গত মে মাসে আমাদের মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। অর্থাৎ, ১০ শতাংশের কাছকাছি। এই মূল্যস্ফীতির কারণে জনজীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। এজন্য প্রস্তাবিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে ধরে রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তবে শুধু বাজেট দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, এর জন্য মুদ্রানীতিরও একটি গঠনমূলক ভূমিকা থাকা প্রয়োজন। এই উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর তার মেয়াদে দ্বিতীয় বারের মতো ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের জন্য ঘোষণা করেন মুদ্রানীতি।
অর্থবছর ২০২৩-২৪–এর প্রথম ছয় মাসের জন্য যে মুদ্রানীতি, তার মূল উদ্দেশ্য একটি সহনীয় মাত্রায় মূল্যস্ফীতি (৪ থেকে ৫ শতাংশ) নিশ্চিত করে অর্থনীতির নিয়োগ সর্বোচ্চ করা। যেহেতু নিয়োগের তথ্য–উপাত্ত বিভ্রান্তিকর, তাই এর বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয় প্রবৃদ্ধি। অর্থনীতিবিদ আর্থার আকুনের সূত্রমতে প্রবৃদ্ধি বাড়লে বেকারত্ব কমে।
সর্বোপরি আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রেখে ব্যবসা-বাণিজ্যের যোগ্য পরিবেশ সৃষ্টির উদ্দেশ্য অর্জন করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহার, মুদ্রা জোগান, বিনিময় হার প্রভৃতি হাতিয়ার ব্যবহার করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখে—ব্যায়াম করে রক্তচাপ ভালো রাখার মতো।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহার কমিয়ে ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ালে বিনিয়োগ বাড়ে, নিয়োগ বাড়ে, বাড়ে উৎপাদন ও প্রবৃদ্ধি। মুদ্রা জোগান বাড়িয়ে এটি করা হয় বলে একে বলে মুদ্রাগত শৈথিল্যকরণ বা ‘মনিটারি লুসেনিং’, যা মূল্যস্ফীতি উসকে দেয়।
তখন মনিটারি টাইটেনিং বা মুদ্রাগত কষায়নের প্রয়োজন পড়ে। সুদহার বৃদ্ধি এই কষায়নের হাতিয়ার। গত এক-দেড় বছরের উচ্চ মূল্যস্ফীতির যুগে বাংলাদেশে এই কষা বা টাইট মুদ্রানীতির প্রয়োজন ছিল, যা পৃথিবীর সব দেশ করলেও বাংলাদেশ করেনি। ঋণের ওপর সুদহার বাড়ায়নি।
কারণ, সেখানে শতকরা ৯ ভাগের ওপর রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে কোভিডের আগে থেকেই সিলিং বা ছাদ দেওয়া ছিল। এই ছাদ ভেঙে দেওয়া অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিপক্ষে এক বিদ্রোহের আলামত। যদিও গভর্নর এটিকে ‘রাজনৈতিক’ সিদ্ধান্ত বলে নিজেকে নিরাপদ করেছেন। অর্থাৎ ব্যাংকিং অর্থনীতিবিদ্যার নীতিতে চলে না। চলে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে। এটা তো ভালো লক্ষণ নয়।
নীতি প্রণয়নে স্বাধীনতা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সর্বদাই যুদ্ধ করে যেতে হয় সরকার বা অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে। ব্যাংকের নেতৃত্ব সব সময়েই চাইবে নিজের হাতিয়ারগুলো নিজের অধিকারে রাখতে। উন্নত বিশ্বে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদহার ব্যক্তি ঋণের সুদহার এবং সরকারের ট্রেজারি বিল বা টি-বিলের সুদহারকে প্রভাবিত করে। এখানে ব্যাপারটি উল্টো হয়ে গেল।
এবারের মুদ্রানীতি সরকারের স্নেহপালিত টি-বিলের সুদহারকে খামোখা ডেকে আনল ব্যাংকিং খাতের ঋণ সুদহার ঠিক করতে। এ কাজটি তো করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদহার।
এ যেন ব্রিটিশ আমলের বিপ্লবীর স্বেচ্ছায় কারাবরণ। এই অদ্ভুত উদ্ভাবন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতাকে আরেক দফা খর্ব করার পদক্ষেপ। টি-বিলের সুদহারের ওপর মাত্র ৩ শতাংশের মার্জিন না দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার প্রধান হাতিয়ার নীতি সুদহারের ওপর ৫-৬ শতাংশ মার্জিন দিয়ে ঋণ সুদহার নির্ণয় করার পদ্ধতি ঠিক করলে তা বিচক্ষণতার পরিচয় বহন করত। টি-বিলের সুদহার সঠিক বাজার পদ্ধতিতে ঠিক হয় না।
