শিক্ষক-কর্মকর্তাসহ মোট ৫৮টি পদের নিয়োগ প্রক্রিয়া গত ২ ডিসেম্বর সম্পন্ন করেছে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এসব পদে নিয়োগপ্রাপ্তদের একজন উপাচার্য অধ্যাপক স্বদেশ চন্দ্র সামন্তের ছেলে শাওন চন্দ্র সামন্ত তনু। তবে এ নিয়োগে যোগ্যতা নিরূপণের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক সমিতি। এ বিষয়ে সংগঠনটির পক্ষ থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অভিযোগও করা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বর্তমানে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)।
এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখা গেছে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়েও। অভিযোগ রয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়টিতে এখন পর্যন্ত যারা উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন তাদের সবাই মেয়াদকালে কোনো না কোনো আত্মীয়কে নিয়োগ দিয়েছেন। সর্বশেষ গত ১৮ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়টিতে সেকশন অফিসার হিসেবে চাকরি পেয়েছেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শহীদুর রশীদ ভুঁইয়ার ছোট ছেলে হামিম আল রশীদ।
গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বশেমুরবিপ্রবি) ২০২২ সালে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির শর্ত পূরণ না করে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে নিয়োগ দেয়া হয় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. ছাদেকুল আরেফিনের মেয়ে অহনা আরেফিনকে।
এর কিছুদিন পরই বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট বিভাগে নিয়োগ পান বশেমুরবিপ্রবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. একিউএম মাহবুবের মেয়ে ফারজানা মাহবুব। এছাড়া বশেমুরবিপ্রবির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. খোন্দকার নাসিরউদ্দিন তার মেয়াদকালে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে নিয়োগের শর্ত শিথিল করে তার ভাতিজা খন্দকার মাহমুদ পারভেজকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন।
দেশের উচ্চশিক্ষার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিতে দেশে বিগত কয়েক দশকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়িয়েছে সরকার। দীর্ঘদিন ধরেই এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতিসহ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠছে। শিক্ষাবিদদের অভিযোগ, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন উপাচার্যদের আত্মীয়দের ‘কর্মসংস্থান কেন্দ্র’ হয়ে উঠেছে। নতুন নিয়োগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পদে আত্মীয়-অনুসারীসহ কাছের মানুষদের নিয়োগ দিচ্ছেন উপাচার্যরা।
কম-বেশি প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই উপাচার্যদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় এমন অভিযোগ উঠছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক-কর্মকর্তারা বলছেন, আত্মীয়স্বজনসহ নিজস্ব লোক নিয়োগদানের মাধ্যমে উপাচার্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও প্রশাসনে নিজেদের অবস্থান শক্ত করছেন। আবার কারো কারো উপাচার্য হিসেবে নিযুক্তি বেকার আত্মীয়ের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রশাসনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ার পাশাপাশি একাডেমিক কার্যক্রমে ব্যাঘাতও ঘটছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এডুকেশন ওয়াচের চেয়ারপারসন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ইকোনমিকসের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, ‘এটা খুবই দুঃখজনক যে আমাদের দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই নিয়োগে স্বজনপ্রীতিসহ নানা অনিয়ম হচ্ছে। এর ফলে যোগ্য প্রার্থীরা যেমন বঞ্চিত হচ্ছেন, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও পিছিয়ে যাচ্ছে।
