আধুনিক চিকিৎসায় ইলেক্ট্রোথেরাপি হল মেডিকেল এবং ফিজিওথেরাপিউটিক কৌশলগুলোর একটি সমন্বিত পদ্ধতি – যেখানে বিভিন্ন আঘাত এবং রোগের চিকিৎসায় বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয়। পেশী পুনর্গঠন, দীর্ঘস্থায়ী ব্যথার চিকিৎসা, বিষণ্ণতা এবং মস্তিষ্কের কিছু ক্ষত সারাতে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়ে থাকে।
মানুষ এখন বিদ্যুতের প্রকৃতি বুঝতে শিখেছে এবং বিদ্যুৎকে কীভাবে কাজে লাগাতে হয় তা জানতে শিখেছে, তাই আধুনিক বিশ্বে ইলেক্ট্রো-থেরাপিকে একটি বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি হিসাবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু প্রাচীন গ্রিক ও রোমান যুগে – যখন বিদ্যুতের অস্তিত্ব জানা ছিল না, তখনও মানুষ চিকিৎসার বিদ্যুৎকে কাজে লাগাতো, তবে এক অদ্ভূত উপায়ে।
প্রাচীন গ্রিক এবং রোমানদের এই বিদ্যুৎ ব্যবহারের অভিজ্ঞতা ছিল, এবং অসুস্থতা ও রোগের সমাধান হিসাবে এই বিদ্যুৎকে কাজে লাগানোর প্রস্তাব করা হয়েছিল। কেউ প্রশ্ন করতে পারেন তাদের কি বিদ্যুৎ উৎপন্ন করার এবং তা পরিচালনা করার মতো কোন যন্ত্র ছিল? এর উত্তর হলো না, তবে তাদের বিদ্যুৎ পাওয়ার উৎস ছিল প্রাকৃতিক এবং তা হলো মাছ।
মিশর, গ্রিস এবং রোমের বৈদ্যুতিক মাছ
কিছু প্রজাতির মাছের বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতাকে বলা হয় বায়ো-ইলেক্ট্রোজেনেসিস। এই প্রাণীরা একে অপরের সাথে যোগাযোগ করতে, এবং সেইসাথে শিকার, আত্মরক্ষা, গতিপথ নির্ধারণ, পরিবেশের গতি-প্রকৃতি বুঝতে বা এমন আরও নানা কারণে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে।
কিছু ইলেক্ট্রোজেনিক প্রজাতির মাছ এমন জায়গায় পাওয়া যায়, যেখানে গুরুত্বপূর্ণ সভ্যতা গড়ে উঠেছে, যেমন টর্পেডো রে মাছ (অর্ডার টর্পেডিনিফর্মস) বা আফ্রিকার বৈদ্যুতিক ক্যাটফিশের (ফ্যামিলি ম্যালাপ্টেরুরিডেয়) – যার আবাসস্থল ভূমধ্যসাগর।
আমরা জানি যে মিশরীয়, গ্রিক এবং রোমানরা এসব বৈদ্যুতিক মাছের সাথে পরিচিত ছিল কারণ মিশরীয় স্মৃতিস্তম্ভ, গ্রিক সিরামিক এবং রোমান মোজাইকগুলোয় এগুলোর ত্রিমাত্রিক ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল।
সক্রেটিসের সাথে কথোপকথন
এসব মাছের সংস্পর্শে এলে সাধারণত শারীরিক অসাড়তা দেখা দেয় – বিশেষ করে কেউ যদি তার কোন অঙ্গ দিয়ে এসব মাছ স্পর্শ করে। সম্ভবত এই কারণেই তৎকালীন মেডিকেল গ্রন্থ বা হিপোক্র্যাটিক ট্রিটিজে “তীব্র রোগ নিরাময়ের খাদ্যাভ্যাসে” এক বিশেষ প্রজাতির মাছের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
