মুঘলদের বিরুদ্ধে বাংলার যুদ্ধে যে বারভূঁইয়া বা বারো ভূঁইয়াদের নাম শোনা যায়, তাদের তালিকায় সবার আগে আসে ঈশা খাঁর নাম। তার বীরত্ব আর কৌশলের নানা গল্প ইতিহাস আর লোকগাঁথায় বর্ণিত আছে। ঢাকার অদূরে সোনারগাঁয়ে ছিল তার রাজধানী। পরাক্রমশালী এই ভূঁইয়া বা ভূস্বামী বা জমিদারের জীবন ছিল বৈচিত্রে ভরা।
জমিদার পুত্র হিসেবে যার জন্ম, কিন্তু তার শৈশব কেটেছে সুদূর তুরান বা তুর্কমেনিস্তানে একজন ক্রীতদাস হিসাবে। এক সময় তিনি ফিরে এসেছেন বাংলায়। চাতুর্য, বীরত্ব আর কৌশলে উদ্ধার করেছেন পিতার জমিদারি। কেবল তাই নয়। এক সময় প্রবল প্রতাপশালী মুঘলদের বিরুদ্ধে বাংলার স্বাধীন স্বরের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন ঈশা খাঁ।
ঈশা খাঁর পূর্বপুরুষেরা ভারতের রাজস্থান থেকে ভাগ্যান্বেষণে বাংলায় এসে সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের দরবারে কাজ শুরু করেন। ঈশা খাঁর দাদা ভগীরথকে দেওয়ানি দিয়েছেন সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ। সে সময় আমলা বা সৈনিকদের মধ্যে যোগ্য ব্যক্তি পাওয়া গেলে আর তারা ধর্মান্তরিত হলে নিজেদের কন্যা বা বোনের সাথে বিয়ে দিয়ে রাজকার্যে নানা দায়িত্ব দিতেন মুসলমান শাসকরা। এভাবে ভিনদেশ থেকে আসা এই শাসকদের ক্ষমতার ভিত মজবুত করা হতো।
ভগীরথের মৃত্যুর পরে তার ছেলে কালিদাস দেওয়ানির দায়িত্ব পান। তিনি ধর্মান্তরিত হয়ে আলাউদ্দিন হোসেন শাহের পুত্র গিয়াসউদ্দিন মাহমুদের এক কন্যাকে বিয়ে করেন। তার নতুন নাম হয় সোলাইমান খান।
তখন দিল্লির রাজনীতিতে নানা ঘটনা ঘটছিল। শের শাহ ক্ষমতায় আসার পর তিনি বাংলা থেকে গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহের বংশ উৎখাত করেন। সে সময় আফগানদের বিরুদ্ধে লড়াই করছিলেন জমিদার সোলাইমান খান। একপর্যায়ে আফগান বাহিনী তাকে ধরে ফেলে এবং হত্যা করে। এরপর তার দুই নাবালক পুত্রকে ক্রীতদাস হিসাবে তুরান বা তুর্কমেনিস্তানের একজন ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়।
তুরান বা তুর্কমেনিস্তানের একজন ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দেয়ার পর ঈশা খাঁ এবং তার ভাই ইসমাইল খাঁ সেখানেই বড় হতে থাকেন। এর মধ্যে শের শাহের একজন অন্যতম সেনাপতি তাজ খান কররানি বাংলার সিংহাসন দখল করে নেন। তার অধীনে কাজ করতেন ঈশা খাঁর চাচা কুতুবউদ্দিন।
তিনি তুরান থেকে দুই ভ্রাতুষ্পুত্রকে উদ্ধার করে আনেন। ঈশা খাঁ ততদিনে যুবক হয়ে উঠেছেন। সাহসী এবং কৌশলী হওয়ায় কুতুবউদ্দিনের সহায়তায় এক সময়ে তিনি পৈতৃক জমিদারির দখল ফিরে পান।
