প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে ফেসবুকে আপত্তিকর পোস্ট দেওয়ার অভিযোগে রাজবাড়ীতে এক নারীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ৷ গ্রেপ্তার নারীর নাম সোনিয়া আক্তার ওরফে স্মৃতি৷
তিনি রাজবাড়ী ব্লাড ডোনার্সের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও জেলা মহিলা দলের সদস্য৷ গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করেন রাজবাড়ী সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন।
সূত্র মাতে, বুধবার (৫ সেপ্টেম্বর) রাজবাড়ীর ১ নম্বর আমলি আদালতে উপস্থিত করা হলে বিচারক সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কায়ছুন নাহার সুরমা তাকে কারাগারে পাঠান। এর আগে, মঙ্গলবার দিবাগত রাতে (৫ সেপ্টেম্বর) তাকে রাজবাড়ী পৌরসভার বেড়াডাঙ্গা এলাকার নিজ বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়।
গণমধ্যমকে মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন বলেন, সোনিয়া আক্তারের বিরুদ্ধে পেনাল কোডের ১৫৩ ও ৫০৫ ধারায় থানায় একটি মামলা রয়েছে, মঙ্গলবার রাতেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ পরে আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
গত সোমবার সন্ধ্যায় সামসুল আরেফিন চৌধুরী নামের স্থানীয় এক আওয়ামী লীগের নেতা ওই ফেসবুক পোস্টের বিষয়ে রাজবাড়ী সদর থানায় লিখিত অভিযোগ দেন৷ পরে অভিযোগটি মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয়৷
সূত্র মতে, সোনিয়া আক্তার প্রায় এক মাস আগে ফেসবুকে ওই পোস্ট দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ সূত্রে জানা যায়৷
অভিযোগ সূত্রে আরও জানা যায়, গত ৩১ আগস্ট সোনিয়া আক্তার তার নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে একটি স্ট্যাটাস দেন৷ সেখানে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বক্তব্যের সমালোচনা করে ‘আপত্তিকর’ কথা লেখেন বলে মামলায় অভিযোগ আনা হয়েছে৷
বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়ম বলেছেন, ‘সোনিয়া আক্তারের দুটি ছোট বাচ্চা আছে৷ মধ্যরাতে তাকে বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে৷ এটা তো হানাদার বাহিনীর কর্মকাণ্ডের মতো৷’
অনেকে পোস্টটি দেখায় প্রধানমন্ত্রীর সুনাম ক্ষুণ্ণ ও মানহানি হয়েছে বলে অভিযোগে উল্লেখ করেছেন বাদী সামসুল আরেফিন চৌধুরী।
সামসুল আরেফিন চৌধুরী রাজবাড়ী সদর উপজেলার মিজানপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক৷ এদিকে সোনিয়া আক্তারকে মধ্যরাতে গ্রেপ্তারের ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়েছেন অনেকে।
বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়ম বলেছেন, ‘সোনিয়া আক্তারের দুটি ছোট বাচ্চা আছে৷ মধ্যরাতে তাকে বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে৷ এটা তো হানাদার বাহিনীর কর্মকাণ্ডের মতো৷’
এর বাইরে রাজবাড়ীর অনেক সাধারণ মানুষ তার গ্রেপ্তারের ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, সোনিয়া আক্তার স্মৃতি গত ১৩ বছরে ২৭ হাজারের অধিক মুমূর্ষ রোগীকে বিনামূল্যে রক্ত সংগ্রহ করে দিয়েছেন। বর্তমানে তিনি প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১৫ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করে দিচ্ছেন বিভিন্ন জায়গায়।
মামলার বাদী সামসুল আরেফিন চৌধুরী বলেছেন, তিনি ফেসবুক পোস্ট দেখে মনে করেছেন তার বিরুদ্ধে মামলা করা উচিত। তবে কোন আইনের কোন ধারায় মামলা করেছেন সে বিষয়ে তিনি বলতে পারেননি।
প্রথমে তিনি আইসিটি অ্যাক্টের কথা বলেন, আইসিটি অ্যাক্ট এখন আর বলবৎ নেই জানালে সামসুল বলেন, আমি আইন খুব একটা বুঝি না, তবে থানার ওসি স্যার আর আইনজীবি মিলে ধারা ঠিক করে দিয়েছেন। আইন বুঝে আমার এতো লাভ নেই। মামলা আরো দুইটা করবো।
তিনি আরও বলেন, আর যারা আমাকে ফোন করে উল্টাপাল্টা কথা বলছেন, বাজে কথা বলছেন তাদের নম্বরও টুকে রাখতে বলেছেন ওসি স্যার। প্রয়োজন হলে তাদের বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নেবো।