হয়তো সেটি এক ধরণের ইলেক্ট্রোজেনিক মাছ ছিল, যার নাম ছিল নারকে। যেটা কিনা, ‘নারকোসিস’ শব্দের মূল উৎস বলে ধরা হয়। নারকোসিস হলো ওষুধ বা চেতনানাশক প্রয়োগের ফলে ব্যক্তির অর্ধচেতন অবস্থা। নারকে নামে এই মাছটির এটাই প্রথম কোন লিখিত রেফারেন্স বলে ধরা হয়। নারকে মাছের এমন অসাধারণ বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা সত্ত্বেও, গ্রিক মেডিকেল গ্রন্থ কর্পাস হিপোক্র্যাটিকামে বিদ্যুৎ প্রয়োগ করে কোনও চিকিৎসা দেয়ার কথা উল্লেখ নেই।
প্লেটো (৪২৭-৩৪৭ খ্রিস্টপূর্ব) মেনোতে তার সংলাপে এই প্রাণীদের স্পর্শ করার পরিণতি সম্পর্কে বলেছেন। তিনি একে তুলনা করেছেন সক্রেটিসের সাথে কথোপকথন থেকে উদ্ভূত মানসিক বিভ্রমের সাথে। প্লেটোর ‘মেনো’ হল একটি সক্রেটিক সংলাপ যেখানে দুই প্রধান বক্তা, সক্রেটিস এবং মেনো কথোপকথনের মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান দিয়ে থাকেন।
টর্পেডো রে যে উপায়ে তাদের খাদ্য অনুসন্ধান ও শিকার করে থাকে এর মাধ্যমে মাছটির ধূর্ত বৈশিষ্ট্যের কথা তুলে ধরেছিলেন এরিস্টটল (৩৮৪-৩২২ খ্রিস্টপূর্ব)। তিনি প্রাণীদের উপর তার গবেষণায় উল্লেখ করেছেন যে, এই মাছগুলো সমুদ্রতটে লুকিয়ে থাকে এবং শিকারের কাছে এসে শিকারকে পঙ্গু করে দেয়। তার শিষ্য থিওফ্রাস্টাস (৩৭১ – ২৮৭ খ্রিস্টপূর্ব) সতর্ক করেছিলেন যে টর্পেডো রে-এর বৈদ্যুতিক নিঃসরণ, পানি বা মাছ ধরার ধাতব বঁড়শিসহ আরও বিভিন্ন মাধ্যমে দূর থেকেও সঞ্চারিত হতে পারে। এভাবে, তিনি বৈদ্যুতিক পরিবাহী পদার্থের প্রাচীনতম ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন।
প্রেমময় আবেগ নিবৃত্তের চিকিৎসার জন্য
অন্য অনেক প্রাচীন লেখক এই মাছের অসাধারণ ক্ষমতা সম্পর্কে একই রকম কথা বলেছেন। যেমন সিসেরো (১০৬-৪৩ খ্রিস্টপূর্ব) বা কবি ওপিয়ানো ডি আনাজারবা, যিনি দ্বিতীয় শতাব্দীতে টর্পেডো রে মাছটির দেহের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সঠিক বর্ণনা দিয়েছিলেন বিশেষ করে যেখান থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হতো।
রোমান লেখক প্লিনি দ্য এল্ডার (২৩-৭৯) তার বিশ্বকোষ “ন্যাচারাল হিস্ট্রি” বইয়ে ইলেকট্রোজেনিক মাছের কিছু থেরাপির কথা লিপিবদ্ধ করেছেন, যার মধ্যে আছে এই মাছ খাওয়া অথবা কিছু অংশ প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করার কথা। যেমন, সন্তান প্রসবের উদ্দীপনা জাগানো বা কামার্ত আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা। যাইহোক, এতদিন অনেক তথ্য জানা থাকা সত্ত্বেও, ৪৬ খ্রিস্টাব্দের আগ পর্যন্ত কেউই এই প্রাণীদের বিদ্যুৎ নিঃসরণের বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে কোন চিকিৎসা-পদ্ধতির কথা প্রস্তাব করেননি।
