আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো অপরাধ দমন। সেই বিবেচনায় তারা অপরাধী ধরতে যেকোনো সময় অভিযান চালাতে পারে। কিন্তু সেই অভিযান যদি বিরোধী দলের পূর্বনির্ধারিত সমাবেশ সামনে রেখে হয়ে থাকে, তখন প্রশ্ন ওঠে। অভিযানের উদ্দেশ্য নিয়ে জনমনে সংশয় ও সন্দেহ দেখা দেয়।
উল্লেখ্য, গত ২৯ নভেম্বর পুলিশ সদর দপ্তরের অপারেশন শাখার পাঠানো এক আদেশ অনুসারে, দেশের সব পুলিশ ইউনিটের প্রধান ও সব জেলার পুলিশ সুপারদের ১ ডিসেম্বর থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশেষ অভিযান চালাতে বলা হয়। ঢাকার আদালত থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় সৃষ্ট পরিস্থিতি বিবেচনায় এই বিশেষ অভিযান পরিচালনা করার কথা উল্লেখ করা হয় ওই আদেশে।
পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শকের (অতিরিক্ত ডিআইজি) স্বাক্ষর করা চিঠিতে বলা হয়, পুরান ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত (সিএমএম আদালত) এলাকায় পুলিশের হেফাজত থেকে দুই জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার প্রেক্ষাপট বিবেচনা, মহান বিজয় দিবস, খ্রিষ্টানদের বড়দিন ও ইংরেজি বর্ষবরণ (থার্টি ফার্স্ট নাইট) উদ্যাপন নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন করতে চলমান অভিযানের পাশাপাশি ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে বিশেষ অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। অন্যান্য স্থানের পাশাপাশি আবাসিক হোটেল, মেস, হোস্টেল, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, কমিউনিটি সেন্টারসহ অপরাধীদের লুকিয়ে থাকার সম্ভাব্য স্থানগুলোতে কার্যকর অভিযান চালানো হবে।
অভিযানের প্রথম তিন দিনে সারা দেশে ১ হাজার ২২০ জনকে গ্রেপ্তারের খবর জানা গেছে। জঙ্গি, মাদকসেবী থাকতে পারে এই ধারণা থেকে বনানীর কাকলী এলাকায় কয়েকটি আবাসিক হোটেলে ‘ব্লক রেইড’ করা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সে রকম কোনো অপরাধীকে তারা পাকড়াও করতে পারেনি। তবে রাজশাহী থেকে ফেরার পথে আমিনবাজার থেকে যুবদল কেন্দ্রীয় সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিনসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে শনিবার রাতে। এ ছাড়া পুলিশ যশোর, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থান থেকে বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের অনেক নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে; যাদের বিরুদ্ধে আগে মামলা ছিল না; গ্রেপ্তারের পর পূর্বতন মামলার আসামি করা হয়েছে।
এ সময় বিভিন্ন আবাসিক হোটেল ও মেসে অভিযানকালে পুলিশের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি হয়রানির অভিযোগও পাওয়া গেছে। তবে পুলিশ বলছে, বিশেষ অভিযানে অপরাধীদের ধরা হচ্ছে। সে যে দলেরই হোক। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কোনো বিএনপি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। কাউকে হয়রানি না করতে মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমাদের বিশেষ অভিযানে অনেকে গ্রেপ্তার হচ্ছেন। যাদের মধ্যে ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি ও বিভিন্ন অপরাধে অভিযুক্ত রয়েছেন।’
এদিকে জঙ্গিবাদ দমনে গঠিত পুলিশের বিশেষ ইউনিট অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ) সদর দপ্তরের পুলিশ সুপার (মিডিয়া) আসলাম খান গতকাল রাতে ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমরা জঙ্গি গ্রেপ্তারে সব সময়ই প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখি। একজন জঙ্গিকে গ্রেপ্তারের আগে কয়েক মাস ধরে কাজ করতে হয়। আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
পুলিশের এই গ্রেপ্তার অভিযান তখনই শুরু হয়েছে, যখন বিএনপির ১০ ডিসেম্বর নির্ধারিত সমাবেশ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন বেশ উত্তপ্ত। বিএনপি বলছে, তারা নয়াপল্টনে দলীয় অফিসের সামনে সমাবেশ করবে। ডিএমপি বলছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে হবে। এর আগে বিএনপি ঢাকার বাইরে যেসব বিভাগীয় সমাবেশ করেছে, তা নিয়েও বেশ চাপান–উতর ছিল। প্রতিটি সমাবেশের আগে পরিবহন ধর্মঘট হয়েছে। দলীয় নেতা-কর্মীরা গ্রেপ্তার ও হয়রানির শিকার হয়েছেন।
বিএনপি যখন বিভাগীয় সমাবেশ করছে, তখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ ও দলীয় সম্মেলন করছে। কিন্তু উদ্বেগের সঙ্গে দেশবাসী এ ক্ষেত্রে সরকারের দ্বিমুখী নীতি প্রত্যক্ষ করছে। ক্ষমতাসীন দলের কর্মসূচির ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও জনপ্রশাসন সর্বাত্মক সহযোগিতা করছে। বিপরীতে বিএনপির সমাবেশ এলেই তাদের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার ও তঁাদের বাড়িতে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। এ বিষয়ে বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল আইজিপির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে উদ্বেগও জানিয়েছে।
১০ ডিসেম্বরের সমাবেশের ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান পরিষ্কার। ‘এখানে সমাবেশ করা যাবে না’ কিংবা ‘এখানেই করতে হবে’—উভয় পক্ষের এই অনড় অবস্থান ঢাকার বাসিন্দাদের উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ১০ ডিসেম্বর যেখানেই সমাবেশ হোক না কেন, সেই কর্মসূচি সামনে রেখে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার-হয়রানি বন্ধ করতে হবে। সরকারের দাবি অনুযায়ী অপরাধীদের ধরতেই যদি বিশেষ অভিযান পরিচালিত হয়ে থাকে, তাহলে পাইকারি হারে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করে পুরোনো মামলার আসামি করা হচ্ছে কেন?
এসডব্লিউএসএস/১৪৫৩
আপনার মতামত জানানঃ