লাবিত হয় স্থানীয় মানুষ।
আপনার মতামত জানানঃ