বিয়ে এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মধ্য দিয়ে যাবার মাধ্যমে দুজন মানুষ বাকিটা জীবন একে অপরের সাথে বিশ্বস্ততা ও ভালোবাসা নিয়ে থাকার ব্যাপারে অঙ্গীকার করে। তবে সাম্প্রতিক বিশ্বে এমন বিয়ের নজিরও আছে, যেখানে একজন জীবিত ব্যক্তি বিয়ে করছেন একজন মৃত মানুষকে! শুনতে অদ্ভুত লাগলেও এটাই সত্য।
নেক্রোগ্যামি নামে পরিচিত অদ্ভুত এ চর্চার দেখা মেলে চীন, থাইল্যান্ড, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ আফ্রিকা সহ নানা দেশে। তেমন ৫টি ঘটনা নিয়েই সাজানো হয়েছে আজকের এ লেখা।
সেসেলিয়া ক্লেইম্যান ও আইজ্যাক ওজিনিয়াক
১৯৮৭ সালের জানুয়ারি মাস। ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের একটি ধর্মীয় উৎসব চলাকালে বিয়ের কাজটা সেরে নেন ক্লেইম্যান ও ওজিনিয়াক দম্পতি। কিন্তু ভাগ্য খারাপ হলে যা হয়। বিয়ের মাত্র দু’মাসের মাথায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ওজিনিয়াক। স্বামী হারানোর দুঃখের সাথে ক্লেইম্যানের জীবনে যোগ হয় আরেক ঝামেলা। তাদের যে বিয়ে হয়েছিল, সেই সনদ তার কাছে ছিল না। আসলে ভেনেজুয়েলার এক নারীকে ওজিনিয়াক আগে বিয়ে করেছিলেন। ২য় বিয়ের সনদপত্র পেতে তাকে ১ম স্ত্রীর কাছ থেকে বিচ্ছেদের কাগজপত্র দেখানো লাগতো। কিন্তু তখন তার হাতে সেটা না থাকায় বিয়ে হলেও সনদ আসে নি।
বিয়েটা পরিচালনা করেছিলেন র্যাবাই মেয়ার আব্রামোউইৎজ। তিনি চাইলেই বিয়ের অনুষ্ঠানটা দরকারি কাগজপত্র আসার আগপর্যন্ত স্থগিত করতে পারতেন। কিন্তু ততদিনে শতাধিক অতিথিকে দাওয়াতপত্র পাঠানো হয়ে যাওয়ায় তিনি আর বিয়েটা পেছাতে চাইলেন না।
কিন্তু সনদ না থাকাতে সেই বিয়েটা আসলে গ্রহণযোগ্য হয় নি। অবশেষে ক্লেইম্যানকে আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল। আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে এক বিচারকের তত্ত্বাবধানে এবং ওজিনিয়াকের পক্ষে এক কর্মচারী সাইন করার মাধ্যমেই সম্পন্ন হয় সেই বিয়ে।
জুলিয়া পাক ও হিউং জিন মুন
দক্ষিণ কোরিয়ার ইউনিফিকেশন চার্চের নেতা সান মিয়ুং মুন ও হাক জা হান দম্পতির ছেলে হিউং জিন মুন ১৯৮৪ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। এই চার্চের বিশ্বাস অনুযায়ী, কেবলমাত্র বিবাহিত ব্যক্তিরাই স্বর্গে প্রবেশ করতে পারবে, অন্যরা নয়।
নিজের ছেলে স্বর্গে যেতে পারবে না, এমনটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেন নি মুনের বাবা-মা। ওদিকে জুলিয়া পাক নামের এক তরুণীর সাথে মুনের সম্পর্কের কথা জানতেন তার বাবা-মা। তাই পাকের পরিবারকে রাজি করিয়ে সেই বছরেরই ২০ মার্চ জীবিত পাকের সাথে মৃত মুনের একটি আধ্যাত্মিক বিয়ের আয়োজন করেন তারা।
শার্লট ক্যালেট্টা ও ফ্রিডরিখ ফ্রিৎজ ফেফার
ফেফারের কথা প্রথম এসেছিল বিখ্যাত বই ‘অ্যান ফ্রাঙ্ক’স ডায়েরি’তে। সেখানে অবশ্য তার ছদ্মনাম ছিল অ্যালবার্ট ডাসেল। পেশায় দাঁতের ডাক্তার ফেফার যুদ্ধ চলাকালে দু’বছর লুকিয়েছিলেন অ্যান ফ্রাঙ্কের পরিবারের সাথে।
আগে থেকে ফেফারের সম্পর্ক ছিল শার্লট ক্যালেট্টা নামক এক নারীর সাথে। তাদের বিয়ের পথে বাধা তুলে দাঁড়িয়েছিল ১৯৩৫ সালে প্রণীত নুরেমবার্গ আইন। এ আইনানুযায়ী জার্মানীতে তাদের দুজনের বিয়ে সম্ভব ছিল না। কারণ ফেফার ছিল ইহুদী, অন্যদিকে শার্লট অ-ইহুদী এক নারী। তাই বিয়ের আশায় তারা চলে যান নেদারল্যান্ডে। অবশ্য সেখানেও তাদের বিয়েটা আইনগত বৈধতা পেত না।
