বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের পথে প্রধান বাধা দুর্নীতি। আর এই দুর্নীতি হয় ঘাটে ঘাটে। এর সঙ্গে জড়িত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ব্যাংক ও আর্থিক খাতের ব্যক্তিরা।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এর কারণে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার যেমন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তেমনি পণ্য ও সেবার দামও বেড়ে যচ্ছে। যার সর্বশেষ শিকার হচ্ছেন ক্রেতা-ভোক্তারা।
এর সঙ্গে রয়েছে অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, ঋণপ্রাপ্তির অপর্যাপ্ততা ও অদক্ষ প্রশাসন। তবে দুর্নীতিই এখন দুশ্চিন্তার সবচেয়ে বড় কারণ।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের এক জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে। বাংলাদেশ সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) তাদের পার্টনার হিসেবে বাংলাদেশে এই জরিপ পরিচালনা ও ফলাফল প্রকাশ করেছে।
গত বছরের এপ্রিল থেকে জুলাই মাসে তারা এই জরিপ করে। জরিপে ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর এলাকায় কৃষি উৎপাদন ও সেবা খাতে নিয়োজিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ৭৪ জন ব্যবসায়ী অংশ নেন।
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৬৪.৬ শতাংশ জানিয়েছেন ব্যবসায় প্রসারের প্রধান বাধা এখন দুর্নীতি। এছাড়া ৪৪.৬ শতাংশ মনে করছেন ব্যবসায় আরেকটি বাধা অবকাঠামোগত উন্নয়নের সুফল না পাওয়া। ৪৩.১ শতাংশ বলছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারনে তারা ব্যবসায় সুফল পাচ্ছেন না। আর ৩৮.৫ শতাংশ বলছেন মূল্যস্ফীতির কারনে তারা ব্যবসায় নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।
৭৫ শতাংশ ব্যবসায়ী আমদানি-রপ্তানিতে, ৫৪ শতাংশ লাইসেন্স নিতে, ৪৯ শতাংশ গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির সংযোগ নিতে এবং ৪৮ শতাংশ কর দেওয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতির কথা বলেছেন।
সিপিডি বলছে, ২০২২ সালে বাংলাদেশের ব্যবসায় পরিবেশের অগ্রগতি দেখা দেখা যায়নি। হয় এটি স্থবির ছিল, নতুবা আগের তুলনায় খারাপ হয়েছে।
সিপিডি বলছে, দুর্নীতির কারণে শুধু উৎপাদন খরচ নয়, পণ্য ও সেবার দামও অনেকখানি বেড়ে যায়। এর একটি অংশ সাধারণ মানুষের ওপরই পড়ে। এ ধরনের পরিস্থিতি হলে শুধু ব্যবসার পরিবেশ নয়, অর্থনৈতিক পরিবেশও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপেশাদার আচরণ এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি ব্যবসায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
দুর্নীতির পাশাপাশি নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ ব্যবসাকে আরো সমস্যায় ফেলছে বলে জানিয়েছে সিপিডি। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করছে বৈদেশিক মুদ্রার উত্থান-পতন, আমলাতন্ত্র ও মূল্যস্ফীতি। আর বড় ব্যবসায়ীদের জন্য এসবের পাশাপাশি অবকাঠামোর অপ্রতুলতা সমস্যার সৃষ্টি করছে।
দুর্নীতির বাংলাদেশ নাকি বাংলাদেশের দুর্নীতি?
জরিপটি উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক অর্থনীতিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, সারাদেশে যে ব্যাপকহারে দুর্নীতি হচ্ছে এটা তারই প্রতিফলন। আমরা এটাকে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি বলছি। এর সঙ্গে সরকারি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লোকজনই জড়িত। এই দুর্নীতির ফলে ব্যবসার ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। ফলে ব্যবসা সম্প্রসারণ বা উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সামাগ্রিক অর্থনীতিতে।
তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, “এর ফলে ব্যবসায়ীরা যে ব্যবসা বন্ধ করে দিচ্ছেন তা নয়, কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ব্যবসায় অদক্ষতা তৈরি হচ্ছে এবং দীর্ঘ মেয়াদে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে ব্যবসা দুর্বল হয়ে পড়ছে। আর ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারেও প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছেন ব্যবসায়িরা।”
তিনি বলেন, “এর পিছনে রয়েছে সুশাসন এবং আর্থিক সুশাসনের অভাব। এর ফলে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। সরকার যেটাকে স্বীকার করতে চায় না। কিন্তু এটা দূর করতে না পারলে বাংলাদেশে ব্যবসা বাণিজ্য আরো কঠিন হয়ে পড়বে।”
এফবিসিআিইয়ের সাবেক পরিচালক মো. হেলালউদ্দিন বলেন, ব্যবসার এমন কোনো খাত নেই যেখানে আমাদের টাকার লেনদেন করতে হয় না। আমাদের ঘাটে ঘাটে পয়সা দিতে হয়।
যেমন এলসির কথাই ধরুন। বড় বা প্রভাবশালীরা হয়তো পার পেয়ে যান; কিন্তু যারা ছোট ব্যবসায়ী তাদের উপায় নেই, এলসি খুলতে আর্থিক লেনদেন করতেই হবে। এগুলো বলতেও লজ্জা লাগে। ২০ হাজার ডলারের এলসি করতে হলে তাদের ব্যাংকে ৪০ লাখ টাকা জমা রাখতে হবে।
তার কথা, “নতুন প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নিতে আবার নানা প্রতিষ্ঠানের অনাপত্তিপত্র লাগে। তার প্রতিটি ঘাটেই পয়সা দিতে হয়। আর পণ্য পরিবহনেও পথে পথে চাঁদা দিতে হয়। ফলে যা হয় খরচ বেড়ে যায়। আমি ব্যবসায়ী হিসেবে যেহেতু চাঁদা দিয়েছি তাই আমরা তা আদায় করি ভোক্তা বা ক্রেতাদের কাছ থেকে।”
তিনি বলেন, “বিষয়গুলো আমরা এফবিসিসিআইয়ের মাধ্যমে বার বার সরকারের বিভিন্ন মহলে এই দুর্নীতি ও হয়রানির কথা জনিয়েছি; কিন্তু কোনো ফল পাইনি।”
ভুগতে হয় সাধারণ নাগরিককে
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশল অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, ব্যবসায়ীরা ঘাটে ঘাটে যে টাকা দেন তা তাদের খরচের মধ্যেই ধরেন।
ফলে এই দুর্নীতির মূল্য পরিশোধ করতে হয় ক্রেতাদেরই। হয়তো জরিপ করলে দেখা যাবে ইউক্রেন যুদ্ধের চেয়ে ও এই দুর্নীতি পণ্যমূল্য বাড়ার পিছনে বড় কারণ হিসেবে কাজ করছে।
তিনি বলেন, এলসিতে দুর্নীতির কারণে আমদানি করা সব পণ্যের দামই প্রকৃত দামের চেয়ে বেশি। আবার দেশে উৎপাদিত পণ্যের দামও দুর্নীতির কারণে প্রকৃত দামের চেয়ে বেশি হচ্ছে।
এসডব্লিউএসএস/১০১৮
আপনার মতামত জানানঃ