পবিত্র মক্কার সাথে যে নামটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে তা হলো পবিত্র কাবা। আরবের মরুর বুকে এই মক্কা যে কত প্রাচীন শহর তা নির্ণয় করা হয়ত বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। বিশাল মরুর বুকে এই মক্কায় মানবজাতির পদার্পণ হয়েছিল কোনো এক কালে। আর সেই সাথে মানববসতিও ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়েছিল সেখানে। মানুষের বসবাসের সাথে সাথে তাদের ধর্মেরও সূচনা ঘটে। মক্কায় তাই উপাসনার জন্য ধীরে ধীরে বিভিন্ন দেবতার মূর্তি তৈরি হতে থাকে। তেমনি এক দেবতার মূর্তি ছিল হুবাল।
প্রাক-ইসলামী আরবদের ধর্ম ও জীবনব্যবস্থা, বিশেষ করে হিজাজের মধ্যে, বাণিজ্যের উপর নির্ভরশীল ছিল। এছাড়া, তারা তাদের ধর্মের একটি বাণিজ্যও তৈরি করে। হযরত মুহাম্মদ (সা) এর জন্মেরও প্রায় চারশো বছর আগে আমর বিন লুহাই নামে হিজাজের একজন রাজা ছিলেন যিনি কাবার ছাদে হুবাল নামে এক মূর্তি স্থাপন করেন। এটি কুরাইশদের অন্যতম প্রধান দেবতা ছিল।
বলা হয়ে থাকে, কাবা এবং তার আশেপাশে মোট ৩৬০টি মূর্তি ছিল, এবং প্রতিটি গোত্রের নিজস্ব দেবতা ছিল। মূর্তিগুলোর আকার-আকৃতি উপাসকদের কল্পনানুসারে তৈরি করা হয়েছিল। হুবাল ছাড়াও কাবার ছাদে শামস নামে আরও একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়েছিল। মক্কায় তীর্থযাত্রীদের সাথে আনা কুরবানির পশুদের রক্ত কাবায় থাকা দেবতাদের প্রতি উৎসর্গ করা হতো, এবং কখনও কখনও এমনকি মানুষকেও বলি দেওয়া হতো। এসব কিছু সৃষ্টিকর্তার কাছে উৎসর্গ করা হতো। মূর্তিপূজার পাশাপাশি তারা সূর্য ও চন্দ্রেরও উপাসনা করতো।
মক্কার পৌত্তলিক আরবরা কাবাতে হুবাল নামে এক চন্দ্র দেবতার উপাসনা করতো। কাবাতে থাকা ৩৬০ দেবতার মূর্তির মধ্যে হুবাল ছিল সর্বোচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত। তবে আল্লাহকেও কাবার প্রতিপালক হিসেবেও উপাসনা করা হতো। কিন্তু পৌত্তলিক আরবরা আল্লাহর কোনো দৈহিক প্রতিমূর্তি তৈরি করেনি। হুবাল ছিল সেই প্রতিমূর্তি যার মাধ্যমে পৌত্তলিক আরবরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতো। পৌত্তলিক মক্কার সিরায় হুবালের চিত্রের পাশে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করার চিত্র ও গল্প রয়েছে।
হুবাল মূলত প্রাক-ইসলামী যুগের কুরাইশ গোত্রের সর্বোচ্চ উপাস্য ছিল। ইবনে হিশাম থেকে জানা যায়, পবিত্র কাবা এলাকার কাছে হুবাল নামে একটি মূর্তি ছিল। হিশাম ইবনে আল ক্বালবি তার কিতাব আল আসনাম বা বুক অব আইডলস-এ লিখেছেন, মর্তির সামনে সাতটি তীর রাখা হয়েছিল, যা ভবিষ্যদ্বাণীর জন্য নিক্ষেপ করা হতো, বিশেষ করে কঠিন ক্ষেত্রে, যেমন- কেউ কাউকে হত্যা করেছে বা কুমারিত্ব এবং বিবাহ অথবা এই ধরনের ঘটনায়।
কাবা এবং তার আশেপাশে কুরাইশদের বেশ কয়েকটি মূর্তি ছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিল হুবাল। এটি তৈরি করা হয়েছিল একজন মানুষের আদলে, যার ডান হাতটি ছিল ভাঙা। এটি এই অবস্থায় কুরাইশদের দখলে এসেছিল এবং তাই তারা এর জন্য একটি সোনার হাত তৈরি করেছিল। এটি কাবার ভেতরে দাঁড় করানো ছিল, এবং এর সামনে সাতটি ভবিষ্যদ্বাণীমূলক তীর ছিল। এর মধ্যে একটিতে ‘বিশুদ্ধ’ এবং অন্যটির উপর ‘বহিরাগত’ শব্দটি লেখা হয়েছিল।
