দক্ষিণ ভারতের রাজ্য কর্নাটকে সদ্য ক্ষমতায় আসা কংগ্রেস সরকার জানিয়েছে তারা বিগত বিজেপি সরকারের আনা বেশ কিছু বিতর্কিত বিল প্রত্যাহার করতে চায়, যার মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হিজাব নিষিদ্ধ করার মতো পদক্ষেপও আছে।
এছাড়া ওই রাজ্যে ধর্মান্তরকরণ বিরোধী বিল, গোহত্যা বিরোধী বিল-সহ যে সব আইন নিয়ে সাম্প্রতিক অতীতে তীব্র রাজনৈতিক বিতর্ক হয়েছে, সেগুলোও তুলে নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, কর্নাটক বিধানসভা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন বিজেপিকে বড় ব্যবধানে হারিয়েছে কংগ্রেস। কংগ্রেস জিতেছে ১৩৬টি আসনে। আর বিজেপি জয়ী হয়েছে ৬৫টিতে। আর এতেই বদলে গেছে প্রেক্ষাপট।
কর্নাটকে কংগ্রেস মন্ত্রিসভার সিনিয়র সদস্য ও দলের জাতীয় সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গের ছেলে প্রিয়াঙ্ক খাড়গে এক টুইটে জানিয়েছেন, “পূর্বতন বিজেপি সরকারের আনা যে সব বিল রাজ্যের ভাবমূর্তিতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে, লগ্নি নিরুৎসাহিত করছে, কর্মসংস্থান তৈরি করছে না এবং যেগুলো অসাংবিধানিক, ব্যক্তি অধিকারের লঙ্ঘন; সেগুলো পুনর্বিবেচনার জন্য সরকার দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ।”
তিনি আরও জানান, কংগ্রেস এমন একটি কর্নাটক গড়ে তুলতে চায় যেখানে ‘অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য’ থাকবে।
যদিও এই টুইটে নাম করে নির্দিষ্ট কোনও বিলের কথা উল্লেখ করা হয়নি, পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মি খাড়গে স্পষ্ট করে দিয়েছেন হিজাব নিষেধাজ্ঞা বিল বা ধর্মান্তরকরণ বিরোধী বিলের মতো সব বিতর্কিত আইনই তাদের রাডারে আছে।
এর ঠিক আগেই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ভারতীয় চ্যাপ্টারের পক্ষ থেকে দাবি জানানো হয়েছিল, কর্নাটকে নতুন সরকারের ‘অগ্রাধিকার’ হওয়া উচিত রাজ্যের তিনটি বিতর্কিত বিল প্রত্যাহার করা।
অ্যামনেস্টি ইন্ডিয়ার পক্ষ থেকে একটি পোস্টে বলা হয়, “স্কুল-কলেজে মুসলিম মেয়েদের হিজাব পরে যাওয়ার ওপর যে নিষেধাজ্ঞা আছে তা অবিলম্বে তুলে নেওয়া হোক।”
এই নিষেধাজ্ঞার ফলে মুসলিম ছাত্রীরা একদিকে তাদের মতপ্রকাশ ও ধর্মাচরণের অধিকার ও অন্য দিকে শিক্ষার অধিকার – এই দুটোর মধ্যে একটা বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে বলেও অ্যামনেস্টির পক্ষ থেকে মন্তব্য করা হয়।
এর পরই কংগ্রেসের পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়, রাজ্যের ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, এমন সব বিলই তারা পুনর্বিবেচনা করবে।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
হিজাব-বিরোধী বিল সহ যে তিনটি আইন নিয়ে কর্নাটকে এখন আবার চর্চা হচ্ছে, সেগুলোকে ওই রাজ্যে বিজেপির রাজনৈতিক এজেন্ডার অংশ হিসেবেই এতদিন দেখা হয়ে এসেছে।
পর্যবেক্ষকরা অনেকেই মনে করেন, কর্নাটককে বিজেপি তাদের ‘হিন্দুত্ব এক্সপেরিমেন্টে’র নতুন পরীক্ষাগার হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিল এবং সেই প্রচেষ্টায় বড় হাতিয়ার ছিল এই তিনটি বিল।
সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনের ফলাফলে অবশ্য দেখা গেছে কর্নাটকে বিজেপির সেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা রাজনৈতিকভাবে সফল হয়নি। কংগ্রেসের কাছে বিপুল ভোটে পরাজিত হয়ে তারা রাজ্যের ক্ষমতা হারিয়েছে।
এখন কংগ্রেস সরকার যখন ওই বিলগুলো প্রত্যাহারের ইঙ্গিত দিচ্ছে, বিজেপি কিন্তু এ ব্যাপারে সাবধানী অবস্থান নিতে চাইছে।
দলের সিনিয়র এমপি লহর সিং সারোয়া আবার প্রশ্ন তুলেছেন, প্রিয়াঙ্ক খাড়গে কোন এক্তিয়ারে এই বিলগুলো পুনর্বিবেচনার কথা বলছেন?
“তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বা উপমুখ্যমন্ত্রী নন, এমন কী দলীয় সভাপতিও নন!”, টুইট করেছেন মি সারোয়া।
হায়দ্রাবাদের এমপি আসাদউদ্দিন ওয়াইসি আবার কর্নাটক সরকারের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, “আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছি হিজাব নিষিদ্ধ করার পদক্ষেপ অসাংবিধানিক, এবং সুপ্রিম কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে অন্তত দুজন বিচারপতিও সে কথা মেনে নিয়েছিলেন।”
কর্নাটক সরকার যত তাড়াতাড়ি এই বিলগুলো প্রত্যাহার করে, ততই মঙ্গল বলে মন্তব্য করেছেন ওয়াইসি।
প্রসঙ্গত, গত বছরের জানুয়ারিতে দক্ষিণ কর্নাটকের উদুপিতে একটি কলেজের মুসলিম ছাত্রীরা হিজাব পরে ক্লাসে আসার পর কলেজ কর্তৃপক্ষ তাতে বাধা দিলে গোটা রাজ্য জুড়ে হিজাবকে কেন্দ্র করে পাল্টাপাল্টি বিক্ষোভ ও আন্দোলন শুরু হয়ে যায়।
এরপর কর্নাটকের তৎকালীন বাসবরাজ বোম্মাই সরকার স্কুল-কলেজে হিজাব পরা নিষিদ্ধ করত আইন আনে, যা নিয়ে সারা দেশেই তীব্র বিতর্ক হয়েছিল।
এ ছাড়া গত বছরের সেপ্টেম্বরে ওই রাজ্যের বিজেপি সরকার ‘ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার রক্ষা বিল ২০২১’ নামেও একটি আইন প্রণয়ন করে, যেটি ‘ধর্মান্তরণ বিরোধী বিল’ নামেই বেশি পরিচিত।
সরকার তখন যুক্তি দিয়েছিল, জোর করে, লোভ দেখিয়ে বা জালিয়াতি করে যাতে কাউকে ধর্মান্তরিত না-করা যায় সে জন্যই ওই বিল আনা হয়েছে এবং দোষীদের দশ বছর পর্যন্ত জেল ও এক লক্ষ রুপি জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।
তবে কংগ্রেস এখন রাজ্যের ক্ষমতায় আসার পর এই বিলগুলোর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বলেই মনে হচ্ছে।
এসডব্লিউএসএস১১২০
আপনার মতামত জানানঃ