ক্রমবর্ধমান ডলার-সংকট মোকাবিলায় সরকার বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অন্তত ১৪টি প্রকল্পের জন্য বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ অর্থায়ন সংগ্রহের চেষ্টা করছে বলে জানা গেছে (আজকের পত্রিকা, ৫ জুলাই ২০২৩)। এ-সংক্রান্ত প্রস্তাবও ইতিমধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে পাঠানো হয়েছে। পরিকল্পনামন্ত্রী বিষয়টি অকপটে স্বীকার করেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীও একই কথা বলেছেন।
দেশে ডলার-সংকট আগে থেকেই চলছে, যা সরকার এত দিন আড়াল করার চেষ্টা করে এসেছে। বাস্তব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের প্রায় বাইরে চলে যাওয়ায় সরকার এখন তা স্বীকার করছে। এক বছর আগে এটা স্বীকার করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হলে, আজ পরিস্থিতি যতটা খারাপ, ততটা খারাপ না-ও হতে পারত।
কিন্তু সরকারের পক্ষে রাজনীতিক বা আমলা কেউই সে পথে হাঁটেননি। বৈদেশিক মুদ্রার এরূপ চরম সংকট থাকা সত্ত্বেও এক বছরে পরিহারযোগ্য আমদানি, অপ্রয়োজনীয় বিদেশি পরামর্শক নিয়োগ, বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোর উদ্যাপন, ঠুনকো প্রয়োজনে একা একা বা লাটবহর নিয়ে বিদেশ ভ্রমণ ইত্যাদি কোনোটাই থেমে থাকেনি।
বৈদেশিক মুদ্রার চরম সংকটের এই মুহূর্তে কী প্রয়োজন ছিল এরদোয়ানের অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতির তুরস্ক গমন? সাম্প্রতিক হজ মিশনে শত শত লোকের লাটবহর পাঠানোর কোনো প্রয়োজনই ছিল না। এ রকম আরও অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে।
ধারণাগত আলোচনা থেকে এবার প্রকল্পভিত্তিক আলোচনায় আসা যাক। যে ১৪টি প্রকল্পের জন্য বৈদেশিক মুদ্রায় অর্থায়ন সংগ্রহের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে, উন্নয়ন অর্থনীতির বিষয়ে ছিটেফোঁটা জ্ঞান আছে এরূপ ব্যক্তিমাত্রই এ বিষয়ে এতটুকু দ্বিধা না করে বলবেন, দেশের চরম অর্থনৈতিক সংকটের মুহূর্তে এই প্রকল্পগুলোর কোনোটিই নেওয়া সমীচীন হবে না, ঋণ গ্রহণ তো নয়ই।
এরপরও যদি সেটি করা হয়, তাহলে বিষয়টি শুধু আত্মঘাতীই হবে না, দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থের বিপরীতে দাঁড়ানোর শামিল বলেও গণ্য হবে। বর্তমান লেখায় যে ১৪টি প্রকল্পের বাস্তবায়ন বা সেগুলোর জন্য বিদেশি ঋণ নেওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য বলা হলো, সেই পরামর্শ প্রত্যাখ্যাত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
ঢাকা মহানগরীর পরিবহনব্যবস্থার উন্নয়নে সাম্প্রতিক কালে মেট্রোরেলসহ যেসব মেগা প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, এর অধিকাংশই বাস্তবে তেমন কোনো কাজে আসেনি; বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা নগরীর নান্দনিকতা ও পরিবেশকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং বহুক্ষেত্রে নতুন করে যানজট আরও বাড়িয়েছে।
এমনটি ঘটার মূল কারণ, প্রকল্পগুলো কোনো দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত পরিকল্পনার আওতায় নেওয়া হয়নি এবং সেগুলো নেওয়ার ক্ষেত্রে স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের মতামতের চেয়ে বিশেষ উদ্দেশ্যে দেশি-বিদেশি ঠিকাদার ও সংশ্লিষ্ট উন্নয়ন সহযোগীদের আকাঙ্ক্ষাকেই অধিকতর প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
একই ধারাবাহিকতায় ডলার-সংকট মোকাবিলায় ঋণ নেওয়ার আশায় ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্টের মতো যে প্রকল্পের প্রস্তাব ইআরডিতে পাঠানো হয়েছে, অতীতের মতো এটিও রাজধানীর পরিবহনব্যবস্থার উন্নয়নে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে বলে মনে হয় না। অথচ মানসম্মত সমীক্ষা ও গ্রহণযোগ্য মানের সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই এর জন্য বৈদেশিক ঋণ চাওয়া হয়েছে।
অন্য ১৩টি প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই পরিস্থিতিও প্রায় একই রকম। বিস্তারিত সমীক্ষা ছাড়াই নিছক ঋণ সংগ্রহের জন্য তাড়াহুড়া করে এসব প্রকল্প প্রণয়ন করা হয়েছে এবং বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য না থাকলে কোনো উন্নয়ন সহযোগীরই এগুলোতে শরিক হওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ থাকার কথা নয়। তারপরও যদি কেউ বিশেষ উদ্দেশ্যে এগুলোর কোনো কোনোটিতে ঋণ অর্থায়ন করে, তাহলেও প্রশ্ন থেকে যায়, সেই ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য কি এই প্রকল্পগুলোর আছে?
রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায় থেকে প্রায়ই বলতে শোনা যায় যে বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ খুবই নিষ্ঠাবান। তা সেটি হবেই-বা না কেন? অসহায় জনগণের সংখ্যা যখন বিপুল, তখন তাদের ঘাড়ের ওপর বাড়তি করের বোঝা চাপিয়ে খুব সহজেই যে ঋণ পরিশোধ করে দেওয়া যায়! তাতে জনগণের কষ্ট ও ক্লান্তি যতই বাড়ুক না কেন। আর সে জন্যই তো ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখা হয়েছে বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ বাবদ, যে ঋণের পরিমাণ বর্তমানে প্রায় ৯ লাখ কোটি টাকা।
যেসব প্রকল্পের জন্য বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ সংগ্রহের কথা ইআরডিকে বলা হয়েছে, এর সবগুলোর জন্যই যে শেষ পর্যন্ত দাতা পাওয়া যাবে—এমন সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। যেগুলোর জন্য দাতা পাওয়া যাবে না, সেগুলোর ভবিষ্যৎ কী হবে? অভিজ্ঞতা বলে, এ দেশে একবার যে প্রকল্প যাত্রা শুরু করে, সেটি আর প্রায় থামেই না। এখন বৈদেশিক ঋণ পাওয়া না গেলেও নিজেদের স্বার্থ রক্ষার প্রয়োজনে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা একপর্যায়ে স্থানীয় সম্পদ দিয়েই সম্ভাবনাহীন ও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে।
দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায়, বিশেষ করে এর বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে রাষ্ট্রকে অবশ্যই কিছু একটা করতে হবে। এর মানে এই নয় যে এভাবে যাচ্ছেতাই প্রকল্পের জন্য বৈদেশিক ঋণ নিতে হবে। আসলে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হতে পারে বৈদেশিক মুদ্রাসংশ্লিষ্ট ব্যয় কমানো, যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, খাদ্যপণ্য, শিল্পের কাঁচামাল ও মৌলিক যন্ত্রপাতি ব্যতীত অন্য সব পণ্যের আমদানি স্থগিত রাখা।
দ্বিতীয়ত, অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন ব্যতীত মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, আমলাসহ সবার বিদেশ ভ্রমণ এক বছরের জন্য পুরোপুরি বন্ধ করা।
তৃতীয়ত, বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোয় কর্মীদের বেতন-ভাতা ব্যতীত অন্যান্য ব্যয় ২০২৩-২৪ পর্যন্ত বন্ধ রাখা। চতুর্থত, বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে পরামর্শক বা অন্য কোনো জনবল নিয়োগ না করা। পঞ্চমত, বাংলাদেশে সম্ভব নয় এরূপ অস্ত্রোপচার ব্যতীত অন্যবিধ মামুলি চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়াকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা। এর বাইরে ব্যক্তিগত পর্যায়ের বিদেশ ভ্রমণ, বিশেষ করে পর্যটনমূলক বিদেশ ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করা। সূত্র: আজকের পত্রিকা।
এসডব্লিউএসএস/১৯০৫
আপনার মতামত জানানঃ