এখানে সরকার কখন কতটুকু বেচবে, ব্যাংকগুলোর সে পরিমাণ ক্ষুধা আছে কি না, না থাকলে প্রাইমারি ডিলারদের কাঁধে জোর করে চাপিয়ে দিতে হবে একটি নির্দিষ্ট সুদহারে—এসব বিষয় ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশ ব্যাংক এগুলোর মধ্যে ‘ঘটক’–এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এখানে চাহিদা-জোগানের সুস্থ খেলার মধ্য দিয়ে যোগ্য সুদহার প্রতিফলিত হয় না।
প্রকৃত সত্য উন্মোচন
২০০৩ সাল থেকে মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের ওপর ভাসমান করা হলেও ২০১০ সালের পর থেকে একে “ম্যানেজ” করার তৎপরতা বেড়ে যায় সরকারের। ১৯৫৬ সালের মানসিকতাসম্পন্ন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটিগণ কে কার আগে টাকার মানকে ডলারের বিপরীতে কৃত্রিমভাবে চাঙা করে রাখবেন, সে প্রতিযোগিতা শুরু হয় ২০১০ সালের দশকের শেষ ভাগ থেকে।
কয়েকজন উপদেষ্টাও ছিলেন ওই মানসিকতার, যাদের বাজার অর্থনীতির প্রতি ছিল তীব্র অনীহা। কারণ, এতে মাতব্বরি কমে যায়। এটি রাজনৈতিক তুষ্টিসাধনেও ব্যবহৃত হতো।
টাকার এই কৃত্রিম উচ্চমূল্যের কারণে ওই সময় থেকে প্রকৃত বিনিময় হারের সূচক তরতর করে ১০০–এর ওপরে উঠে যায়, যা তোয়াক্কা করা হয়নি। নিয়ম হলো ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমিয়ে হলেও প্রকৃত বিনিময় হারের সূচককে ১০০–এর কাছাকাছি রাখা। এত রপ্তানি বাড়ে, বাড়ে রেমিট্যান্স, লাগাম টানা হয় আমদানিতে। সেটি ঠিক দীর্ঘ আট বছর ধরে পরোয়া করা হয়নি বলেই আজ তার খেসারত দিতে হচ্ছে।
রেমিট্যান্স ও রপ্তানি সেভাবে বাড়েনি, প্রচুর বেড়েছে আমদানি, যা চলতি হিসাবে ধস নামিয়েছে দিনে দিনে। রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেন আক্রমণকে এই ধসের জন্য দায়ী করে হলেও এটি বর্তমান বিপর্যয়ের পেছনে ১০ শতাংশের ১ শতাংশও দায়ী নয়। দায়ী টাকার মানের অবাজারীয় নিয়ন্ত্রণ, যা দিনে দিনে বিদেশি মুদ্রার মজুতকে অ্যানিমিয়ায় আক্রান্ত করেছে।
এ অবস্থার উত্তরণকল্পে অর্থনীতিবিদেরা মুদ্রাকে বাজার দামে ভাসমান করার সুপারিশ করলেও রাজনীতিকেরা কেউ কেউ তাদের ‘অ-দেশপ্রেমিক’ বানিয়ে ফেলেছেন। অবশেষে গভর্নর সম্ভবত আইএমএফের চাপে এবার বাজারের গাঙে বিনিময় হারের নৌকা ভাসিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এই কাজ গত মুদ্রানীতিতে করলে আজ রেমিট্যান্সের বিপর্যয় অনেকটা ঠেকানো যেত।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্তারা আমলাতান্ত্রিক আটকা-আটকি পছন্দ করেন। হয়তো সেখান থেকেও ‘সবুজসংকেত’ ছিল না। তবু গভর্নরের এই বিলম্বিত ‘বিদ্রোহ’ ধন্যবাদার্হ। এ বিনিময় হার পরোক্ষভাবে যদি আবারও ‘বাফেদা’ বা ‘এবিবি’র পোষ্যপুত্র হয়ে যায়, তাহলে এ–জাতীয় ভাসানোর কাজ হবে ডোবানোর নামান্তর।
ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহের বৃদ্ধি যেখানে ধরা হলো ১১ শতাংশ, সেখানে সরকারি ঋণ বৃদ্ধির হার হয়ে গেল ৪৩ শতাংশ। এই তীব্র অসংগতি ব্যক্তি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করবে ও মূল্যস্ফীতিতে ঘৃতাহুতি দেবে। কারণ, সরকার ওই হাতে পাওয়া টাকা বাজারে ছাড়বে দেদার।
এ অবস্থায় ‘মুদ্রা জোগানের হাতিয়ার বাদ দিয়ে সুদহারের হাতিয়ারের দিকে বিবির পলিসি শিফট’ মুখ থুবড়ে পড়বে সরকারের মাত্রাতিরিক্ত ঋণের কারণে, যা অর্থ মন্ত্রণালয়ের রাজস্ব অক্ষমতার খেসারত, যা আবার জন্ম নিয়েছে ধনিক শ্রেণিতে সঠিক কর চাপিয়ে নাখোশ না করার রাজনৈতিক আদিখ্যেতা থেকে।
এখন থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক নাকি আইএমএফের ম্যানুয়াল মেনে মুদ্রা মজুতের নেট বা সঠিক হিসাব করবে। সঠিক হিসাব না থাকার কারণেই কি অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বললেন যে এখন সাড়ে চার মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো মজুত আছে? হিসাব তো মিলছে না!
কিন্তু গভর্নর সম্ভবত এও বলেছেন যে এই নেট সঠিক হিসাব তিনি আমাদের জানাবেন না। আমাদের জানাবেন ‘ইডিএফ’ যোগ করে একটু ফোলানো ফিগার। আসলটা জানালে দোষ কোথায়? এটা কি রবীন্দ্রনাথের গল্পের ‘হৈমন্তী’র আসল বয়স, যা শ্বশুরবাড়ির মানুষকে জানানো যাবে না?
এসডব্লিউ/এসএস/১৬৩০
আপনার মতামত জানানঃ