যখনই কোনো নবজাতকের বংশকে সন্দেহ করা হতো, তারা হুবালের উদ্দেশ্যে বলিদান করত। তারপরে তীরগুলোকে ঝাঁকুনি দিত এবং নিক্ষেপ করতো। তীরগুলো যদি ‘বিশুদ্ধ’ শব্দটি দেখায়, তাহলে শিশুটিকে বৈধ ঘোষণা করা হতো, এবং গোত্র তাকে গ্রহণ করতো। আর যদি তীরগুলো ‘বহিরাগত’ দেখায়, তবে শিশুটিকে অবৈধ ঘোষণা করা হতো, এবং তাকে প্রত্যাখ্যান করতো। তৃতীয় তীরটি মৃতদের সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণীর সাথে সম্পর্কিত ছিল, এবং চতুর্থটি ছিল বিবাহ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণীর জন্য। অবশিষ্ট তিনটি তীরের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করা হয়নি।
যখনই তারা কোনো বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করত বা কোনো যাত্রা শুরুর প্রস্তাব দিত বা অন্য কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করতো, তখন তারা হুবালের দিকে অগ্রসর হতো এবং এর আগে ভবিষ্যদ্বাণীমূলক তীরগুলো ঝাঁকুনি দিত। তীরে যে ফলাফলই আসতো না কেন, তারা তা অনুসরণ করতো এবং সেই অনুযায়ী কাজ করতো।
হুবালের সামনে সাতটি তির ছিল, যার প্রতিটিতে কিছু শব্দ ছিল। একটিতে ‘রক্ত-মূল্য’ দিয়ে চিহ্নিত করা ছিল। রক্তের মূল্য কাকে দিতে হবে তা নিয়ে তাদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক হলে তারা সাতটি তির দিয়ে ভাগ্য গণনা করত এবং যার কাছে ঐ তিরটি পড়ত তাকে অর্থমূল্য পরিশোধ করতে হতো। আবার একটিকে ‘হ্যাঁ’ এবং অন্যটিকে ‘না’ দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছিল এবং যে বিষয়ে দৈববাণী আহ্বান করা হতো সেই বিষয়ের ফলাফল অনুযায়ী তারা কাজ করতো।
একটিতে ‘পানি’ লিখে চিহ্নিত করা ছিল। যদি তারা পানির জন্য মাটি খনন করতে চাইত, তারা ঐ তিরটি ছুড়ত এবং যেখানে ঐ তির পড়ত সেখানে তারা পানি খোঁজার কাজ শুরু করতো। অন্য একটিতে ‘নিজের’, আরেকটি ‘নিজের নয়’, এবং আরেকটিতে ‘অধিভুক্ত’ এই কথাগুলো চিহ্নিত করা ছিল। যদি তারা কোনো ছেলের খৎনা করতে চাইত, বিয়ে করতে চাইত, লাশ দাফন করতে চাইত বা কারো বংশতালিকা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করতো, তাহলে তারা তাকে একশত রৌপ্য মুদ্রা এবং একটি উট জবাই দিয়ে হুবালের কাছে নিয়ে যেত এবং যে লোকটি তার ভাগ্য গণনা করবে তাকে সেসব দিয়ে দিত।
অতঃপর তারা যাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল তাকে এগিয়ে নিয়ে এসে বলত: “হে আমাদের দেবতা, এই হলো ‘অমুক’-এর পুত্র ‘তমুক’, যার ব্যাপারে আমরা জানতে চাই। তাই তার ব্যাপারে সঠিক পথ দেখাও।” তারপর যে ব্যক্তি তির নিক্ষেপ করবে তাকে তারা বলতো, “নিক্ষেপ কর!” যদি ‘নিজের’ লেখা তিরটি বের হতো, তাহলে সে তাদের গোত্রের প্রকৃত সদস্য হতো; যদি ‘অধিভুক্ত’ আসতো তবে সে একজন মিত্র হিসেবে থাকতো; এবং যদি ‘নিজের নয়’ লেখা তির বেরিয়ে আসতো তবে ধরা হতো তাদের সাথে তার রক্তের সম্পর্ক ছিল না এবং সে মিত্রও ছিল না। এভাবে তারা তিরের লেখা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিত আর তাদের কাজকর্ম পরিচালনা ও নির্ধারণ করতো।
প্রত্নতত্ত্ববিদ এবং ঐতিহাসিকরা হুবালকে নিয়ে নানা রকম ধারণা দিয়েছেন। কেউ কেউ বলেন, হুবাল আল-লাতের ভাই, কারো মতে হুবাল একজন চন্দ্রদেবতা, এবং কেউ কেউ মত দিয়েছেন যে দক্ষিণ আরবের পুরাণগুলো চন্দ্র-পিতা, সূর্য-মা এবং সান্ধ্য নক্ষত্রের (শুক্র) ত্রিত্বের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল, যেখানে হুবাল পুত্র ছিল এবং এরকম আরও অনেক কিছু। যদিও অনেক ঐতিহাসিক এই ধারণাগুলো ছড়িয়ে দিতে পছন্দ করেন, তবে সেগুলোর খুব বেশি প্রমাণ নেই।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯৫৫
আপনার মতামত জানানঃ