ভারতের আসামে বাংলাভাষী মুসলমানদের একটি সংগ্রহশালা বন্ধ করে দিয়েছে সেরাজ্যের সরকার। মাত্র দুদিন আগে খোলা হয়েছিল ‘মিঞাঁ মিউজিয়াম’ নামে ওই সংগ্রহশালাটি। সরকার বলছে সরকারী প্রকল্পে বাসস্থানের জন্য দেওয়া একটি বাড়িতে ওই মিউজিয়াম গড়ে তোলা হয়েছিল বলেই সেটি সিল করে দেওয়া হয়েছে এবং তিনজন উদ্যোক্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তবে বাংলাভাষী মুসলমানরা বলছেন তাদের জনগোষ্ঠীকে ব্যবহার করে রাজনীতি করার জন্যই ওই মিউজিয়ামটি গড়া হয়েছিল।
ওই মিউজিয়ামে লাঙল, হাল, মাছ ধরার সরঞ্জাম, গামছা, লুঙ্গি ইত্যাদি যেসব দ্রব্য মূলত বাংলাভাষী মুসলমান কৃষকরা ব্যবহার করেন, সেগুলোই প্রদর্শিত হয়েছিল।
কিন্তু বাড়িটি যেহেতু প্রধানমন্ত্রী গ্রামীণ আবাস প্রকল্পের অধীনে দেওয়া হয়েছিল, তাই সেই বাড়ি বসবাস করা ছাড়া অন্য কাজে ব্যবহার করা যায় না, এই যুক্তি দেখিয়ে সরকার মিউজিয়ামটি বন্ধ করে দিয়েছে।
এই কারণ উল্লেখ করে গোয়ালপাড়ার ডেপুটি কমিশনারের একটি লিখিত নির্দেশ মিউজিয়ামের দরজায় আটকিয়ে ভবনটি সিলগালা করে দিয়েছে প্রশাসন।
কাদের আটক করা হয়েছে?
ওই কমিউনিটি দুই প্রধান এবং যারা ওই মিউজিয়াম তৈরি করেছিল তাদেরকে আটক করা হয়েছে। বেআইনি কাজের জন্য কোনও স্থান ব্যাবহারের আইনে এবং ইন্ডিয়ান পিনাল কোডের অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র এবং কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনার চিন্তা ভাবনা নিয়ে অস্ত্র সংগ্রহ করার আইনে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
জিপি সিং যিনি অসম পুলিশের স্পেস্যাল ডিরেক্টর, তিনি বলেছেন যে, দুই নেতাকে তাঁদের সঙ্গে আর কাদের যোগ রয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন করা হবে। তাদের সঙ্গে জঙ্গি গোষ্ঠী আনসারুল্লা বাংলা দল এবং ভারতের আল কায়েদা শাখার কী যোগ রয়েছে তা নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
কেন মিঞাঁ মিউজিয়াম?
তবে মিঞাঁ মিউজিয়ামটির আদৌ কি প্রয়োজন ছিল? প্রশ্ন তুলেছেন খোদ আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা।
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “লাঙ্গলটি শুধু মিঞাঁরা ব্যবহার করে? অসমীয়া মানুষও তো লাঙ্গল ব্যবহার করে। মাছ ধরার যে সরঞ্জামটা রাখা হয়েছে, সেটাও তো তপশীলী জাতির মানুষ ব্যবহার করে!গামুসাও ছিল দেখা গেছে – সেটা তো আসামের গামছা। শুধুমাত্র লুঙ্গিটাই ওরা ছাড়া আর কেউ ব্যবহার করে না।”
মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “সরকারের কাছে তারা এটা প্রমাণ করুক যে লাঙল শুধুমাত্র মিঞাঁরাই ব্যবহার করে, অসমীয়ারা করে না। অসমীয়াদের ব্যবহার্য জিনিষপত্র নিয়ে গিয়ে মিঞাঁ মিউজিয়াম খুলেছে!”