এ প্রসঙ্গে ডয়চে ভেলের বাংলা বিভাগের প্রধান খালেদ মুহিউদ্দীন বলেন, গ্রেপ্তারকৃত সোনিয়া আক্তার স্মৃতি বিএনপি করেন, রাত না পোহাতেই নিশ্চয়ই শুনতে পাব তিনি আরও অনেক দুষ্কর্মের সঙ্গে জড়িত? এমনকি প্রধানন্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণরা তাকে রোমহর্ষক সব বিশেষণে ভূষিতও করতে পারেন৷ শুধু ফেসবুকে স্ট্যাটাসই তাকে গ্রেপ্তারের একমাত্র কারণ নয় এরকমও হয়তো বলবেন প্রধানমন্ত্রীর সভাসদেরা৷
পরিস্থিতি বিবেচনা করলে কেউ সরকারের সমালোচনা করলেই তাকে ‘স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি’ হিসেবে তকমা দেয়া হয়। গঠনমূলক সমালোচনা সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়েছে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে। সেই সমালোচনা যে পক্ষ থেকেই আসুক না কেন, তা দমন করা হচ্ছে কঠিন হাতে।
হোক সে বিরোধীপক্ষ বা শিক্ষার্থী, সাংবাদিক বা সাধারণ নাগরিক। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, বাংলাদেশে বিরোধীরা ততোই দমন-নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, সংকুচিত হচ্ছে মত প্রকাশের স্বাধীনতাও।
তবে মনে রাখা উচিত কেউ সমালোচনার উর্ধ্বে নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নয়। আসলে স্বাধীনতার ‘স্বপক্ষে’ বা ‘বিপক্ষের’ শক্তি আখ্যা দিয়ে সব মানুষকে বিচার করা যেমন যায় না, তেমনি ‘আওয়ামী লীগ’ বা ‘বিএনপি-জামায়াত’ দিয়েও সবাইকে বিবেচনা করা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের অনেক মানুষ কোন রাজনৈতিক পরিচয় বহন করেন না। তারা যে কোনো ইস্যুতে স্বাধীনভাবে তাদের মত প্রকাশ করার চেষ্টা করেন। আর সরকারের কোনো কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করলেই কেউ ‘স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি’ বা ‘বিরোধী দলের প্রতিনিধি’ হয়ে যান না। বরং সাধারণ মানুষকে রাজনৈতিক পরিচয়ে পরিচিত করার চেয়ে তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়াই সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাবে আমাদের।
তবে সমালোচনার বিরুদ্ধে সবসময়ই কঠোর অবস্থান নিয়েছে আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশে যখন করোনাভাইরাসের বিস্তার শুরু হয়, তখন থেকেই গুজব ছড়ানোর অভিযোগে ৫০ জনের বেশি ব্যক্তিকে আটক করে র্যাব ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ তালিকায় যোগ হয় কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর ও লেখক মুশতাক আহমেদ। যেখানে পুলিশি নির্যাতনে লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর অভিযোগ ওঠে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক কাবেরী গায়েন মনে করেন সরকারের সহিষ্ণুতার অভাব থেকেই এ ধরণের গ্রেফতার করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালে ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে “অবমাননাকর” পোস্ট করায় ১৫ বছরের এক শিশুকে গ্রেপ্তার করা হয়। ঢাকার উত্তরে ভালুকায় পুলিশ গনমাধ্যমকে জানায় তারা শিশুটিকে গ্রেপ্তার করেছিল যখন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় এক রাজনৈতিক নেতা অভিযোগ করে ছেলেটি “আমাদের মায়ের মত নেত্রীকে … অপবাদ” দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে সমালোচনা করায় কাউকে গ্রেপ্তার করা শুধুমাত্র বাকস্বাধীনতার গুরুতর লঙ্ঘন নয়, সর্বশেষ উপায় ছাড়া ১৮ বছরের নিচে কোন শিশুকে আটক করা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনেরও লঙ্ঘন। তবুও গ্রেফতার করা হয় ওই কিশোরকে।
এরপর ধীরে ধীরে বিরোধীদের মুখ বন্ধ করতে আরও কঠোর থেকে কঠোর অবস্থান নেয় আওয়ামী লীগ। চলতি বছর জানুয়ারিতেই আওয়ামী লীগের ‘আওয়ামী’ শব্দের অর্থ বিকৃত করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার অভিযোগে এক তরুণকে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয় রাজশাহীর একটি আদালত।
মূলত, একটি স্বাধীন দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক৷ এই স্বাধীনতা নিয়ে আলাদা কোনো আলোচনাই হওয়ার কথা নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য জন্মের পর থেকেই বাংলাদেশ সেই আলোচনা নিয়েই আছে। স্বাধীনতা অর্জন করেও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সম্পূর্ণরূপে কখনো বাংলাদেশের মানুষ অর্জন করতে পারেনি।
এসডব্লিউ/এসএস/১১৫৫
আপনার মতামত জানানঃ