সন্ধ্যার পর রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো হয়ে ওঠে অপরাধের অভয়ারণ্য। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গোলাগুলি ও খুনাখুনিতে জড়িয়ে পড়ে রোহিঙ্গারা। কক্সবাজারের ৩৪ রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প এখন অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে।
খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, মাদক কিংবা মানব পাচার শরণার্থী ক্যাম্পের নিত্য ঘটনা। ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার এবং নিজেদের অবস্থান সংহত করতে প্রায়ই অস্ত্রের মহড়া কিংবা রক্তের হোলি খেলায় মেতে ওঠে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা।
টেকনাফের উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে থামছেনা খুনাখুনি। গত বুধবার রাতেও এক রোহিঙ্গা যুবককে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। নিহত এরশাদ উখিয়া কুতুপালং ক্যাম্প-৪ এক্সটেনশনের এইচ ব্লকের বাসিন্দা।
এপিবিএন-১৪ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাসুদ আনোয়ার বলেন, গত রাত সাড়ে তিনটার দিকে এক রোহিঙ্গা যুবককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আমরা হত্যার কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করছি এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অতি দ্রত সময়ের মধ্যে আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য অভিযান অব্যাহত রেখেছি।
উখিয়া থানার ওসি শেখ মো. আলী বলেন, গত দু’দিনে ৩ জনকে হত্যা করেছে কিছু রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। আমরা দ্রততম সময়ের মধ্যে হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।
জানা যায়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে, গত জুলাই মাস থেকে ৩ মাসে ১১ জন খুনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৫ জন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্বেচ্ছাসেবক (ভলেন্টিয়ার) হিসেবে কাজ করত। সন্ত্রাসীরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্বেচ্ছাসেবক দলকে অকার্যকর করতে এবং সাধারণ রোহিঙ্গাদের মনোবল ভেঙ্গে দিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই পরিকল্পিত টার্গেট কিলিংয়ের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে বলে অনেকেই মনে করেন।
মিয়ানমারে নির্যাতিত ১২ লাখের মত রোহিঙ্গা গত ৫ বছর ধরে উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্পে অবস্থান করছে। যখনই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে তুড়জোড় শুরু হয় তখনই মহল বিশেষ সীমান্তে অস্থিরতা সৃষ্টি করে।
সন্ত্রাসীরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্বেচ্ছাসেবক দলকে অকার্যকর করতে এবং সাধারণ রোহিঙ্গাদের মনোবল ভেঙ্গে দিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই পরিকল্পিত টার্গেট কিলিংয়ের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে বলে অনেকেই মনে করেন।
এদিকে কিছু রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে গুম, খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজি, ইয়াবা ব্যবসা, স্বর্ণ চোরাচালান ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে আশ্রয় ক্যাম্পগুলো অস্থির হয়ে উঠেছে। এসব কর্মকাণ্ড আইনশৃংখলা বাহিনীর প্রতি চ্যালেঞ্জ স্থানীয়ের মাঝে ভীতি ছড়িয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিলম্বিত করাই তাদের মতলব বলে মনে করেন স্থানীয় সচেতন মহল। তাদের মতে, দ্রত রোহিঙ্গাদেরও নিজ দেশে প্রত্যাবাসন করাই সমস্যার একমাত্র সমাধান।
এদিকে কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চার মাঝি খুনের ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন মোহাম্মদ হাশিম নামে এক রোহিঙ্গা তরুণ। এ প্রসঙ্গে গতকাল বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে পাঠানো প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিয়োজিত এপিবিএনের সহকারী পুলিশ সুপার মো. ফারুক আহমদ জানান, গত বুধবার ফেসবুক লাইভে হাশিমের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সংঘটিত কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের বক্তব্য যাচাই বাছাই করে এপিবিএন। পুলিশ ঐ সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছে এবং গোয়েন্দা নজরদারির মাধ্যমে তার অবস্থান নিশ্চিত করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন।
প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আরো জানানো হয়, বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত অপরাধ গোয়েন্দা তথ্য যাচাই-বাছাই করে প্রাথমিকভাবে জানা যায়, হাশিমের বক্তব্য সঠিক নয়। প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করতে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে বা কারো প্ররোচনায় হাশিম এ ধরনের অপপ্রচার চালিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তার পরেও হাশিমের বক্তব্যকে গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করে তাকে আইনের আওতায় এনে প্রকৃত রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা অব্যাহত আছে।
কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে একের পর এক হামলা ও খুনের ঘটনা ঘটছে। অভিযোগ উঠেছে, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাতে স্বেচ্ছায় রোহিঙ্গাদের পাহারা দেওয়ার যে পদ্ধতি চালু আছে, তা অকার্যকর করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে বিদ্রোহী রোহিঙ্গা গ্রুপগুলো। এর ফলে ক্যাম্পগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বলে মনে করছে স্বেচ্ছাসেবী রোহিঙ্গারা। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করা আগের চেয়ে কঠিন হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
সূত্র মতে, বাংলাদেশে আশ্রয় পাওয়া রোহিঙ্গারা শরণার্থী ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার এবং দ্রুত ধনী হতে জড়িয়ে পড়েছে নানা অপরাধ কর্মকান্ডে। ক্যাম্পের বিভিন্ন ব্লকে নিজের অবস্থান সুসংহত করতে তৈরি করেছে অপরাধী গ্রুপ। তারা ক্যাম্পের বিভিন্ন ব্লকে আধিপত্য বিস্তার, মাদক ও মানব পাচার, অস্ত্র ব্যবসা, চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে প্রায় সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে।
এতে প্রায়ই খুন, সংঘাতের ঘটনা ঘটছে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ঘটছে অপহরণের মতো ঘটনাও। এ ছাড়া ধর্ষণ, ডাকাতির ‘সাধারণ’ ঘটনায় পরিণত হয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। সন্ত্রাসীরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে ইয়াবার আখড়ায় পরিণত করেছে। মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান সরাসরি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আসার কারণে দেশের মাদকের অন্যতম ট্রানজিট পয়েন্টেও পরিণত হয়েছে ক্যাম্পগুলো।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের সামনে ‘রোহিঙ্গা’ বিষয় একটি বড় ধরনের জটিল চ্যালেঞ্জ হতে যাচ্ছে, যা দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় সমাধান সম্ভব নয়। কূটনৈতিক আলোচনার পাশাপাশি রোহিঙ্গা নেতৃত্বের বিকাশ ঘটিয়ে বিকল্প পথের সরকারের সব আন্তরিক প্রচেষ্টা সহজে কার্যকর হচ্ছে না। রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশেরই নয়, সমগ্র বিশ্বের উদার গণতান্ত্রিক এবং মানবাধিকার রক্ষাকারী চ্যাম্পিয়নদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।
সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা বলেন, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যত দেরি করবে, খুনসহ নানা রকম সমস্যা তত বাড়বে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত হবে মিয়ানমার সরকারের ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি করে এ সমস্যার সমাধান করা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৩৬
আপনার মতামত জানানঃ