অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের বাজেটে সুদ খাতে ৮০ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছিল সরকার। কিন্তু ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট মাসেই এ খাতে ৫৬ হাজার ২২২ কোটি টাকা ব্যয় হয়ে গেছে। সে হিসাবে আট মাসে সুদ খাতে বরাদ্দের ৭০ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছে। অর্থবছরের বাকি সময়ে এ খাতে সরকারের ব্যয় আরো বাড়বে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী দু-তিন বছরের মধ্যেই বিদেশী ঋণ পরিশোধের চাপ অনেক বেড়ে যাবে। বিশেষ করে চীন, রাশিয়া ও ভারত থেকে নেয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে। এ অবস্থায় ডলারের সংস্থান না হলে যথাসময়ে ঋণ পরিশোধ করা নিয়ে সরকারকে চাপে পড়তে হবে। কারণ এরই মধ্যে বিদেশী ঋণ পরিশোধ নিয়ে সরকারের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে।
জিডিপি বেড়েছে, বাড়েনি রাজস্ব
জিডিপির অনুপাতে গত এক দশকে রাজস্ব আয় বাড়েনি। যদিও এ সময় জিডিপির অনুপাতে সরকারের ঋণে ব্যাপক উল্লম্ফন ঘটেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৪ সালে দেশে সরকারের ঋণ-জিডিপির অনুপাত ছিল ২৮ দশমিক ৭ শতাংশ। এক দশক পর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশে। আবার এ সময় কমেছে রাজস্ব আয়-জিডিপির অনুপাত।
২০১৪ সালে সরকারের রাজস্ব (কর ও অনুদান)-জিডিপি অনুপাত ছিল ৯ দশমিক ১ শতাংশ। এক দশক পর তা নেমেছে ৮ দশমিক ৭ শতাংশে। আর শুধু কর-জিডিপির অনুপাত নেমেছে ৭ দশমিক ৮ শতাংশে।
ঋণ পরিশোধের প্রধান উৎস রাজস্ব। জিডিপির অনুপাতে সরকারের ঋণ ও রাজস্ব আয়ের এ অসামঞ্জস্যতা দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি তৈরি করছে বলে আশঙ্কা অর্থনীতিবিদদের। তাদের বক্তব্য হলো লক্ষ্যমাফিক রাজস্ব আহরণে ব্যর্থতায় সরকারের ঘাটতি বাজেটের আকার প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
এ ঘাটতি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে সরকারের ঋণের বোঝাও। এ মুহূর্তে বাজেটের অন্যতম বড় ব্যয়ের খাত হয়ে উঠেছে ঋণের সুদ পরিশোধ। বর্তমান পরিস্থিতি চলতে থাকলে সরকারের ঋণের বোঝা বাড়তেই থাকবে।
পরিসংখ্যান কী বলছে?
বৈশ্বিক অর্থনীতিসংক্রান্ত তথ্যসেবা প্রতিষ্ঠান সিইআইসি ডাটার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬৭ বিলিয়ন ডলার। প্রতি ডলারের বিনিময় হার ১০৭ টাকা করে ধরলে বাংলাদেশী মুদ্রায় এ ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৭ লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকায়। বিপুল এ ঋণের মধ্যে ৭ লাখ ১৬ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নিয়েছে সরকার। আর বিদেশী উৎস থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭১ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার।
ডলারসহ অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে আইএমএফ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ নিচ্ছে সরকার। আগামী তিন বছরে সাত কিস্তিতে এ ঋণ পাবে বাংলাদেশ। এরই মধ্যে ঋণের প্রথম কিস্তি বাবদ ৪৭ কোটি ডলার ছাড় দিয়েছে আইএমএফ। তবে ঋণের পুরো অর্থ ছাড় পেতে প্রতি বছরই রাজস্ব আয় বাড়ানোর শর্তারোপ করেছে দাতা সংস্থাটি।
এর মধ্যে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পেতে হলে চলতি অর্থবছরের মধ্যেই কর-জিডিপি অনুপাত ৮ দশমিক ৩ শতাংশে উন্নীত করার শর্ত রয়েছে। আর ২০২৫-২৬ অর্থবছরে কর-জিডিপির অনুপাতের লক্ষ্য বেঁধে দেয়া হয়েছে ৯ দশমিক ৫ শতাংশে। আইএমএফের শর্ত পূরণ করতে হলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) বর্তমান আয়ের তুলনায় আগামী তিন বছরে ২ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকার বাড়তি রাজস্ব আদায় করতে হবে।
সংশ্লিষ্টদের মতামত
বিদ্যমান বাস্তবতায় বাড়তি রাজস্ব আয়ের এ লক্ষ্যপূরণ প্রায় অসম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের ভাষ্যমতে, কর-ডিজিপি অনুপাত ১২-১৩ শতাংশে উন্নীত করা গেলে সরকারের বিদ্যমান ঋণ পরিশোধ সম্ভব। সেক্ষেত্রেও বিদেশী ঋণ পরিশোধের জন্য রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধির ওপর নির্ভর করতে হবে। কিন্তু সরকার এরই মধ্যে মেগা প্রকল্পে আরো বেশি বিদেশী ঋণ নেয়ার জন্য উদ্যোগী হয়েছে। এ অবস্থায় রাজস্ব আয় বাড়িয়েও যথাসময়ে বিদেশী ঋণ পরিশোধ দুঃসাধ্য হয়ে উঠতে পারে।