এ জায়গা থেকে বের হতে আমাদের পর্যাপ্ত মনিটরিং নিশ্চিত করতে হবে এবং যারা নিয়োগ পরীক্ষা গ্রহণ করবেন, তাদের সৎ হতে হবে। নিয়োগের ক্ষেত্রে সাধারণত প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব নিয়োগবিধি থাকে। নিয়োগের ক্ষেত্রে যদি লিখিত পরীক্ষা গ্রহণ করা যায়, সেক্ষেত্রে একটি সুবিধা হলো যে পরীক্ষায় কে ভালো করেছে সেটি বোঝা যায়। তবে পরীক্ষা লিখিত হোক বা মৌখিক, নিয়োগ পরীক্ষা যারা গ্রহণ করবেন তাদের সততা অত্যন্ত জরুরি। আর এটি নিশ্চিত করতে হলেই মনিটরিং প্রয়োজন। মনিটরিংয়ে যাদের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ পাওয়া যাবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে অন্যরা এ ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকবে।’
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ তথ্য যাচাই করে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ২০২২ সালের ১৬ নভেম্বর প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির তথ্য অনুযায়ী কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ মোট ৩৯ জনের নিয়োগ হওয়ার কথা ছিল। তবে গত ২ ডিসেম্বর রিজেন্ট বোর্ডে সর্বমোট ৫৮ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়। এদের মধ্যে সেকশন অফিসার পদে তিনজনের পরিবর্তে ছয়জন, ল্যাব অ্যাটেন্ডেন্ট পদে ছয়জনের পরিবর্তে নয়জন এবং অফিস সহায়ক পদে পাঁচজনের পরিবর্তে ১১ জন নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এছাড়া আইকিউএসি বিভাগের হিসাবরক্ষক পদের অনুমোদন না থাকলেও একজনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
শিক্ষক-কর্মকর্তাদের অভিযোগ, নিজ ছেলেকে নিয়োগ দিতেই লিখিত পরীক্ষা নেননি উপাচার্য। এমনকি প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নিজের পক্ষে রাখতে তাদের সুপারিশকৃত আত্মীয়স্বজনসহ তিনটি পদের বিপরীতে মোট ছয়জনকে নিয়োগ দিয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর ড. মো. আসাদুজ্জামান মিয়া বলেন, ‘আমরা চাই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হোক। যখন শুধু ভাইভার মাধ্যমে নিয়োগ প্রদান করা হয় তখন সেখানে প্রভাব বিস্তার অপেক্ষাকৃত সহজ হয়। বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তোলারও সুযোগ থাকে। এ কারণে আমরা লিখিত পরীক্ষার সুপারিশ করেছিলাম। কিন্তু তা করা হয়নি। এছাড়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রদান না করেই প্রায় ১৯টি পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে, যা সম্পূর্ণরূপে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের লঙ্ঘন।’
এ বিষয়ে জানতে নানাভাবে চেষ্টা করেও পবিপ্রবি উপাচার্য অধ্যাপক স্বদেশ চন্দ্র সামন্তের বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়টির রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. সন্তোষ কুমার বসু বলেন, ‘আমাদের কোনো নিয়োগেই লিখিত পরীক্ষা নেয়া হয় না। মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমেই নিয়োগ হয়। এক্ষেত্রেও তেমনটিই হয়েছে। আর আমরা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলাম ২০২২ সালে এবং এরপর আমাদের বেশ কয়েকটি পদ শূন্য হয়েছে। নতুন বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নিয়োগ সময়সাপেক্ষ হওয়ায় এবং যোগ্য প্রার্থী পেয়ে যাওয়ায় আমরা এসব পদের বিপরীতে একবারেই লোক নিয়ে নিয়েছি।’
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকশন অফিসার হিসেবে গত মাসের মাঝামাঝি নিয়োগ পেয়েছেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শহীদুর রশীদ ভুঁইয়ার ছোট ছেলে হামিম আল রশীদ। এর আগেও তিনি বিভাগীয় শিক্ষক থাকা অবস্থায় তার বড় ছেলে আসাদুল্লাহ হিল কাফি এবং উপ-উপাচার্য থাকা অবস্থায় তার এক ভাগনি নিয়োগ পেয়েছেন।
অভিযোগ আছে, বিশ্ববিদ্যালয়টির বেশ কয়েকজন সাবেক উপাচার্যও তাদের মেয়াদকালে কোনো না কোনো আত্মীয়কে সেখানে নিয়োগ দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়টির একাধিক শিক্ষক-কর্মকর্তার ভাষ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ নিয়োগেও প্রার্থীদের মধ্যে উপাচার্যের ছেলের তুলনায় যোগ্য প্রার্থী ছিল। আর উপাচার্যের ছেলের নিয়োগের ক্ষেত্রে ভেরিফিকিশনের নিয়ম মানা হয়নি। ১৯ ডিসেম্বরেই তারা কাজে যোগদান করেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শেকৃবির উপাচার্য শহীদুর রশীদ ভুঁইয়া বলেন, ‘বিজ্ঞপ্তির সব শর্ত পূরণ করে এবং আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগবিধি অনুযায়ী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেই