“এখানে একটা জিনিস বোঝা যায় যে এত মানুষ যে আসছে তারা সবাই বিএনপির না, সাধারণ মানুষ আছে। তারা কিন্তু বিএনপির প্রতি ভালোবাসা থেকে আসছে না। তারা এই রেজিম চেঞ্জ চায়। এবং এই রেজিম চেঞ্জের ব্যাপার যখন আসে তখনই সরকারি দল আতঙ্কিত হয়”- এমনটাই বলেছেন লেখক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল বিএনপি সম্প্রতি তিনটা সমাবেশ করেছে দেশের তিনটি বিভাগীয় শহরে। এসব সমাবেশে বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে।
যদিও এর আগে বিএনপি তাদের সমাবেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সরকারের নেতাকর্মী এবং পুলিশের বাধার মুখে পড়েছে। এবারে প্রশাসন থেকে সমাবেশ করার অনুমতি দেয়া হলেও যানবাহন বন্ধ করে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়েছে।
বিএনপির সমাবেশকে ঘিরে গত শনিবার খুলনাতে সড়ক এবং জলপথ বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়। এর আগে হঠাৎ করে ডাকা পরিবহন ধর্মঘটে শুক্রবার থেকে সব ধরনের বাস ও লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। মাঝিদের ধর্মঘটের মাধ্যমে বন্ধ করে দেয়া হয় রূপসা ঘাট ও জেলখানা ঘাটে যাত্রী পারাপার। এই দুটি ঘাট শহরের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত।
কিন্তু এই ধর্মঘট সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয় জনসভায়। পুলিশের তরফ থেকেও খুব একটা বাধা দেয়ার ঘটনা ঘটেনি। তবে এর আগে সমাবেশগুলোতে দেখা গেছে বিএনপির সমাবেশ ঘিরে স্থানীয় প্রশাসন এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের ব্যাপক বাধার মুখে পড়েছে বিএনপি। এমনকি কিছু কিছু স্থানে ১৪৪ ধারাও জারি করতে হয়েছে।
এখন একদিকে যেমন বিরোধী এই রাজনৈতিক দলটিকে সমাবেশ করতে দেয়া হচ্ছে, আবার একই সঙ্গে যানবাহন বন্ধ করে সমাবেশে যোগদানে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হচ্ছে। তবে বিএনপির জন্য এসব সত্ত্বেও আশার কথা হল- বিপুল মানুষের সমাগম।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন এই তিনটি সমাবেশে যে সংখ্যক মানুষ অংশ নিয়েছে, সেটা রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের জন্য হুমকি।
“তারা নিজেরাও চিন্তা করেনি যে বিএনপির মত নেতৃত্বহীন একটা দল এত লোক জোগাড় করতে পারবে। পলিটিকাল সরকার হিসেবে তাদের জন্য এটা যে একটা থ্রেট তাতে কোন সন্দেহ নেই।”
“নির্বাচনের বাকি আছে এক -দেড় বছর। এর মধ্যে যে বিএনপিকে ধরা হয়েছিল যে পার্টি কোমর-ভাঙা হয়ে গেছে, যে পার্টির কোন উদ্দেশ্য নেই, সেই দল এমনভাবে ঘুরে দাঁড়াল- এটা শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিকভাবে দেখা হচ্ছে যে সরবকারের পলিসির বিরুদ্ধে প্রচুর গণসমাবেশ হচ্ছে।”
বিএনপির পরের সমাবেশ রয়েছে রংপুরে। বিএনপি খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ চারদফা দাবিতে সমাবেশ করছে।
এদিকে, আওয়ামী লীগ যে চাপ অনুভব করছে তা বেশ স্পষ্ট। সূত্র মতে, আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ঢাকা এবং ঢাকার আশপাশে দলের জেলা ও সহযোগী সংগঠনের সম্মেলন এবং কেন্দ্রীয় কর্মসূচি ঘিরে বড় সমাবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছে। দলের নীতিনির্ধারকেরা বলছেন, বিএনপির বড় জমায়েতে দলের ওপর চাপ বেড়েছে। আওয়ামী লীগও বড় জমায়েতের মাধ্যমে বিএনপির লোকসমাগমের জবাব দিতে চায়।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, আগামী ১০ ডিসেম্বর বিএনপি ঢাকায় যে মহাসমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে, এর আগে–পরে আওয়ামী লীগও বড় জমায়েত করবে। এর মধ্যে গতকাল নারায়ণগঞ্জে দলের জেলা সম্মেলন উপলক্ষে বড় সমাবেশ করেছে। ২৯ অক্টোবর দলের ঢাকা জেলার সম্মেলনের জন্য আগারগাঁওয়ে যে মাঠে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা হতো, সেই স্থানকে নির্ধারণ করা হয়েছে।