এই মিউজিয়ামের অর্থায়ন কীভাবে হল, সেটাও তদন্ত করে দেখা হবে বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। কবি ফারহাদ ভুঁইঞ্যা অবশ্য মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে একমত নন।
তিনি বলেন, “যদি কেউ নিজেদের কমিউনিটির সামগ্রী সংরক্ষণ করতে চায়, তাকে আমি খারাপ মনে করি না। কিন্তু বিষয়টার রাজনীতিকরণ হয়ে গেছে। কিছু রাজনীতিবিদ আমাদের এই বাংলাভাষী মুসলমানদের ব্যবহার করছে ব্যক্তিগত রাজনীতির স্বার্থে। কিন্তু বাংলাভাষী মুসলমানরাই আসলে ভুক্তভোগী হচ্ছে আর লাভবান হবে বিজেপি।”
তার ব্যাখ্যা, বাংলাভাষী মুসলমানদের পরিধান লুঙ্গি ওই মিউজিয়ামে রাখা হয়েছিল। লুঙ্গির কথা মুখ্যমন্ত্রীও বলেছেন। আর এই লুঙ্গির প্রসঙ্গ তুলেই বাংলাভাষী মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রচার চালাতে শুরু করেছে বিজেপি।
মুখ্যমন্ত্রী বনাম মিঞাঁ
হিমন্ত বিশ্বশর্মা মাঝে মাঝেই বাংলাভাষী মুসলমানদের নিয়ে মন্তব্য করে থাকেন। কয়েক বছর আগে মিঞাঁ কবিতা নিয়ে আলোচনা শুরু হয় আসামে, আর হিমন্ত বিশ্বশর্মা সেই কবিতাগুলি আর তাদের রচয়িতাদের কটাক্ষ করেছিলেন।
সেই প্রসঙ্গ তুলে এনে মি. বিশ্বশর্মা এদিন বলেন, “আমি এর আগে যখন মিঞাঁ কবিতার প্রসঙ্গ তুলেছিলাম, তখন আসামের বুদ্ধিজীবীরা তার সমালোচনা করেছিলেন যে সেটা নাকি সাম্প্রদায়িক কথা ছিল। কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছে যে প্রথমে মিঞাঁ কবিতা, তারপরে মিঞাঁ স্কুল হল, এখন মিঞাঁ মিউজিয়ামও হয়েছে!”
হিন্দুত্ববাদী এবং অসমীয়া জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলো বলে থাকে যে বাংলাভাষী মুসলমানদের মধ্যে লক্ষ লক্ষ অনুপ্রবেশকারী রয়েছে। যদিও সেই প্রমাণ কখনই সামনে আসে নি।
উল্লেখ্য, এটি তৈরি করেছিল আসাম মিঞাঁ পরিষদের মহর আলি। উদ্বোধন হয়েছিল ২৩ অক্টোবর। বলা হয়েছিল এটি মিঞাঁ কমিউনিটির নিয়ে গবেষণা করছে। তারা খুঁজবে বাংলার মুসলিমদের মূল কোথায় তা নিয়ে। এরা ১৮৯০ সাল থেকে আসামে রয়েছে। এদের ব্রিটিশরা চাষ আবাদের জন্য এই দেশে নিয়ে এসেছিল।
এদিকে আলির দুই পুত্র ওই মিউজিয়ামের সিল খুলে দেবার দাবি জানিয়ে বসেছে প্রতিবাদে। উত্তর-পূর্ব ভারতের একটি রাজ্য। আসামের অধিবাসী বা আসামের ভাষাকে আসামীয়া নামে আখ্যায়িত করা হয়। তবে আসামের এক-তৃতীয়াংশ অধিবাসী বাঙালী। ব্রিটিশ শাসনকালে বিশেষ করে ১৮৫০ থেকে ১৮৬০ সালের মধ্যে ব্রিটিশরা ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে অনেক শ্রমিক এনেছিলেন চা বাগানে জন্য। যার মধ্যে অন্যতম রাজ্য ওড়িশা, বিহার (বর্তমানে ঝাড়খণ্ডসহ)।
১৮২৬ সালে ইয়াণ্ডাবু চুক্তির মাধ্যমে আসাম প্রথম ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। এ প্রদেশ মূলত চা, রেশম, পেট্রোলিয়াম এবং জীববৈচিত্রের জন্য বিখ্যাত।
আসামের মিঞাঁ কারা?
গোয়ালপাড়ার ‘মিঞাঁ মিউজিয়াম’ নিয়ে আসামের রাজনীতি এখন সরগরম। ডাপকারভিটা গ্রামের একতলা বাড়িটি মোহর আলির। সেখানেই চালু হয়েছিল ওই মিউজিয়ামটি।
পূর্ব বাংলার বিভিন্ন জেলা, বিশেষ করে ময়মনসিংহ, রংপুর ইত্যাদি অঞ্চল থযে বাংলাভাষী মুসলমান কৃষকরা আসামে বসতি গড়েছিলেন সেই ব্রিটিশ আমল থেকে, তাদের মিঞাঁ বলে ডাকে আসামের একটা বড় অংশের মানুষ।
।মিঞাঁটা কোনও কমিউনিটি না। পূর্ববঙ্গ থেকে আসা বাংলাভাষী মুসলমানদেরই তাচ্ছিল্য করে মিঞাঁ বলে আসামের মানুষ। বহু বছর ধরেই এটা চলে আসছে। তার ফলে আমাদের মধ্যেও একটা অংশ এখন নিজেদের মিঞাঁ বলে ভাবতে শুরু করেছে।
এসডব্লিউএসএস১৫৪০
আপনার মতামত জানানঃ