প্রথমে তিনি সরাইলের জমিদারি পান। পরবর্তীতে কিশোরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, শেরপুর, ভাওয়াল, ময়মনসিংহের কিছু এলাকা জুড়ে তার জমিদারি ছড়িয়ে পড়ে।
সেসময়কার ঘটনাবলী নিয়ে লেখা ঐতিহাসিকদের লেখা এবং লোকগাথায় ঈশা খাঁর কৌশল ও বীরত্বের নানা বিবরণ পাওয়া যায়।
ইতিহাসে ঈশা খাঁ পরিচিতি এবং খ্যাতি পেয়েছেন মুঘলদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কারণে। আফগান শাসকদের পতনের পর যখন বাংলা অঞ্চলে মুঘলরা শাসন বিস্তারের চেষ্টা করছিল, তাদের বিরুদ্ধে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ঈশা খাঁসহ বাংলার বারো ভূঁইয়ারা।
যদিও বারো ভূঁইয়া মানে ১২ জন নন, বরং ‘বড় ভূঁইয়া’ বা একাধিক ভূঁইয়া বোঝানো হয় বলে অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন। কিন্তু মুঘলদের বিরুদ্ধে সেই যুদ্ধে যারা নেতৃস্থানীয় ভূমিকা নিয়েছিলেন, তাদের অন্যতম ঈশা খাঁ।
তার নেতৃত্বেই বাংলার ভূঁইয়ারা মুঘল নৌবাহিনীকে হটিয়ে দিয়েছিল। ইতিহাসবিদরা ঈশা খাঁ সম্পর্কে লিখেছেন, তিনি ছিলেন একাধারে সাহসী, বীরত্বপূর্ণ চরিত্রের পাশাপাশি কপটতা, কৌশলী একজন ব্যক্তি।
মুঘলদের সঙ্গে যুদ্ধে তিনি একাধিকবার সন্ধি করেছেন, আবার সেই সন্ধি ভেঙ্গে লড়াই করেছেন। ‘বারভূঁইয়া বা ষোড়শ শতাব্দীর বাঙ্গালার ইতিহাস’ বইতে আনন্দনাথ রায় ঈশা খাঁ প্রসঙ্গে লিখেছেন, “তাহার কমনীয় দেহ যেরূপ একদিকে বীরত্বব্যঞ্জক ও স্বাধীনতা প্রয়াসী ছিল, অপরদিকে সেইরূপ কপটতা, মিত্রদ্রোহিতা, স্বার্থপরতা প্রভৃতি তার অস্থিমজ্জার সাথে জড়িয়ে পড়েছিল….ঈশা খাঁ যে একজন প্রকৃত যোদ্ধা ও স্বদেশ প্রাণ ছিলেন, এ বিষয়ে সন্দেহ নাই।”
ইতিহাসবিদদের মতে, সোনারগাঁ ঘাটিতে থাকা মুঘল নৌ সেনাপতি শাহ বরদীর ওপর আক্রমণ করে সৈন্যসামন্তকে বিতাড়িত করেছিলেন। এই কারণে তখনকার বাংলার আফগান শাসক দাউদ খান কররানি ঈশা খাঁকে মসনদ-ই-আলা উপাধি দেন। যদিও ইতিহাসবিদ মাহবুব সিদ্দিকীর লেখা ‘মসনদ-ই-আলা ঈশা খান’ বইয়ে লিখেছেন, এ উপাধি ঈশা খাঁ নিজেই নিয়ে থাকতে পারেন।
সে সময় অনেকের নিজে থেকে এরকম উপাধি নেয়ার রীতি ছিল। যদিও তার উত্তরসূরিরা শুধুমাত্র দেওয়ান উপাধি ব্যবহার করেছেন। এর দুই বছর পরের বর্ষাকালে সুবাদার খান জাহানের নেতৃত্বে বিশাল মুঘল বাহিনী এসে ঈশা খাঁর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে।
