ঢাকায় গত দেড় মাসে (১ মার্চ থেকে ১৮ এপ্রিল) ফায়ার সার্ভিস সাড়া দিয়েছে, এমন অগ্নিদুর্ঘটনা ছিল ১৬টি। এর মধ্যে সাতটির কারণ জানা গেছে। চারটি ঘটেছে বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে। দুটি ঘটনা ঘটে গ্যাসলাইনের মাধ্যমে নির্গত হওয়া গ্যাস জমে থেকে। এসব ঘটনা হলো মার্চের প্রথম সপ্তাহে ঢাকার সায়েন্স ল্যাবরেটরির সামনে ও সিদ্দিকবাজারের বিস্ফোরণ। এতে ৩২ জনের মৃত্যু হয়। এর বাইরে রামপুরার একটি ভবনে সিগারেট থেকে আগুন লেগেছিল বলে জানায় ফায়ার সার্ভিস। বঙ্গবাজার ও নিউ সুপার মার্কেটের ঘটনার তদন্ত এখনো শেষ করতে পারেনি বাহিনীটি।
অনেক সময় দেখা যায়, বিদ্যুৎ সরবরাহব্যবস্থার সরঞ্জামের কারণেও দুর্ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিস বলছে, গত রোববার রাতে ঢাকার ওয়ারী পুলিশ ফাঁড়ির সামনে ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণের পর একটি ভবনে আগুন লেগে যায়। এ ঘটনায় কেউ হতাহত হননি। এর আগে ১ এপ্রিল ওয়ারীর জয়কালী মন্দিরের কাছে সুইপার কলোনিতে ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণের পর আগুন লেগে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা অঞ্চলের উপপরিচালক দিনমনি শর্মা বলেন, এখন প্রচণ্ড দাবদাহ চলছে। এ কারণে বিদ্যুতের পাশাপাশি এসির ব্যবহার অনেক বেড়েছে। এ কারণে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বিদ্যুতের প্রবাহ অনেক বেশি হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে নিম্ন মানের বৈদ্যুতিক তার ও সরঞ্জাম ব্যবহৃত হলে সেখান থেকে বৈদ্যুতিক গোলযোগের সৃষ্টি হয়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দুর্ঘটনা থেকে বাঁচতে হলে সরকারের তদারকি, মানসম্মত পণ্যের ব্যবহার ও সচেতনতার বিকল্প নেই। আগুন নেভানোর জন্য ব্যবস্থা থাকতে হবে সব স্থাপনায়।
কেন এতো দুর্ঘটনা?
ফায়ার সার্ভিস অগ্নিদুর্ঘটনার আরও কিছু কারণ খুঁজে পেয়েছে। তাদের হিসাব অনুযায়ী, আগুনের ঘটনার দ্বিতীয় বড় কারণ বিড়ি ও সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরা। ২০২২ সালে ১৬ শতাংশের কিছু বেশি অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে এ কারণে। প্রায় ১৪ শতাংশ অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটেছে চুলা থেকে। সেটি বৈদ্যুতিক, গ্যাস বা মাটির চুলা হতে পারে। গ্যাস সরবরাহ লাইনও আগুনের ঘটনার উল্লেখযোগ্য কারণ। ২০২২ সালে ৩ শতাংশের কিছু বেশি আগুনের ঘটনা ঘটেছে গ্যাস সরবরাহ লাইন থেকে।
বৈদ্যুতিক গোলযোগ, বিড়ি ও সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরা, চুলা ও গ্যাসের লাইন থেকে ৭১ শতাংশ অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটেছে ২০২২ সালে। এর বাইরে ছোটদের আগুন নিয়ে লেখা, উত্তপ্ত ছাই বা জ্বালানি, খোলা বাতির ব্যবহার, যানবাহনের দুর্ঘটনার আগুন ইত্যাদি অগ্নিদুর্ঘটনার কারণ। সব মিলিয়ে কারণ পাওয়া গেছে ১৯টি। তবে ফায়ার সার্ভিসের হিসাবে ৪ হাজার ৯১টি দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে কারণ অজ্ঞাত বা অন্যান্য উল্লেখ করা হয়েছে।
২০২২ সালে অগ্নিদুর্ঘটনায় ৮৫ জনের লাশ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় যাঁরা মারা যান, তাঁদের হিসাব ফায়ার সার্ভিস রাখে না। অগ্নিদুর্ঘটনাগুলোতে প্রায় ৩৪৩ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
অগ্নিদুর্ঘটনার কারণগুলো নতুন করে সামনে আসছে ঢাকায় কয়েকটি বড় অগ্নিকাণ্ডের পর। এর মধ্যে ৪ এপ্রিল বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে ভয়াবহ আগুনে সেখানকার চারটি বিপণিবিতানের ২ হাজার ৯৬১টি দোকান পুড়ে গেছে। এ ছাড়া মহানগর মার্কেটের ৭৯১টি, বঙ্গ ইসলামিয়া মার্কেটের ৫৯টি এবং বঙ্গ হোমিও কমপ্লেক্সের ৩৪টি দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তদন্তে উঠে এসেছে আগুনের কারণ, জ্বলন্ত সিগারেটের টুকরা অথবা মশা দূর করার জ্বলন্ত কয়েল।
১৫ এপ্রিল ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডে কমপক্ষে ২৫০টি দোকান পুড়ে গেছে। ওই আগুনের কারণ এখনো জানা যায়নি।
ফায়ার সার্ভিসের সাবেক পরিচালক (অপারেশন) ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা–বিশেষজ্ঞ মেজর (অব.) এ কে এম শাকিল নেওয়াজ বলেন, তাঁর পর্যবেক্ষণ হলো, বাসাবাড়িতে অধিকাংশ আগুন লাগে রান্নার চুলা থেকে। কলকারখানাসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে লাগার বড় কারণ বৈদ্যুতিক গোলযোগ।
বৈদ্যুতিক গোলযোগ কেন?
