১৯৪০ এর দশকের শেষদিকে রাশিয়ার আভাদিয়েভোর প্যালিওলিথিক প্রত্নতাত্বিক সাইটে পাওয়া ম্যামথের দাঁত থেকে তৈরি একটি চামচকে জাদুঘরে পাওয়া প্রাচীনতম চামচ হিসেবে মনে করা হয়।
চামচটি প্রায় ২১ হাজার বছর পুরানো বলে মনে করা হয়। প্রথম শতাব্দীর প্রথমদিকে, রোমানরা চামচগুলোর হাতল রূপা দিয়ে তৈরি করত। নিউ ইয়র্ক সিটির মেট্রোপলিটন যাদুঘরে প্রায় দুই হাজার বছরের পুরনো রূপার হ্যান্ডেলযুক্ত চামচের একটি সেট দেখা যায়।
বাসনের জগতে কাঁটাচামচের স্থান সবচেয়ে নতুন। ইজিপ্সিয়ান এবং চীনের কিজিয়া সংস্কৃতিই খাবার টেবিলে কাঁটাচামচের ব্যবহারের অগ্রদূত। তবে কাঁটাচামচের ব্যবহারকে একটা সময়ে কলঙ্কজনক হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
তবে আধুনিকতা মানুষকে শিখিয়েছে চামচ দিয়ে খাবার খাওয়া। এটা একধরনের ভদ্রতা বলেও গণ্য করা হয়। এমনকি চামচের হাতলের ডিজাইন বলে দেবে আপনার আভিজাত্য আর রুচির পরিচয়। তবে কখনো ভেবে দেখেছেন কি? কখন থেকে শুরু হলো চামচের ব্যবহার।
যদি ছুরি-চামচ এবং কাঁটাচামচ সম্পর্কে আধুনিক পশ্চিমা ধারণা অনুসন্ধানকে সংকীর্ণ করেন। তবে পাওয়া যাবে অনেক তথ্য। লন্ডনের ব্রিটিশ যাদুঘরের প্রাচীনতম বস্তুগুলোর মধ্যে একটি হলো ওলুভুই পাথর কাটার সরঞ্জাম যা তানজানিয়ায় এক আদিম মানব গুহায় পাওয়া গিয়েছিল।
ধারণা করা হয় যে, এটি ১.৮ মিলিয়ন বছর পুরোনো। বিশেষজ্ঞরা মতে, এই সরঞ্জামটি প্রাথমিকভাবে ছুরি হিসেবে ব্যবহার করা হত, এমনকি বড় বড় প্রাণীর মাংস কাটতে বা হাড় থেকে মজ্জা বা বোনম্যারো বের করতে এটি মানব জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ের অস্ত্রগুলোর মধ্যে একটি প্রয়োজনীয় অস্ত্র ছিল।
খাবারদাবারের সরঞ্জামের মধ্যে চামচ প্রাচীনতম সরঞ্জামগুলোর মধ্যে একটি। প্রথম দিকের মানুষের ব্যবহৃত প্রাকৃতিক চামচ থেকে শুরু করে কাঠের টুকরা, পশুর শিং এবং অবশেষে ধাতব থেকে ফ্যাশনেবল চামচ পর্যন্ত চামচের বিবর্তন খুব স্বাভাবিক ঘটনা।
১২৫৯ সালে ইংল্যান্ডে চামচের ব্যবহার শুরু হয়। বৃটিশ রাজাদের মধ্যে চামচ এর জনপ্রিয়তা ছিল অনেক। যারা রাজা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করতেন তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে চামচ দিয়ে সংবর্ধিত করা হতো। টিউডর ও স্টুয়ার্ড যুগে চামচ আরো বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করে।
তখন বাচ্চাদের নামকরণ অনুষ্ঠানে উপহার হিসেবে চামচ দেয়ার রীতি ছিল। তাও দিতে হত ধর্মযাজকে। ধনীরা ১২টি চামচের একটি সেট দিত। পরবর্তীতে ১৩টি চামচ দেয়া হতো; যার একটিকে বলা হতো প্রধান চামচ বা মাস্টার স্পুন।
ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের মধ্যেও উপহার হিসেবে চামচ দেয়ার রীতি চালু হয়। ধনী ব্যক্তিরা সোনা বা রূপার তৈরি চামচ আর মধ্যবিত্তরা কপার এর তৈরি চামচ উপহার দিত। তবে কাঁটাচামচের ব্যবহার আর একটু আগে থেকে। তবে সেসময় কাঁটাচামচ হিসেবে ব্যবহার হত না।
আসলে প্রাচীনকাল থেকেই খাবার তোলার সুবিধার্থে কাঁটার ব্যবহার ছিল। তবে কাঁটা ওয়ালা চামচ বা কাঁটা চামচের ব্যবহার প্রথম শুরু হয় প্রাচীন মিশরে। কুইজিয়া সংস্কৃতিতে কাঁটা চামচ ব্যবহার হতো। এর পরবর্তীতে প্রায় কয়েক হাজার বছর পর পাশ্চাত্যে কাঁটা চামচ জনপ্রিয়তা লাভ করে।
একাদশ শতাব্দীতে বায়জান্টাইন রাজকুমারী থিওডোরা আন্না দৌকাইনা এর বিয়ের যৌতুক হিসেবে সোনার তৈরি কাঁটা চামচ নিয়ে এসেছিলেন বর। তবে সেই দেশের জনগণ বিষয়টিকে ভালোভাবে নিতে পারেনি।
ঈশ্বরের দেয়া হাত ব্যবহার না করে চামচ ব্যবহার করে খাওয়াকে ঈশ্বরের অপমান হিসেবে নিয়েছিল তারা। মূলত ১৬ শতাব্দীর দিকে কাঁটা চামচ জনপ্রিয়তা লাভ করে।
ছুরির ব্যবহার শুরু হয়েছিল প্রাগ-ঐতিহাসিক যুগ থেকেই। শিকার ও খাবার কাটার ক্ষেত্রে ছুরির ব্যবহার হত। তবে ফ্রান্সের বোরবোন সাম্রাজ্যের আমলে খাবার টেবিলে ছুরির ব্যবহার হতো। তবে সেগুলো খাওয়ার কাজে ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটু বেশি ধারালো ছিল। ১৬৬৯ সালে চতুর্দশ লুইস খাবার টেবিলে ধারালো ছুরির ব্যবহার নিষিদ্ধ করেন।
এরও অনেক আগে ১০০৪ সালে, বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সম্রাটের গ্রীক ভাইঝি ভেনিসে তার বিবাহের ভোজে সোনার কাঁটাচামচ ব্যবহার করেছিলেন। তিনি ভেনিসের দোজের (অনেকটা ইংল্যান্ডের ডিউকের মতো পদ অথবা প্রধান বিচারপতিও বলা যায়) পুত্রকে বিয়ে করেছিলেন।
লিসা ব্র্যামেন তার এ হিস্ট্রি অফ ওয়েস্টার্ন ইটিং ইউটেনসিল- স্ক্যান্ডেলাস ফর্ক টু ইনক্রেডিবল স্পর্ক’ শীর্ষক একটি নিবন্ধে লিখেছেন, “সেই সময়, বেশিরভাগ ইউরোপীয়রা তাদের আঙ্গুল এবং ছুরি ব্যবহার করে খাবার খেয়েছিলেন। গ্রীক নববধূর নতুন পরিকল্পনার বাস্তবায়নকে স্থানীয় ধর্মযাজকরা পাপ হিসেবে নিয়েছিলেন।
তিনি তার প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ঈশ্বর তার প্রজ্ঞায় মানুষকে প্রাকৃতিক কাঁটাচামচ দিয়েছেন– তার আঙ্গুলগুলো, এক ভেনিশিয়ান অবজ্ঞাভরে বলেছিলেন। কয়েক বছর পরে যখন সম্রাটের ভাইজি প্লেগের কারণে মারা যান সেই সম্য সেন্ট পিটার ড্যামিয়ান বলেছিলেন যে, খাওয়ার সময় তাদের জন্য কৃত্রিম ধাতব কাঁটাচামচের বিকল্প ব্যবস্থা করা করা তার কাছে অপমানজনক।
তিনি আরও বলেন যে, এটি তার ঘৃণ্য অহঙ্কারের জন্য ঈশ্বরের শাস্তি। তবে সৌভাগ্যের কথা এটাই যে কাঁটাচামচ নিয়ে আজ এই ধরণের মানসিকতা বিলুপ্ত। বরং সুষ্ঠুভাবে ও নিখুঁত ভাবে কাঁটাচামচের ব্যবহারেই আধুনিক মানুষের আভিজাত্য প্রকাশ পায়।
এসডব্লিউএসএস/১৬৩০
আপনার মতামত জানানঃ