১৯৪০ সালে নেদারল্যান্ডে আক্রমণ চালায় নাৎসি বাহিনী। ফেফার অ্যান ফ্রাঙ্কের পরিবারের সাথেই লুকিয়ে থাকা শুরু করেন। ১৯৪৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শুরুর দিকে নাৎসি সেনাদের হাতে ধরা পড়েন ফেফার। তাকে প্রথমে পাঠানো হয় অসউইজ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে, সেখান থেকে অক্টোবরে ন্যুয়েনগেমে। সেই বছরের ২০ ডিসেম্বর তাকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার প্রায় এক বছর পর ক্যালেট্টা ফেফারের মৃত্যু সম্পর্কে জানতে পারেন। অবশেষে ১৯৫৩ সালের ৯ এপ্রিল আইনগত বাধা দূর হলে মৃত ফেফারকেই বিয়ে করেন তিনি।
ডেভিড মাসেন্টা ও মাগওয়ানিনি মলোমো
২০০৪ সালের কথা, ঘটনাস্থল দক্ষিণ আফ্রিকার সেরেস নামের ছোট একটি গ্রাম। এ গ্রামেরই দুই বাসিন্দা ছিলেন ডেভিড মাসেন্টা ও মাগওয়ানিনি মলোমো। ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল তাদের মাঝে। সেই সম্পর্ক থেকেই একপর্যায়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন মলোমো। দুই পরিবার তাদের সম্পর্ককে মেনে নিয়েছিল, ঠিক হয়েছিল দুজনের বিয়েও।
এরই মাঝে কী হলো কে জানে, একদিন মলোমোর সাথে রাগারাগির এক পর্যায়ে হুট করে তাকে গুলি করে বসেন মাসেন্টা। সাথে সাথে সেখানেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে মেয়েটি। কী হয়ে গেছে তা বুঝতে পেরে মাসেন্টারও অনুশোচনার সীমা রইলো না। তাই কিছুক্ষণ পর তিনি নিজেও আত্মহত্যার পথই বেছে নেন।
দুই পরিবারের সদস্যরা এ যুগলের শেষ মুহূর্তের তিক্ত ঘটনা সম্পর্কে ভুলে যেতে চাইলেন, তারা মনে রাখতে চাইলেন দুজনের ভালোবাসাময় দিনগুলোর কথাই। তাই সিদ্ধান্ত হলো, দুজনের বিয়ে পড়ানো হবে। এরপর তাই মৃতদেহ দুটিকে কবরে শোয়ানোর আগে একেবারে বিয়ের সাজে সাজিয়ে বিয়ে পড়ানো হয়। এরপরেই তাদের স্থান হয়েছিল কবরে।
এরিক ডেমিকেল ও ক্রিস্টেল ডেমিকেল
পুলিশ অফিসার এরিক ডেমিকেল ও ক্রিস্টেল ডেমিকেলের দেখা হয়েছিল ১৯৯৭ সালে। সময়ের সাথে সাথে এ পরিচয়ই একদিন পরিণয়ের রুপ ধারণ করে। একসময় তারা কমন-ল’ ম্যারেজটাও সেরে নেন। এর মাধ্যমে ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে দুজনের বিয়ের স্বীকৃতি না মিললেও আইনগতভাবে তারা একে অপরের স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বিবেচিত হন।
অবশেষে আসে ২০০২ সাল, ক্রিস্টেলের জীবনের ভালোবাসা কেড়ে নিয়েছিল যে বছরটি। ভয়াবহ এক সড়ক দুর্ঘটনায় পরলোকে পাড়ি জমান এরিক। ক্রিস্টেল তখন এক মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। দুঃখজনক কথা হলো, কয়েক সপ্তাহ পর তার গর্ভের সন্তানটিও মারা যায়।
একসময় ক্রিস্টেল নেক্রোগ্যামি সম্পর্কে জানতে পারেন। তারপরই তিনি নিজের আর এরিকের পরিবারকে রাজি করান মৃত এরিকের সাথে তার বিয়েটা ধর্মীয়ভাবে সেরে ফেলার ব্যাপারে। এ ঘটনা এরিককে ক্রিস্টেলের জীবনে ফিরিয়ে আনতে না পারলেও তাকে দিয়েছিল মানসিক প্রশান্তি। তার ভাষ্যমতে, “বিয়েটার মাধ্যমে আমি কোনোকিছু নতুন করে কোনোকিছু গড়ে তুলতে পারলাম, যা আসলে আরো অনেক আগেই হওয়া উচিত ছিল। সেই সাথে এর মাধ্যমে আমার ভবিষ্যৎ জীবনটাকেও গড়ে নিতে পারলাম।”
আপনার মতামত জানানঃ