রাজধানীর আবাসন সমস্যা সমাধানে কেরানীগঞ্জে ৪৮০ বিঘা জমিতে ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্প নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিল রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য ছিল নিম্নমধ্যবিত্তের জন্য সুলভে ফ্ল্যাট নির্মাণ।
এজন্য বিএনজি গ্লোবাল হোল্ডিংস অ্যান্ড কনসোর্টিয়াম নামে মালয়েশীয় একটি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিও হয়েছিল রাজউকের। যদিও চুক্তিতে নির্ধারিত মূল্য ও বর্তমানে মালয়েশীয় কোম্পানিটির নতুন করে দাবীকৃত অর্থের হিসাব বিশ্লেষণে দেখা যায়, নিম্নমধ্যবিত্তের জন্য বানানো এ আবাসন প্রকল্পে সবচেয়ে ছোট আকারের ফ্ল্যাটটিরও দাম গিয়ে ঠেকবে দেড় কোটি টাকার কাছাকাছি।
সংশ্লিষ্ট নথির তথ্য অনুযায়ী, ৯ হাজার ৯৭৯ কোটি ২০ লাখ টাকার এ প্রকল্পে মোট ৮৫টি ভবন নির্মাণ করার কথা রয়েছে। তিন শ্রেণীতে ফ্ল্যাট হবে ১৩ হাজার ৭২০টি। চুক্তি অনুযায়ী, প্রতি বর্গফুটের মূল্য নির্ধারণ রয়েছে ৫ হাজার ৬০০ টাকা। এ হিসাবে সর্বনিম্ন ১ হাজার ৪০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাটের মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৮০ লাখ টাকা, রেজিস্ট্রি খরচসহ যার মূল্য দাঁড়ায় কোটি টাকা।
২০১৭ সালে সই হওয়া চুক্তির পর ছয় বছর পেরোলেও বিএনজি গ্লোবাল নামের বিদেশী ওই প্রতিষ্ঠানটি এখনো কাজই শুরু করেনি। রাজউক সূত্রে জানা গেছে, নতুন করে কাজ শুরুর জন্য প্রতিষ্ঠানটি সম্প্রতি আরো সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা দাবি করেছে। যুক্তি হিসেবে বর্তমান বাজারে নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধিকে সামনে আনছে কোম্পানিটি।
বিষয়টি সংশ্লিষ্টরা যাচাই-বাছাই করছেন। তবে দাবি করা সেই অর্থ বিএনজিকে দেয়া হলে নিম্নমধ্যবিত্তের জন্য নির্মিতব্য ফ্ল্যাটের সর্বনিম্ন দাম গিয়ে ঠেকবে দেড় কোটি টাকায়।
সরকারি প্রকল্পে আবাসনের মূল্য নিম্নমধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন।
তিনি বলেন, একজন নিম্নমধ্যবিত্ত সর্বোচ্চ ১০-১৫ লাখ টাকায় এবং মধ্যবিত্ত ৫০-৬০ লাখ টাকায় ফ্ল্যাট কিনতে পারে, তাও কিস্তিতে। কিন্তু রাজউকের ফ্ল্যাটের মূল্য ১ কোটি, দেড় কোটি টাকা। কোনোভাবেই এটা কাম্য নয়। রাজউকের উচিত ভর্তুকি দিয়ে হলেও নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের কাছে কম মূল্যে ফ্ল্যাট বিক্রি করা। সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবেই রাজউকের উচিত জনগণকে সেবা দেয়া।
মৌলিক অধিকার নিয়ে ব্যবসা করা সরকারের কাজ নয়। তাই ঝিলমিল ও উত্তরায় নিম্নমধ্যবিত্তদের নামে এক-দেড় কোটি টাকার ফ্ল্যাট কোনোভাবেই মেনে নেয়ার মতো নয়। তাই সে ফ্ল্যাট উচ্চবিত্তরা কিনছে ও কিনবে।
ঝিলমিলে কম দামে ফ্ল্যাট নির্মাণে আবাসন খাতের ব্যবসায়ীরা বিরোধিতা করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রিহ্যাব সভাপতি বলেন, ‘অবশ্যই আমরা চাই না ঝিলমিল বা উত্তরায় কম দামে ফ্ল্যাট বিক্রি হোক। তাহলে তো আমার ব্যবসা কমে যাবে। আমরা ব্যবসায়ীরা চাই না বলেই কি সরকার বসে থাকবে? জনগণের আবাসন সমস্যার সমাধান করবে না?
সরকারই তো এখন প্রাইভেট কোম্পানির দামে ফ্ল্যাট বিক্রি করছে। একটা ফ্ল্যাট সরকার ১ কোটি টাকা দিয়ে বানাতে পারে। নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের কাছে সেটা বিক্রির সময় তো ভর্তুকিও দিতে হবে। আমরা ব্যবসায়ীরা স্বাভাবিকভাবেই এর পক্ষে থাকব না। তাই বলে সরকার নিজেই নিম্নমধ্যবিত্তদের নাম দিয়ে দেড় কোটি টাকায় ফ্ল্যাট বিক্রি করবে?
