যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে লঙ্ঘন করে বা উপেক্ষা করে বলে যেসব দেশকে মনে করে তাদের বিরুদ্ধেই নিষেধাজ্ঞা বা স্যাংশন আরোপ করে তারা। এ ছাড়া বৈশ্বিক ক্ষেত্রে এক দেশ আরেক দেশের বিরুদ্ধে আগ্রাসন চালালে তার বিরুদ্ধেও একই পদক্ষেপ নেয় যুক্তরাষ্ট্র।
সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণেও নিষেধাজ্ঞার আশ্রয় নিয়ে থাকে দেশটি। তাদের পক্ষে যায় না এমন নীতি গ্রহণের কারণে অন্য দেশের ওপর এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এর উদ্দেশ্য হলো সংশ্লিষ্ট দেশটিকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা। আবার যেখানে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে মনে করে, সেখানে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র সোচ্চার হয়েছে। তারা যেখানেই দেখছে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, তাদেরকে সতর্কতা দিচ্ছে। তাতে কাজ না হলে আরোপ করছে নিষেধাজ্ঞা।
১৯৯০-এর দশক থেকে বিশ্বে যত নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে তার মধ্যে তিন ভাগের দুই ভাগই দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কোনো কোনো দেশের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্মিলিতভাবে। ১৯৯৮ সাল থেকে কমপক্ষে ২০টি দেশের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র আরোপ করেছে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। ১৮০৭ সালের এমবার্গো অ্যাক্ট ব্যর্থ হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকার বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত বিদেশি কোনো দেশের বিরুদ্ধে এমবার্গো ও ইকোনমিক বা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপে খুব বেশি আগ্রহ দেখায়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক নীতি পুরোটাই অর্থনৈতিক নীতি বিষয়ক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এই আগ্রহ আবার ফিরে আসে। লীগ অব নেশন-এর জন্য শান্তি প্রতিষ্ঠায় নিষেধাজ্ঞা নীতি আবার অনুমোদন করেন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন। তবে এই লীগ অব নেশনে নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হন তিনি। ইতালির বিরুদ্ধে ১৯৩৫ সালে এই লীগ নিষেধাজ্ঞা দেয়। তাতে যোগ দেয়নি যুক্তরাষ্ট্র।
শীতল যুদ্ধের সময়ে কিউবা, চীন এবং উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে এককভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন ও শীতল যুদ্ধের শেষে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ক্রমশ বহুজাতিক হতে শুরু করে। ১৯৯০-এর দশকে ইরাক, জিম্বাবুয়ে, যুগোস্লাভিয়ার মতো কিছু দেশের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ অথবা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তারা।
করোনা মহামারির সময়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলে এবং মার্কিন কংগ্রেসের কিছু সদস্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আহ্বান জানায়, যেসব দেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে তা সাময়িক স্থগিত করতে। এমন কংগ্রেসম্যানের মধ্যে আছেন বার্নি স্যান্ডার্স, আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্টেজ এবং ইলহান ওমর। অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় ঘন ঘন নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করে যুক্তরাষ্ট্র।
এসব নিষেধাজ্ঞার মধ্যে আছে অস্ত্র রপ্তানি সম্পর্কিত নিষেধাজ্ঞা। প্রযুক্তি রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক নিষেধাজ্ঞা। অর্থনৈতিক সহায়তায় বিধিনিষেধ বিষয়ক নিষেধাজ্ঞা। আর্থিক নিষেধাজ্ঞা যেমন, বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ পেতে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা। কূটনৈতিক দায়মুক্তি, সন্ত্রাসের শিকার পরিবারগুলো যুক্তরাষ্ট্রের কোর্টে ক্ষতিপূরণ চেয়ে আবেদন করতে পারবে। তালিকাভুক্ত দেশগুলোর কোম্পানি এবং ব্যক্তিবিশেষকে ট্যাক্স ক্রেডিট প্রত্যাখ্যান করা। ওইসব দেশ থেকে আমদানির ক্ষেত্রে পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা সাময়িক স্থগিত। তালিকাভুক্ত দেশগুলোর সরকারের সঙ্গে আর্থিক লেনদেন করতে পারবেন না কোনো মার্কিন নাগরিক। তালিকাভুক্ত দেশগুলোর কোনো কোম্পানির কাছ থেকে এক লাখ ডলারের বেশি প্রতিরক্ষা চুক্তিতে বিধিনিষেধ।
আর সর্বশেষ হলো যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের ভিসা প্রত্যাখ্যান। অর্থাৎ তালিকাভুক্ত দেশগুলোর কোনো নাগরিক বা নির্দিষ্ট ব্যক্তিরা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে পারবেন না।
সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন বার বার জোর দিয়ে বলেছে, তারা গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারকে অগ্রাধিকারের কেন্দ্রে রেখেছে। এ জন্য যেখানেই গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে বা হয়েছে বলে তারা মনে করছে, তাদের হাতে প্রমাণ আছে বলে দাবি করছে, সেখানেই তারা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে।