ব্যথা মোকাবেলায় স্ট্রিপড ক্র্যাম্প
স্ক্রিবোনিয়াস লার্গো নামে একজন ডাক্তার যিনি সম্রাট ক্লডিয়াসের আদালতে কাজ করতেন, তিনি ৪৬ সালে প্রথমবারের মতো দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা উপশমের জন্য টর্পেডো রে এর ক্র্যাম্প ব্যবহার করার প্রস্তাব করেন – যেটা সেসময় চিকিৎসা করা বেশ কঠিন ছিল।
তার শুধুমাত্র একটি কাজ আমাদের সামনে এসেছে, সেটি হল “ডি কম্পোজিশন মেডিকারাম লিবার” নামক একটি ফার্মাকোপিয়া অর্থাৎ যেখানে ওই রোগের চিকিৎসায় বিভিন্ন ওষুধের তালিকা ও ব্যবহারের নির্দেশাবলী আছে। এটাই প্রথম কোন বই যেখানে ইলেক্ট্রোথেরাপি সম্পর্কে উল্লেখ বলা হয়েছে।
এই বইটিতে সম্রাট টাইবেরিয়াসের কবল থেকে মুক্তি পাওয়া আন্তেরোসের গল্প রয়েছে, যিনি পায়ের আঙ্গুল এবং পুরো এক পায়ে তীব্র ব্যথায় ভুগছিলেন। সমুদ্র সৈকতে হাঁটার সময়, তিনি দুর্ঘটনাক্রমে একটি টর্পেডো রে-এর উপর পা রাখেন যা তার পা-কে অসাড় করে দেয় এবং তার ব্যথা দূর করে।
ধারণা করা হয়, স্ক্রিবোনিয়াস এই অভিজ্ঞতা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে পায়ে তীব্র ব্যথার চিকিৎসায় টর্পেডো ব্যবহারের পরামর্শ দেন। তার মতে, আহত অঙ্গটি জীবন্ত টর্পেডো রে-এর সংস্পর্শে আনতে হবে যতক্ষণ না ব্যথা অসাড় হয়ে যায়। একইভাবে তিনি মাথাব্যথা উপশমেরও পরামর্শ দেন, যদিও এক্ষেত্রে রোগীদের মাথায় টর্পেডো স্ট্রাইপ লাগাতে হয়।
এসক্রিবোনিও এ নিয়ে আরও বিস্তারিত কাজ করেন। চিকিৎসক ডিওস্কোরাইডস (৫০-৯০) এসব চিকিৎসা পদ্ধতির প্রতি তার সমর্থন জানান এবং পায়ুপথের রোগ রেকটাল প্রল্যাপসের চিকিৎসার জন্য এসব পদ্ধতি সুপারিশ করেন।
গ্যালেন (১২৯-২০১/২১৬) টর্পেডো রে-এর উপকারিতা যাচাই করার জন্য কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন। প্রথমে তিনি ইতিবাচক ফলাফল পাননি, এমনটা হয়তো জীবিত প্রাণীর পরিবর্তে মৃত প্রাণী ব্যবহারের জন্য হতে পারে। যন্ত্রণাদায়ক ব্যথা উপশম করতে এবং অসুস্থতার চিকিৎসার জন্য নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ প্রয়োগের বুদ্ধিদীপ্ত ধারণা যারা সামনে এনেছেন তাদের ধন্যবাদ দিতেই হয়, কারণ এর ফলে কয়েক শতাব্দী ধরে হাজার হাজার মানুষ তাদের জীবনযাত্রার মান উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হতে দেখেছে। সূত্র: বিবিসি।
এসডব্লিউ/এসএস/১১১৫
আপনার মতামত জানানঃ