বাছবিচার না করে নেয়া ঋণ পরিশোধ করা সরকারের জন্য খুবই কষ্টকর হবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বিবেচনায় নিলে সরকারের ঋণ-জিডিপি অনুপাত এখনো সীমার মধ্যেই আছে। কিন্তু আমাদের ঋণের বিষয়টি দেখাতে হবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে। দেশের কর-জিডিপি অনুপাত এখনো ৮ শতাংশে সীমাবদ্ধ।
বিদ্যমান বাস্তবতায় এটি বাড়ানোও বেশ কঠিন। কর-জিডিপির অনুপাত ১২-১৩ শতাংশ হলে তবেই সরকারের বর্তমান ঋণ পরিশোধ সম্ভব। যদিও অদূর ভবিষ্যতে এ ধরনের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।’
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সরকার বিদেশী ঋণে একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক নয় এমন সব প্রকল্পও নেয়া হচ্ছে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে সীমাহীন দুর্নীতি ও অপচয় হচ্ছে। ব্যক্তি খাতে ঋণের সদ্ব্যবহার না হলে সেটি খেলাপি হয়ে যায়। সদ্ব্যবহার করতে না পারলে সরকারের ঋণেরও খেলাপ হবে।’
প্রতি বছরই বিপুল অংকের ঘাটতি রেখে বাজেট ঘোষণা করছে সরকার। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরেও ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট ঘাটতি দেখানো হয়েছে, যা মোট বাজেটের ৩৬ শতাংশ। রেকর্ড এ বাজেট ঘাটতি পূরণ করতেই দেশী-বিদেশী উৎস থেকে ঋণ বাড়াচ্ছে সরকার। চলতি অর্থবছরে সরকার দেশের ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল।
তবে সরকারকে এ পরিমাণ ঋণ দেয়ার সক্ষমতা নেই দেশের ব্যাংক খাতের। এজন্য ব্যাংকগুলোর কাছে ট্রেজারি বিল-বন্ড বিক্রি না করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেই সরকারকে ঋণের জোগান দিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকারের নেয়া ঋণের পরিমাণও অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। গত পাঁচ বছরেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের নেয়া ঋণের ৯২৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
২০২২ সাল শেষে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের নেয়া ঋণের পরিমাণ ৭ লাখ ১৭ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাত, সঞ্চয়পত্রসহ বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করে জনগণের কাছ থেকে এ ঋণ নিয়েছে সরকার।
বাজেট বিড়ম্বনা
চলতি অর্থবছরের শুরুতে ৬ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছিল সরকার। যদিও ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অর্থবছরের প্রথম আট মাসে এর বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে প্রায় ৩৮ শতাংশ। একই সময়ে রাজস্বও আহরণ হয়েছে লক্ষ্যের অনেক কম। ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল সরকার।
সে হিসাবে অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে এনবিআরকে আয় করতে হবে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা। যদিও এ সময়ে আমদানি-রফতানি, ভ্যাট ও আয়কর খাত মিলিয়ে এনবিআর রাজস্ব আয় করেছে ২ লাখ ২৫ হাজার ৪৮৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ নয় মাসে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৯ হাজার ৩২ কোটি টাকা।
রাজস্ব আয়ে ব্যর্থতাই সরকারের ঋণ-জিডিপি অনুপাত বড় হওয়ার প্রধানতম কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, রাজস্ব আহরণে ব্যর্থতার কারণে সরকারের ঘাটতি বাজেটের আকার প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ঘাটতি বাজেটের আকার যত বড় হবে সরকারের ঋণও তত বাড়বে। এ মুহূর্তে বাজেটের অন্যতম বড় ব্যয়ের খাত হয়ে উঠেছে ঋণের সুদ পরিশোধ। বিদ্যমান পরিস্থিতি চলতে থাকলে সরকারের ঋণের বোঝা বাড়তেই থাকবে। দিনশেষে জনগণকেই সরকারের এ ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘রাজস্ব আয়ে সরকারের ব্যর্থতার কারণে প্রতি বছর ঘাটতি বাজেটের পরিমাণ বাড়ছে। বিশ্বের কোনো দেশই এত কম রাজস্ব আয় দিয়ে চলে না। বাংলাদেশের রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত ৮ শতাংশে নেমে এসেছে। এটি বাড়ানো সম্ভব না হলে অভ্যন্তরীণ ও বিদেশী উৎস থেকে সরকারের ঋণ বাড়বেই। রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত অন্তত ২০-২২ শতাংশে উন্নীত করতে না পারলে সংকটের কোনো সমাধান হবে না।’
এসডব্লিউএসএস/১৫১৫
আপনার মতামত জানানঃ