কেরানীগঞ্জে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে গড়ে ওঠা ঝিলমিল আবাসিক এলাকায় ফ্ল্যাট নির্মাণে মালয়েশিয়ান প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী ৪৮০ বিঘা বা ১৬০ একর জমিতে ৮৫টি ভবন হওয়ার কথা। এর মধ্যে ৬০টি সেমি বেজমেন্টসহ ২০ তলা ও বেজমেন্টসহ ২৫ তলার ভবন নির্মাণ করা হবে ২৫টি। এসব ভবনে মোট তিন শ্রেণীতে ১৩ হাজার ৭২০টি ফ্ল্যাট হবে।
১ হাজার ৪০০ বর্গফুট আয়তনের ‘এ’ শ্রেণীর ফ্ল্যাট হবে ৯ হাজার ১২০টি, ‘বি’ শ্রেণীর ১ হাজার ৭৫০ বর্গফুটের ২ হাজার ৫৭৬টি এবং ‘সি’ শ্রেণীর ২ হাজার ৪০০ বর্গফুটের ২ হাজার ২৪টি ফ্ল্যাট হওয়ার কথা।
ঝিলমিলে নির্মিতব্য এসব ফ্ল্যাটের প্রতি বর্গফুটের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ হাজার ৬০০ টাকা। এ হিসাবে সবচেয়ে ছোট যে ফ্ল্যাটটি, ১৮ শতাংশ রেজিস্ট্রেশন খরচসহ সেটিরও মূল্য দাঁড়াবে ১ কোটি টাকার বেশি। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৯৭৯ কোটি ২০ লাখ টাকা। রাজউক বিএনজি গ্লোবালের আরো সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা পরিশোধের দাবি মেনে নিলে ফ্ল্যাটের মূল্য দেড় কোটি টাকা ছাড়াবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, সর্বশেষ ড্যাপে রাজউক নিম্নমধ্যবিত্তদের জন্য আবাসনের একটা পরিমাপ নির্ধারণ করে দিয়েছে ৭২০ থেকে ৮০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট। এ আকারের ফ্ল্যাট বানানো হলে উচ্চতার ক্ষেত্রেও প্রণোদনা দেয়ার কথা বলা আছে ড্যাপে। সে রাজউকই আবার ঝিলমিল ও উত্তরায় নিম্নমধ্যবিত্তদের জন্য দেড় হাজার, আড়াই হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট নির্মাণ করে—এটা তাদের স্ববিরোধী নীতি ও সুস্পষ্ট প্রতারণা ছাড়া আর কী বলা যায়?
ঝিলমিলে একটি ফ্ল্যাটের দাম ১ কোটি টাকার বেশি হবে। উত্তরায় দেড় কোটি টাকায় নিম্নমধ্যবিত্তদের ফ্ল্যাট বিক্রি হচ্ছে, এটা তো তাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নেই। রাজউক যদি (ঝিলমিলে) আরো সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা বাজেট বাড়ানোর কথাটি বিবেচনায় নিতে পারে তাহলে অবশ্যই ফ্ল্যাট ডিজাইনের বিষয়টিও সংশোধন করতে পারে।
রাজউকের কাজে জবাবদিহিতা না থাকার কারণেই বারবার এমন হচ্ছে বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের ভুল রাজউক ইচ্ছে করেই করে। শুরুতে তারা ফ্ল্যাটের সাইজ ৮০০-১০০০ বর্গফুট রাখে।
অনুমোদন হয়ে যাওয়ার পর সেটার সাইজ দ্বিগুণ-তিন গুণ করে ফেলে। ঝিলমিলের বেলায়ও তাই হয়েছে। এটা কোনোভাবেই উচিত নয়। আমাদের দাবি থাকবে অতিদ্রুত ঝিলমিল আবাসন প্রকল্পের রি-ডিজাইন করে কাজ শুরু করা হোক।
এদিকে ফ্ল্যাটের দাম প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঝিলমিল আবাসন প্রকল্পের পরিচালক ওয়াহিদ সাদিক কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। এ বিষয়ে তিনি রাজউক চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। তবে একাধিকবার ফোন করে ও ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়েও রাজউক চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমান মিঞার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন বলেন, ‘বর্তমান বাজারে সবকিছুর দাম বেশি। তাই কোম্পানির পক্ষ থেকে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। বিষয়টি যাচাই-বাছাই শেষে সিদ্ধান্ত হবে কত টাকা বাড়ানো যায়।
এসডব্লিউএসএস১৯১৫
আপনার মতামত জানানঃ