আমার ছেলে নিয়োগ পেয়েছে। এক্ষেত্রে কোনো শর্ত শিথিল করা হয়নি। সেকশন অফিসার পদে আরো যারা নিয়োগ পেয়েছেন তাদের তুলনায় তার ফলাফলও খারাপ নয়। এর আগে বড় ছেলে এবং ভাগনির নিয়োগের ক্ষেত্রেও তারা অন্য সব আবেদনকারীর মতোই বিজ্ঞপ্তির সব শর্ত পূরণ করে নিয়োগ পেয়েছে। তখন আমি উপাচার্যও ছিলাম না। আর উপাচার্যের সন্তান বা আত্মীয় হওয়া তো অপরাধ নয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘যদি এমন হতো যে ছেলেকে নিয়োগ দিতে গিয়ে আমি কোনো শর্ত শিথিল করেছি তাহলে অভিযোগের সুযোগ থাকত। কিন্তু তেমনটা তো ঘটেনি। আর যে বাছাই বোর্ডের মাধ্যমে আমার ছেলে নিয়োগ পেয়েছে সে বোর্ডের চেয়ারম্যান আমি ছিলাম না। উপ-উপাচার্য সেই বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। এর পরও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ তোলার কারণ হলো আমি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও প্রভাবমুক্ত করার চেষ্টা করছি। অনেকটাই প্রভাবমুক্ত করেছি। ফলে অনেকের প্রত্যাশা পূরণ হচ্ছে না। এ কারণেই ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এসব অভিযোগ তোলা হচ্ছে।’
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এমন চিত্রকে বর্তমান সময়ের বাস্তবতা হিসেবে দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘দেশে উন্নয়ন হলেও কর্মসংস্থান বাড়েনি। বরং অনেক জায়গায় সংকুচিত হয়েছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ না বাড়ায় এ ধরনের নিয়োগের প্রবণতা বাড়ছে। নিয়োগে স্বজনপ্রীতি ও অনিয়ম বন্ধ করতে হলে প্রথমত কর্মসংস্থান সৃষ্টিমূলক উন্নয়ন করতে হবে এবং সম্পদের পাচার রোধ করতে হবে।’
আবার দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে একে অন্যের সন্তানকে শর্ত ভঙ্গ করে নিয়োগ দেয়ার অভিযোগও আছে। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মো. ছাদেকুল আরেফিনের মেয়ে অহনা আরেফিনকে নিয়োগের শর্ত ভঙ্গ করে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে নিয়োগ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. একিউএম মাহবুবের বিরুদ্ধে।
সে সময় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে যোগ্যতা হিসেবে মাস্টার্স ডিগ্রির কথা উল্লেখ করা ছিল। এতে বলা হয়েছিল মাস্টার্স ডিগ্রিধারী প্রার্থী না থাকলে স্নাতক ডিগ্রিধারীদের বিবেচনা করা হবে। ওই বিভাগের প্রার্থীদের তালিকা অনুযায়ী যারা আবেদন করেছিলেন তাদের মধ্যে একাধিক মাস্টার্স ডিগ্রিধারী প্রার্থী ছিলেন। যদিও মাস্টার্স ডিগ্রি না থাকা সত্ত্বেও নিয়োগ পান অহনা আরেফিন।
তার নিয়োগের কয়েক মাস পরই বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান ড. একিউএম মাহবুবের মেয়ে ফারজানা মাহবুব। অভিযোগ রয়েছে, সেখানেও ফারজানা মাহবুবের চেয়ে ভালো ফলাফলধারী থাকলেও বশেমুরবিপ্রবি উপাচার্যের মেয়ে হিসেবে তিনি বাড়তি সুযোগ পেয়েছেন।
এ বিষয়ে অহনা আরেফিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি যাচাই করে পরে কল দেয়ার পরামর্শ দেন। যদিও পরে তিনি আর প্রতিবেদকের কল রিসিভ করেননি।
বশেমুরবিপ্রবি উপাচার্যের মেয়ে ফারজানা মাহবুবের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কিছু বলতে চাচ্ছি না। আপনারা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিসহ সবকিছু যাচাই করে দেখুন, যারা ভাইভা বোর্ডে ছিল তাদের সঙ্গে কথা বলুন।’
এ বিষয়ে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ছাদেকুল আরেফিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোনে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে বশেমুরবিপ্রবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. একিউএম মাহবুবের দাবি, ভাইভা বোর্ডের পারফরম্যান্সের ওপর নির্ভর করেই তিনি অহনা আরেফিনকে নিয়োগ দিয়েছেন। এছাড়া তার মেয়ে ফারজানা মাহবুবও নিজ যোগ্যতায়ই নিয়োগ পেয়েছেন।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘নিয়োগ বোর্ডে এক্সপার্ট মেম্বাররা ছিলেন এবং নিয়োগের একটা গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি ভাইভা। অনেক প্রার্থীর দেখা গেছে রেজাল্ট ভালো, কিন্তু ভাইভায় ঠিকভাবে ইংরেজিতে উত্তর দিতে পারছে না। ভাইভায় যে প্রার্থী সবচেয়ে ভালো করেছে তাকেই নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আর সে ভারতের একটা নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তরে অধ্যয়নরত। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিষয়গুলোয় এভাবে নিয়োগের বিষয়টি প্রচলিত আছে।’