বার বার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে মুখপাত্ররা এ কথাই জানান দিয়েছেন যে, বাইডেন প্রশাসন বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়ায়। সেখানে বিবিসি’র এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফল জালিয়াতি হয়েছে। ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। সহিংসতা হয়েছে। ভোটের ফল জালিয়াতি করা হয়েছে। এমন প্রমাণ পাওয়া গেছে। ওই নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন বোলা টিনুবু।
গতকাল সোমবার ২৯শে মে তার শপথ নিয়ে ক্ষমতা গ্রহণের কথা। কিন্তু বিরোধী দল তার এই ফলকে চ্যালেঞ্জ করেছে। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হওয়ার পর এই ফল নিয়ে সেখানে ব্যাপক সহিংসতা দেখা দিয়েছে। হামলা পাল্টা হামলা হয়েছে। দেশটিতে ব্যাটলগ্রাউন্ড বা লড়াইয়ের মূল কেন্দ্র হিসেবে ধরা হয় রিভার্স স্টেটকে। সেখানে ভোটের ফল অস্বাভাবিক পাওয়া যায়। আকস্মিকভাবে টিনুবুর ভোট বেড়ে এক লাখ ছয় হাজার ছাড়িয়ে যায়। এমন ঘোষণা দেয়া হয় সরকারি পর্যায় থেকে। এর মধ্যদিয়ে প্রকৃত ভোটের দ্বিগুণেরও বেশি ভোট পেয়ে যান তিনি।
অন্যদিকে বিরোধী প্রার্থী পিটার ওবি’সের ভোট দাঁড়ায় মাত্র ৫০ হাজার। এক্ষেত্রে ব্যাপক কারচুপি পাওয়া যায়। এ ছাড়া একজন নির্বাচন কর্মকর্তার পরিচয় সম্পর্কে প্রশ্ন রয়েছে। তিনি বেশ কিছু ফল ঘোষণা করেছেন। কিন্তু এর কোনো ব্যাখ্যা নেই।
এর প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন সেখানে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন ১৫ই মে। তাতে বলা হয়, নাইজেরিয়া এবং বাকি বিশ্বে গণতন্ত্রকে সমর্থন এবং অগ্রযাত্রায় সমর্থন দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যুক্তরাষ্ট্র। ২০২৩ সালের নির্বাচনকে ঘিরে নাইজেরিয়ায় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করেছেন যেসব সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি তাদের বিরুদ্ধে ভিসায় বিধিনিষেধ ঘোষণা করছি আমি। এই নিষেধাজ্ঞা নাইজেরিয়ার জনগণ বা পুরো সরকারের বিরুদ্ধে নয়। এটা সুনির্দিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে।
অ্যান্টনি ব্লিনকেন ঘোষণায় বলেন, ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্টের ২০১২ (এ) (৩) (সি) ধারার অধীনে যেসব ব্যক্তি গণতন্ত্রকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে বিশ্বাস করা হয়, তাদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ভিসায় নিষেধাজ্ঞা দেয়া হবে। নাইজেরিয়ার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে তারা হুমকি, শারীরিক নির্যাতন, ভোটের ফল জালিয়াতি এবং অন্যান্য কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাধাগ্রস্ত করার মাধ্যমে ভোটারদেরকে হুমকি দেয়ার সঙ্গে জড়িত। নাইজেরিয়ায় গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা এবং আইনের শাসনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের অব্যাহত প্রতিশ্রুতির প্রতিফলনের অধীনে নেয়া হয়েছে ভিসায় এই নিষেধাজ্ঞা।
তবে সুনির্দিষ্ট ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ করেননি তিনি। ফলে কার কার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলো তা সুস্পষ্টভাবে জানা যায়নি। এরই মধ্যে বাংলাদেশকে একই রকম সতর্কতা দিয়েছেন তিনি। সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, যারা নাইজেরিয়ার মতো ওই ঘটনা ঘটাবেন বলে তাদের বিশ্বাস হবে, তাদের বিরুদ্ধেই যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে ভিসায় নিষেধাজ্ঞা দেবেন। এক্ষেত্রে সরকারি বা বিরোধী দল- কোনো দলই ছাড় পাবে না। একই সঙ্গে এর ভেতর আছে বিচারবিভাগ, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা, নিরাপত্তা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান, সরকারি পর্যায়ের কর্মকর্তা- মূল কথা হলো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে ব্যাপক ও বিস্তৃত পরিসরে।
এক্ষেত্রে আমরা যে যতই গলা ফাটাই, একপক্ষ অন্য পক্ষকে ‘মুখ শুকিয়ে’ ফেলছি, সবারই ভাবার অবকাশ আছে। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, যুক্তরাষ্ট্রের এমন বার্তার পর সবার টনক নড়েছে। মুখে যত যা-ই বলি, ভেতরে ভেতরে কম্পন শুরু হয়েছে। যার দুর্বলতা যত বেশি, তার কম্পন তত বেশি। সে কম্পন খালি চোখে দেখা যায় না। আমরা আশা করতে চাই, সুন্দর একটি বাংলাদেশের স্বার্থে সামনের নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ। আমরা চাই না, সুন্দর এই বাংলাদেশে আমাদের কারও বিরুদ্ধে কোনো দেশ নিষেধাজ্ঞা দিক। আমরা আলাদাভাবে চিহ্নিত হয়ে থাকি বিশ্বের কাছে।
এসডব্লিউএসএস/১৪২৫
আপনার মতামত জানানঃ