বর্তমান কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামের কাছাকাছি কাইথান নামের স্থানে মুঘল বাহিনীর সঙ্গে ঈশা খাঁর বড় ধরনের যুদ্ধ হয়। সে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন আশেপাশের এলাকার অন্য জমিদাররাও। এই সম্মিলিত বাহিনীর কাছে মুঘল নৌবাহিনী পরাজিত হয়।
কিন্তু ঈশা খাঁ বুঝতে পেরেছিলেন, এরপর আরও বড় শক্তি নিয়ে আক্রমণ করতে আসবে মুঘল বাহিনী। ফলে তিনি ওই এলাকা ছেড়ে চট্টগ্রামে এক বছরের বেশি সময় অবস্থান করেন। সেই সময় ত্রিপুরার রাজার সাথে তার যোগাযোগ হয়। ত্রিপুরার রাজমালা দিঘি খনন করার সময় আরও কয়েকজন জমিদারের মতো শ্রমিক পাঠিয়েছিলেন ঈশা খাঁ।
সেই সময় অন্য জমিদারদের সঙ্গে নিয়ে আস্তে আস্তে শক্তি বৃদ্ধি করছিলেন ঈশা খাঁ। আশেপাশের এলাকার জমিদারদের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ আর সম্পর্ক বৃদ্ধি করছিলেন। ত্রিপুরা রাজের কাছেও তিনি সৈন্য চেয়েছিলেন।
ঈসা খাঁকে নিয়ে একটা গল্প প্রচলিত আছে। ‘বারভূঁইয়া বা ষোড়শ শতাব্দীর বাঙ্গালার ইতিহাস’ বইতে আনন্দনাথ রায় লিখেছেন, সে সময় বিক্রমপুর অঞ্চলের ফুলবাড়িয়া এবং শ্রীপুরের শাসক ছিলেন দুই ভাই চাঁদ রায় এবং কেদার রায়। কোন এক সময়ে ঈশা খাঁ মসনদ-ই-আলী শ্রীপুরে বেড়াতে আসেন।
চাঁদ রায় তাকে যথাসাধ্য অভ্যর্থনা ও খাতির যত্ন করলেও এই ভ্রমণই তাদের বন্ধুত্ব বিচ্ছেদ এবং মনোমালিন্যের কারণ হয়ে ওঠে। চাঁদ রায়ের বিধবা কন্যা অসামান্য সুন্দরী স্বর্ণময়ী বা সোনামণিকে ভালো লেগে যায় ঈশা খাঁর। সোনারগাঁয়ে ফিরে আসার পর তিনি সোনামণিকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে দূত পাঠান চাঁদ রায়ের কাছে।
আনন্দনাথ রায় লিখেছেন, ঈশা খাঁর ধারণা ছিল, বিধবা একজন রমণীকে পরিত্যাগ করতে, বিশেষ করে তার মতো একজন ব্যক্তির কাছে বিয়ে দিতে রায় রাজারা অসম্মত হবে না।
কিন্তু হিন্দু ধর্মাবলম্বী একজন স্বাধীন রাজার কাছে স্ত্রী, কন্যা বা বোনকে চেয়ে পাঠানো যে কত বড় ধৃষ্টতা হবে, তা তিনি বুঝতে পারেননি। বিয়ের প্রস্তাব পেয়েই দূতকে তাড়িয়ে দিয়ে ঈশা খাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন কেদার রায়।
আক্রমণ করে তারা ঈশা খাঁর কলাকাছিয়ার দুর্গ বিধ্বস্ত করে দেন। ঈশা খাঁ ত্রিবেণীর দুর্গে আশ্রয় নেন। কেদার রায়ের সৈন্যরা খিজিরপুরে আক্রমণ করে। সেই সময় চাঁদ রায়ের একজন আমলা শ্রীমন্ত রায় ছিলেন খিজিরপুরে। আগে থেকেই তিনি রায় ভাইদের ওপর অসন্তুষ্ট ছিলেন। তিনি গিয়ে ঈশা খাঁর সাথে হাত মেলান।
