বাজারে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে বেশ অস্বস্তিতে আছেন সাধারণ মানুষ। প্রতিনিয়ত প্রতিটি পণ্যের দাম হু হু করে বাড়ছে। মধ্যবিত্তরাও এখন দামের চাপে ব্যাগের তলানিতে পণ্য নিয়ে ফিরছেন ঘরে। নিম্নবিত্তদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। এর মধ্যেই আবার জানা গেল, বৃদ্ধি পেয়েছে মাথাপিছু আয়। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের মানুষের গড় মাথাপিছু আয় ২৩৩ ডলার বেড়ে ২ হাজার ৮২৪ ডলারে পৌঁছেছে।
মূলত বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটে স্বল্প আয়ের মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে। তাদের খাদ্যতালিকা থেকে মাছ-মাংস বাদ দিতে হচ্ছে। তবে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৮২৪ ডলার হলে মাছ-মাংস কীভাবে ‘বিলাসী পণ্য’ হয়, এটাই একটা প্রশ্ন।
অনলাইন প্ল্যাটফর্মে আজ বৃহস্পতিবার সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) আয়োজনে ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি: উদ্বেগের জায়গা ও করণীয়’ শীর্ষক সেমিনারে এসব কথা বলেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান। তিনিই মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
সেলিম রায়হান বলেন, বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটে বড় শঙ্কার জায়গা হচ্ছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও খাদ্যনিরাপত্তায় ঝুঁকি। গত ফেব্রুয়ারি থেকে মূল্যস্ফীতি ৬ থেকে সাড়ে ৯ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। বাস্তবে মূল্যস্ফীতি আরও বেশি, তবে কমিয়ে দেখানো হচ্ছে—এমন বিতর্কও আছে।
অথচ ভিয়েতনাম, ভারত ও ইন্দোনেশিয়ায় মূল্যস্ফীতির হার বাংলাদেশের চেয়ে কম। গত অক্টোবরে মূল্যস্ফীতির হার ভারতে ৬ দশমিক ৭৭, ইন্দোনেশিয়ায় ৫ দশমিক ৭১ এবং ভিয়েতনামে ৪ দশমিক ৩০ শতাংশ। আর বাংলাদেশে ছিল ৮ দশমিক ৯১ শতাংশ।
রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের ওপর ধারাবাহিক জরিপের ফলাফল তুলে ধরে সানেমের নির্বাহী পরিচালক বলেন, পোশাকশ্রমিকদের খাদ্যনিরাপত্তার সূচক নিম্নমুখী। তার মানে পোশাকশ্রমিক ও তাঁর সন্তানেরা আগের চেয়ে কম খাবার খাচ্ছেন। শ্রমিকদের মাসিক মজুরিও কমেছে। ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ার কারণে শ্রমিকের কর্মঘণ্টা কমেছে।
সানেমের নির্বাহী পরিচালক বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও প্রকৃত মজুরি কমে যাওয়ায় খাদ্যনিরাপত্তায় ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। গত ১১ মাসে রিজার্ভ গড়ে ১০০ কোটি ডলার কমেছে। রপ্তানি ও প্রবাসী আয়েও সামনের দিনে সুখবর নেই। তবে পণ্য আমদানির ঋণপত্র কমেছে।
তার মধ্যে মূলধনি যন্ত্রপাতি ও মধ্যবর্তী কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়ায় চলতি অর্থবছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান কমবে। বিদেশি ঋণের কাঠামোও পরিবর্তন হচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় না বাড়লে কয়েক বছর পর এই ঋণ পরিশোধের জন্য অর্থনীতিতে বাড়তি চাপ তৈরি হবে।
সেলিম রায়হান আরও বলেন, বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণে স্বল্প মেয়াদে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। আওতা বাড়াতে হবে। কারণ, অনেকেই নতুন করে খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকিতে পড়বে। রিজার্ভের পতন ঠেকাতে হবে। আর মধ্যমেয়াদে রাজস্ব ও ব্যাংক খাতে সংস্কার আনতে সরকারের সদিচ্ছা লাগবে। তা ছাড়া বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে উচ্চপর্যায়ের কমিটি করা দরকার। সেই কমিটির পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