নিজ মেয়ের বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা দশ শিক্ষার্থীর একজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার মতো সব যোগ্যতা তার আছে এবং বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সে সম্পূর্ণ নিজের যোগ্যতায় নিয়োগ পেয়েছে।’
বশেমুরবিপ্রবিতে এর আগেও শর্ত শিথিল করে উপাচার্যের আত্মীয়দের নিয়োগ দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। ২০১৭ সালের জুলাইয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন তৎকালীন উপাচার্য খোন্দকার নাসিরউদ্দিনের ভাইপো খন্দকার মাহমুদ পারভেজ। তৎকালীন নিয়মানুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার জন্য স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণী বাধ্যতামূলক থাকলেও মাহমুদ পারভেজের দুটোতেই ছিল দ্বিতীয় শ্রেণী। নিয়োগসহ নানাবিধ অনিয়মের অভিযোগে পরবর্তী সময়ে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের একটি তদন্ত কমিটি খোন্দকার নাসিরউদ্দিনকে অপসারণের সুপারিশ করে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় স্বতন্ত্র কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করলে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি কমে আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর দে বলেন, ‘গুচ্ছের কারণে আমাদের ভর্তি প্রক্রিয়া অনেকটাই সহজ হয়ে গেছে। যদি শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও এমন কেন্দ্রীয় কোনো নিয়োগ প্রক্রিয়া থাকত, তাহলে আমাদের জন্য সবদিক থেকেই ভালো হতো। স্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের সুযোগ যেমন কমে আসত, তেমনি আমরাও চাপমুক্ত থাকতাম।’
ইউজিসির ২০২১ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে এ-সংক্রান্ত একটি সুপারিশও করা হয়। তবে পরবর্তী সময়ে এ বিষয়ে আর কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ইউজিসির ওই সুপারিশে বলা হয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে প্রায়ই স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির অভিযোগ জাতীয় গণমাধ্যমগুলোয় প্রকাশিত হয়। ফলে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। নিয়োগে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত এবং যোগ্যতাসম্পন্ন জনবল নিয়োগের উদ্দেশ্যে একটি ‘স্বতন্ত্র নিয়োগ কমিশন’ গঠন করা যেতে পারে। এছাড়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগের জন্য ইউজিসি প্রণীত পৃথক পৃথক নিয়োগের ন্যূনতম যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা নির্ধারণী নির্দেশিকার আলোকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দ্রুত নীতিমালা প্রণয়ন করে তা কার্যকর করতে পারে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের বলেন, ‘উপাচার্যদের নিয়ে এ ধরনের বিভিন্ন অভিযোগ ইউজিসির কাছেও এসেছে। প্রতিটি নিয়োগে অবশ্যই সব প্রার্থীর সমান সুযোগ পাওয়া উচিত। কে কার আত্মীয়, এটি কোনো যোগ্যতা হতে পারে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগে স্বচ্ছতা নিশ্চিতে আমরা একটি স্বতন্ত্র কমিশনের সুপারিশ করেছিলাম। এটি করা গেলে নিয়োগে স্বজনপ্রীতি বা দুর্নীতি প্রায় পুরোপুরি দূর করা যেত।’
তিনি আরো বলেন, ‘বর্তমান নিয়োগপদ্ধতির ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ম হলো লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজেদের অধীনে নিয়োগের ক্ষেত্রেও যদি লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষা উভয়ই নেয়া হয় তবে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে অযোগ্যদের নিয়োগের সুযোগ কমে আসবে। কারণ লিখিত পরীক্ষায় কেউ চাইলেই নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী নম্বর দিতে পারবেন না এবং পছন্দের প্রার্থীকে বাড়তি সুবিধা দিতে পারবেন না। এ কারণে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে যেকোনো নিয়োগেই মৌখিক পরীক্ষার পাশাপাশি লিখিত পরীক্ষা নিতে উৎসাহিত করছি।
আপনার মতামত জানানঃ