চাঁদ ও কেদার রায়ের রাজধানী শ্রীপুরে এসে শ্রীমন্ত রায় জানান, রাজা এবং কুমার পরাজিত হয়ে ঈশা খাঁর হাতে বন্দী হয়েছে। এখন ঈশা খাঁ সৈন্য নিয়ে শ্রীপুর আক্রমণ করে সোনামণিকে নিতে আসছে।
ইতিহাসবিদ আনন্দনাথ রায় লিখেছেন, এই খবর রাজধানীতে ছড়িয়ে পড়ার সোনামণিকে রক্ষা করার জন্য শ্রীমন্তের পরামর্শে তার সঙ্গেই শ্বশুর বাড়ি চন্দ্রদ্বীপ বা বর্তমানের বরিশালে পাঠিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
নৌকায় করে রওনা দিয়ে রক্ষক শ্রীমন্ত তাকে সোনারগাঁয়ে নিয়ে এসে ঈশা খাঁর হাতে তুলে দেন। এই খবর জানতে পেরে চাঁদ রায় যুদ্ধ বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এর কিছুদিন পরে তিনি রাজ্যভার কেদার রায়ের হাতে ছেড়ে দেন।
পরবর্তীতে ঈশা খাঁর মৃত্যুর পর সোনারগাঁয়ে এক লড়াইয়ে মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন স্বর্ণময়ী।
উড়িষ্যা বিজয়ের পর ১৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার সুবাদার হিসাবে মানসিংহকে দায়িত্ব দেন মুঘল সম্রাট আকবর। দায়িত্ব নেয়ার পরেই বাংলা বিজয়ের দিকে বিশেষ নজর দেন মানসিংহ। পরের বছর ডিসেম্বর মাসে রাজা মানসিংহ বিশাল মুঘল বাহিনী নিয়ে ভাটি বাংলার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সে যুদ্ধ চলে পরের বেশ কয়েক বছর ধরে।
ভূঁইয়াদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে প্রথমদিকে বেশ কয়েকবার মুঘল বাহিনীকে হোঁচট খেতে হয়েছে। কিন্তু আস্তে আস্তে বাংলার বিভিন্ন এলাকা তাদের দখলে আসতে থাকে। এই লড়াইয়ে কখনো ঈশা খাঁ সন্ধি করেছেন, কখনো সন্ধি ভেঙ্গে বিদ্রোহী হয়েছেন।
পরবর্তীতে যুদ্ধে মানসিংহের দুই পুত্রও নিহত হয়। শোকাহত মানসিংহ সুবাদারীর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চাইলে সম্রাট আকবর তাকে দিল্লিতে ডেকে নেন। বিভিন্ন লোকগাথায় ঈশা খাঁয়ের সাথে মানসিংহের সরাসরি তলোয়ার যুদ্ধের কাহিনী শোনা যায়।
কিন্তু ইতিহাসবিদদের মতে, মানসিংহের সাথে সামনাসামনি ঈশা খাঁর কোন যুদ্ধ হয়নি। ঈশা খাঁকে বন্দি করে আগ্রায় পাঠানোর কোন ঘটনাও ঘটেনি। যে সময়ের বর্ণনায় ওই লড়াইয়ের কথা বলা হয়, তার কিছুদিন পরই অর্থাৎ ১৫৯৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মারা যান ঈশা খাঁ। পরবর্তীতে সোনারগাঁয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন ঈশা খাঁর ছেলে মুসা খাঁ। বহু বছর মুঘলদের বিরুদ্ধে লড়াই করে ১৬১১ সালে ইসলাম খাঁয়ের কাছে আত্মসমর্পণ করেন মুসা খাঁ।
আপনার মতামত জানানঃ