এক প্রশ্নের জবাবে সেলিম রায়হান বলেন, দেশে দুর্ভিক্ষ হওয়ার আশঙ্কা কম। তবে দুর্ভিক্ষের কথা বারবার বললে আতঙ্ক তৈরি হয়। এতে একটি গোষ্ঠী সুযোগ নিতে পারে। দুর্ভিক্ষ না হলেও সাময়িক সময়ের জন্য কোনো কোনো জায়গায় খাদ্যসংকট হতে পারে। এমন আশঙ্কা থাকলে আগে থেকেই ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিশেষজ্ঞের মতামত
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট আলী রিয়াজ এ প্রসঙ্গে বলেন, বাংলাদেশের মানুষের গড় মাথাপিছু আয় ২৩৩ ডলার বেড়ে ২ হাজার ৮২৪ ডলারে পৌঁছেছে সরকারের দেয়া এই তথ্যকে আপনি তিনভাবে দেখতে পারেন।
প্রথমত, এটা একটা তৈরি করা হিসেব, এর সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই। ফাঁকিঝুঁকি, গড়মিল এইসব করে একটা সংখ্যা তৈরি করা হয়েছে। এটা বাংলাদেশের ডলার রিজার্ভের হিসেবের মতো, সরকারের কাছে আইএমএফ ৩৪ বিলিয়ন ডলারের হিসেব চাইলে দেখা গেলো বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বললেন আছে মাত্র ২৪ বিলিয়ন ডলার।
অথচ জ্ঞানীজনেরা নির্বোধ বাংলাদেশিদেরকে রিজার্ভের হিসেব দেখিয়ে বলছেন এখনও ৩৫ বিলিয়ন ডলার আছে। এখন বাতাসে ভিন্ন কথা শোনা যাচ্ছে, রিজার্ভের পরিমাণ সম্ভবত আরও কম। বাতাসের কথা সত্যি না মিথ্যা তা বোঝার উপায় নেই কেননা প্রকৃত হিসেব দেয়ার বাধ্যবাধকতা নেই, জবাবদিহিতার ব্যবস্থা নেই।
রিজার্ভের আকাশচুম্বী পরিমাণ, সারা দেশে বিদ্যুতের বন্যা বইয়ে দেয়া, উন্নয়নের জয়ডঙ্কার মতো এই হিসেবেও আপনার কাছে অবাস্তব মনে হতে পারে। যখন প্রধানমন্ত্রী নিজেও নিশ্চিত না ‘দুর্ভিক্ষ’’ হবে কি হবেনা, যখন সাধারণ মানুষের নুন আনতে পান্তা ফুরোচ্ছে – সেই সময়ে মাথাপিছু আয় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে কীভাবে সেই প্রশ্ন আপনি করতেই পারেন। আর সেই উত্তর না পেলে আপনাকে এই উপসংহারে পৌছুতে হবে – এই অংক বানানো।
দ্বিতীয়ত, মাথাপিছু আয় অবশ্যই বেড়েছে। সবার বাড়েনি – কেননা এই হিসেব গড় আয়ের। ফলে আপনার- আপনার পরিবারের, বন্ধু-বান্ধব-আত্মীয়স্বজনের বাড়েনি মানে এই নয় যে আয় বাড়েনি। আপনি না হয় ওএমএস এর লাইনে জায়গা খুঁজছেন, আপনার পরিচিতজন না হয় খাবারের পরিমাণ কমাচ্ছে, কিন্ত অন্য কারো বেড়েছে।
তার মানে দাঁড়াচ্ছে যখন অধিকাংশের আয় কমছে তখন খুব স্বল্প সংখ্যকের আয় বাড়ছে; এই বৃদ্ধি যৎসামান্য নয়, এতটাই যে সারা দেশের ১৮ কোটি মানুষকে টেনে তুলছে। তাঁরা সংখ্যায় কম – তার মানে বুঝতে পারছেন? তার অর্থ হল বৈষম্য বাড়ছে – ভয়াবহ ভাবেই বাড়ছে। যাদের আয় বাড়ছে তাঁরা কারা? এই সময়ে ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়-প্রশ্রয় না পেয়ে এই বৃদ্ধি যে সম্ভব না তা বুঝতে রকেট-বিজ্ঞানী হতে হয় না।
চারিদিকে যখন সংকটের কথা, যখন সরকার এইএমএফ, বিশ্বব্যাংক এবং অন্যদের কাছে ঋণ চাইছে এই বলে যে না হয় সাধারণ মানুষ কষ্টে পড়বে সেই সময়ে মাথাপিছু আয় বাড়া মানুষগুলো কারা? কী ধরণের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থা বহাল থাকলে এই রকম ‘আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ’ হওয়াকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেয়া হয়।
তৃতীয়ত, সরকার বলেছে অতএব এটা ধ্রুব সত্য। আমাদের মেনে নিতেই হবে। আপনার চারপাশে কী ঘটলো তা নিয়ে চিন্তা করে লাভ নেই – সরকারে আস্থা রাখুন। শুধু তাই নয়, এখনই এই কথা প্রচারের জন্যে ঢোল জোগাড় করুন, না পারলে সামাজিক মাধ্যমে দুই বাক্য লিখুন – এতে আপনি কত গর্বিত। (কিন্ত বাজারে যাবেন না, সেখানে জিনিসপত্রের দাম বেশ চড়া)।
এসডব্লিউএসএস/১৯২৩
আপনার মতামত জানানঃ