গতকাল সকালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে মেট্রোরেলের একটি চুক্তি সই অনুষ্ঠান শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে কিসের পাল্টাপাল্টি। প্রতিদিন আমাদের প্রোগ্রাম হচ্ছে। লাখ লাখ লোক দেখবেন? আসেন। ২৯ তারিখ ঢাকা জেলা সম্মেলন করব, সেখানে আসেন। ফখরুল সাহেবকে (বিএনপির মহাসচিব) বিকেলে আমন্ত্রণ জানিয়েছি, একটা জেলা সম্মেলনে কত মানুষ হয় দেখার জন্য।’
এদিকে, আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানিয়েছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপি বর্জন করুক, তা চায় না আওয়ামী লীগ। যদিও বিএনপির কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগ ও পুলিশের পক্ষ থেকে হামলা–বাধা এসেছে। এরপরও বিএনপি ঢাকাসহ সারা দেশে বিপুল মানুষের উপস্থিতি দেখিয়েছে। কয়েক মাস ধরে গণমাধ্যমের একটা বড় জায়গা দখলে নিয়েছে বিরোধী দলটি; যা গত সাত–আট বছরে ঘটেনি।
এর ফলে সারা দেশের সাধারণ মানুষ, এমনকি বিদেশি কূটনীতিকদের কৌতূহলী করে তুলেছে তারা। আওয়ামী লীগের কর্মীদের মনেও কিছুটা উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে কষ্টে থাকা মানুষ বিএনপির ডাকে রাস্তায় নেমে আসে কি না, সেই শঙ্কাও আছে।
এ পরিস্থিতিতে বিএনপিকে আপাতত একেবারে মাঠছাড়া না করে চাপে রেখে কর্মসূচি পালন করতে দেবে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। পাশাপাশি সাংগঠনিক কর্মসূচিতে বড় জমায়েত করে নিজেদের শক্তি দেখানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি।
আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সমাবেশে লোক জমায়েতে কিছুটা বাধা দিয়ে বিএনপিকে এটা বোঝানো হচ্ছে যে আওয়ামী লীগ চাইলে সমাবেশ বন্ধ করে দিতে পারে।
প্রসঙ্গত, বিএনপি তাদের বিভাগীয় পর্যায়ে সমাবেশ শুরু করে চট্টগ্রাম দিয়ে। সেখানে বিপুল মানুষের সমাগম হয়। এর পরের সমাবেশটি হয় ময়মনসিংহে। সেখানে যানবাহন বন্ধ থাকার আশঙ্কায় বিএনপির নেতাকর্মীরা আগের দিনেই ময়মনসিংহ শহরে অবস্থান নেয়। সমাবেশের দিনেও সেখানে পরিবহন বন্ধ রাখা হয়।
কিন্তু সমাবেশে কোন আপত্তি তোলা হয় নি প্রশাসন থেকে। শিক্ষক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক রওনক জাহান বলেন সরকারের এই কর্মকাণ্ডকে তিনি পরস্পর বিরোধী মনে করছেন না। তিনি বলেন সরকার দেখতে চাচ্ছে বিরোধীরা কতটা শক্তিশালী অবস্থায় আছে। একটা কৌশল হবে বিরোধী দল একটা করবে, সরকারি দল আরেকটা করবে। কাজেই প্রথমেই সব কিছু বন্ধ করে দেয়ার যৌক্তিকতা তারা দেখছেন না। এখানে পরস্পর বিরোধী কোন কিছু দেখছি না।
এর আগে সেপ্টেম্বরে বিরোধীদল বিএনপি অভিযোগ করে, তারা যতগুলো রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করেছে, তার বেশির ভাগেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হামলার শিকার তারা হয়েছে। বিএনপির নেতারা আরও অভিযোগ করছেন, আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েই বিরোধী দলের আন্দোলন দমনের চেষ্টা করছে।
বিএনপির চলমান কর্মসূচিকে বাধাগ্রস্ত করতে তাদের সমর্থিত পরিবহন মালিক সমিতি দিয়ে কৃত্রিমভাবে শহরকে বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে বলে তারা অভিযোগ করছে। সরকারি দল অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪০০
আপনার মতামত জানানঃ