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) একজন শিক্ষক এবং ফায়ার সার্ভিসের বর্তমান ও সাবেক দুজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে বৈদ্যুতিক গোলযোগের কয়েকটি কারণ জানা যায়। তাঁরা বলেন, বিদ্যুতের তার দিয়ে ক্ষমতার চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ সঞ্চালন, নিম্ন মানের তার ও সরঞ্জাম ব্যবহার, অবহেলা ও নিয়মিত তদারকি না করা প্রধান কারণ।
ফায়ার সার্ভিসের সাবেক পরিচালক শাকিল নেওয়াজ বলেন, বিদ্যুতের তার দিয়ে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ সঞ্চালিত হলে তাপে সেটি অনেক বেশি প্রসারিত হয়। তখন তারের ওপরে থাকা প্লাস্টিক আবরণ গলে স্ফুলিঙ্গ হয়। সেখান থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। তিনি জানান, প্রচণ্ড গরমে বৈদ্যুতিক পাখাসহ শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের (এসি) ব্যবহার বেড়ে যায়। তখন তার দিয়ে ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ সঞ্চালনের ঘটনা ঘটে।
মান নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) বাধ্যতামূলক পণ্যের তালিকায় থাকা ২২৯টি পণ্যের মধ্যে বিদ্যুতের তার ও সরঞ্জাম রয়েছে। অর্থাৎ এসব পণ্য বিএসটিআইয়ের নির্ধারিত মান মেনে উৎপাদন ও আমদানি হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করতে হবে।
বিএসটিআইয়ের সার্টিফিকেশন মার্কস (সিএম) শাখার উপপরিচালক রিয়াজুল হক বলেন, বিদ্যুতের তার উৎপাদন ও বাজারজাতের ক্ষেত্রে বিএসটিআইয়ের অনুমোদন নেওয়া বাধ্যতামূলক। তবে অসাধু কিছু ব্যক্তি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের লোগো ও সিল ব্যবহার করে নিম্ন মানের তার উৎপাদন করে বাজারে ছেড়ে দেন। স্বাভাবিকভাবে অনেক সময় ওই তার দেখে বোঝার উপায় থাকে না সেটি আসল, নাকি নকল। যাঁরা এ ধরনের তার উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে বিএসটিআই নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে।
দেশে ২ এপ্রিল থেকে চলা দাবদাহের কারণে অনেকে বাসায় এসি লাগাচ্ছেন। যদিও ভবনে ব্যবহার করা তারের সক্ষমতা কতটুকু, সেটি জানা ও বোঝা কঠিন। বেশির ভাগ মানুষ ভাড়া বাসায় থাকেন। তাঁরা জানেন না ভবনে ব্যবহার করা বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম কতটা মানসম্মত। বিপণিবিতান ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে সাধারণ দোকানমালিক অথবা কর্মীর পক্ষে নিরাপত্তার বিষয়গুলো জানার উপায় থাকে না।
বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের প্রধান মো. আয়নাল হক বলেন, বাসাবাড়িসহ যেকোনো প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুতের তার ও সরঞ্জাম স্থাপনের সময় বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত। বিশেষ করে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কোনো বৈদ্যুতিক যন্ত্র স্থাপনের আগে অবশ্যই বিশেষজ্ঞদের মতামত নিতে হবে। তিনি মনে করেন, ভবন নির্মাণের সময় বৈদ্যুতিক ব্যবস্থাপনা কেমন হবে, সে বিষয়ে অভিজ্ঞ প্রকৌশলী বা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩০৫
আপনার মতামত জানানঃ